বিজয়ের মাস ডিসেম্বর সামনে রেখে আজো ভয়, শঙ্কা, আতঙ্ক আর স্বজন হারানোর বেদনায় এলোমেলো হয়ে যায় ’৭১-এর বিভীষিকা নিয়ে বেঁচে থাকা শরীয়তপুরের কয়েকশ নর-নারী। মনে হয় স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও এখানে বিজয় পৌঁছেনি। একের পর এক সরকার পরিবর্তন হয়েছে। এলাকার শত শত শহীদের স্মৃতির প্রতি স্বাধীনতার ৩৮ বছর পর্যন্ত কেউ সম্মান জানানোর চিন্তাও করেনি। ৪৭ বছর পার হতে শরীয়তপুর পৌর কর্তৃপক্ষ একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করলেও ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকশ পরিবারের একজনকেও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেনি কোনো সরকার। এমনকি রাজাকারদের বিরুদ্ধেও কোনো কথা বলেনি কেউ। মহান স্বাধীনতার ৪৬ বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আক্ষেপের কথা জানিয়েছেন এ এলাকার শহীদ পরিবারগুলো। ১৯৭১ সালের ভয়াল মুক্তিযুদ্ধের সময় শরীয়তপুর পৌর এলাকার কাশাভোগ, নিলকান্দি, মধ্যপাড়া, ধানুকা, রুদ্রকরসহ হিন্দুপ্রধান এলাকাগুলোতে রাজাকারদের সহায়তায় ৬ থেকে ৭ দফায় শত শত পাকসেনা হানা দিয়ে অকাতরে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করেছে প্রায় ৯০০ নারী-পুরুষ-শিশুসহ আবালবৃদ্ধবনিতাকে। ’৭১ সালের ২২ মে হত্যা করা হয় ৩৭০ জনকে। ধর্ষণ করা হয় শতাধিক তরুণীকে। চোখ বেঁধে নিয়ে মাদারীপুর এ আর হাওলাদার জুট মিলসে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় প্রায় ৭০ নারীসহ দুই শতাধিক পুরুষকে। তারা কেউ আর ফিরে আসেনি। ৪২ বছর স্বামী গৌরাঙ্গ চন্দ্রের ফিরে আসার অপেক্ষায় থেকে ৬৫ বছরের বৃদ্ধা যুগল বালা ২০১১ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেছেন কমরেড নুরুল ইসলাম, আবুল কালাম হাওলাদার, দীনেশ চন্দ্র সাহা, স্বপন সাহা, সোহরাব শিকদার, সুভাষ দাস, মহাদেব দাস, সনাতন দাস, মানিক দাস, মিনা রানী পোদ্দার ও কালু সাহাসহ ৩০-৪০ জন প্রত্যক্ষদর্শী, যারা সে সময়ের বিভীষিকাময় হত্যাযজ্ঞের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তারা জানান, ’৭১-এর ২২ মে দুপুর গড়িয়ে যখন বিকাল হতে চলেছে, পাক হানাদার বাহিনীর জাহাজ সদর উপজেলার আঙ্গারিয়া নদীর ঘাটে নোঙর করে। দেড় শতাধিক সেনাসদস্যকে রাজাকার সোলেমান মৌলভী, রবিউল্লা মাস্টার, আজিজ মোল্যা, মজিবর তালুকদার, নুরুল আলম তালুকদার, মতিন খানসহ রাজাকারের একটি বিশাল দলের নেতৃত্বে আঙ্গারিয়া বাজারের ওপর দিয়ে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা মনোহর বাজার ও রুদ্রকরের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। পাকবাহিনীর দলকে আসতে দেখে কমরেড নুরুল ইসলাম (বর্তমানে আঙ্গারিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দফতরি) হাতে লাল গামছা উড়িয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে চিৎকার করে বলছিলেন- ‘পাকসেনারা ঢুকে পড়েছে, যে যেখানে আছ পালাও পালাও, জীবন বাঁচাও। এভাবে তিনি রুদ্রকর পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার দৌড়ে মানুষের কাছে সংবাদ পৌঁছে দিয়ে অনেককে নিরাপদে আশ্রয় নিতে সাহায্য করেছিলেন।
ওই সময় পাকবাহিনী আঙ্গারিয়া বাজার অতিক্রম করে কাশাভোগ তালুকদার বাড়ি ব্রিজের কাছে পৌঁছলে গরু নিয়ে বাড়ি যাওয়ার সময় কৃষক আবদুস সামাদ শিকদার ভয়ে দৌড়ে পালাতে চাইলে পাক সেনারা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। ঘটনাস্থলেই প্রথম শহীদ হন আবদুস সামাদ শিকদার। এর থেকে সামান্য দূরে সম্ভু কর্মকার (কামার)-কেও গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর ১০০ গজ পূর্বদিকে নাগবাড়ীতে ঢুকে ৮৫ বছরের বৃদ্ধ উপেন্দ্রনাথ নাগকে গুলি করে হত্যা করে। গুলির শব্দ শুনে তার স্ত্রী তাবিনী বেলা নাগ (৭৫) চিৎকার দিলে তাকেও গুলী করে হত্যা করা হয়। পাশের বাড়িতে পালিয়ে থাকা একই পরিবারের শিবু দাস সাহা ও তার ভাই গৌরাঙ্গ সাহা, শিবু দাসের তিন ছেলেসহ একজন মহিলাকে নির্মমভাবে গুলি করে ও পরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। এসব হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে কাশাভোগ গ্রামে। পাকসেনারা রাজাকারদের সহায়তায় মধ্যপাড়া গ্রামে প্রবেশ করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। গুলির শব্দ ও মানুষের আহাজারি শুনে এই গ্রামের মানুষ জীবন বাঁচানোর জন্য দিগ্বিদিক দৌড়াতে শুরু করে। রাজাকারদের নেতৃত্বে তখন পাকসেনারা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে এলাকায় ঢুকে পাখির মতো গুলি করে মারতে শুরু করে। এ সময় ৮ মাসের শিশুপুত্র কৃষ্ণকে নিয়ে একটি মাটির গর্তে পালিয়ে থাকা তার মা রাধা রানীকে গুলি করে। রাধা রানী গুলি খেয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। পরের দিন সকালে গর্তের ভেতর দেখা যায় রাধা রানীর ৮ মাসের শিশুপুত্রটি মাতৃদুগ্ধ পান করা অবস্থায় মায়ের লাশের পাশে মরে পড়ে আছে। এরপর রাধা রানীর স্বামী হরি সাহা (৫০) ও তার মা চিরবালা (৮০)-কেও হত্যা করা হয়। পাকসেনাদের একটি দল সাথী বিড়ি ফ্যাক্টরির মালিক ভজনিতাই সাহার বাড়িতে ঢুকে রমণী সাহা ও তার মেয়ে শোভা রানী এবং তার শ্বশুরবাড়ি থেকে আশ্রয় নিতে আসা ৯ জনকে গুলি করে হত্যা করে। ঘাতকের একটি দল দাসপাড়ায় ঢুকে মন্টু দাসের বোন সখী বালা দাসকে তাড়া করলে সে তার দাদা, বউদি ও তাদের ৬ মাসের শিশুসন্তানকে নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলে ঘাতকরা জানালা দিয়ে গুলি করলে সখী বালার বুকে গুলি লাগে। দাদা বউদি ও শিশুটিকে বাঁচানোর জন্য সখী বালা গুলি খেয়েও চিৎকার করেনি। মন্টু দাস তার স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে পেছনের বেড়া ভেঙে পালিয়ে যেতে পারলেও সখী বালা সেখানেই ঘরের ভেতর নিস্তেজ নিথর দেহ নিয়ে পড়ে থাকে। ওই সময় রাজাকাররা ঘরটিতে কেরোসিন ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে সখী বালাসহ ঘরটি পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। এ দৃশ্য দেখে রাজাকাররা বিকৃত উল্লাস আর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
মানিক দাস জানান, মিলিটারির দল ৬ দফায় এই এলাকায় হামলা চালায়। যুগল বালাদের বাড়িতে থাকা ২টি দালান ঘরের একটি মর্টার শেল ও বাসায়নিক পাউডার ছিটিয়ে শত শত রাউন্ড গুলি করে দালানটি মাটির সঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়। ওই সময় তাদের ঘর থেকে রাজাকাররা প্রায় একশ ভরি স্বর্ণালঙ্কারসহ অনেক মূল্যবান সম্পদ লুট করে নিয়ে যায়। স্বামী গৌরাঙ্গ চন্দ্র পোদ্দারসহ দেবর নিপিন্দ্রনাথ পোদ্দার, শিক্ষক সুখদেব সাহা, জয়দেব সাহা, মণিকৃষ্ণ সাহা ও লক্ষ্মীচন্দ্র সাহাকে পাকবাহিনী বেঁধে নিয়ে যায়। যুগল বালাসহ আরো ১০-১২ যুবতী মেয়েকে একই বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে নিকারী বাড়ির কাছে একটি টিনের ছাপরা মসজিদে তাদের ওপর অমানবিক অত্যাচার (ধর্ষণ) চালানো হয়। যুগল বালার স্বামী গৌরাঙ্গ চন্দ্র আজো ফিরে আসেনি। অনেকের কাছে শুনেছে, তার স্বামীসহ সবাইকে হত্যা করে আড়িয়ালখাঁ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি তা বিশ্বাস না করে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত স্বামীর পথ চেয়ে অনবরত অশ্রু বিসর্জন দিয়েছেন।