মজুত কমেছে চাল ও গমের

সংগৃহীত ছবি

আমদানি-রফতানি

জরুরি ভিত্তিতে জিটুজি পদ্ধতিতে আমদানির চেষ্টা

মজুত কমেছে চাল ও গমের

  • মোহসিন কবির
  • প্রকাশিত ১২ মার্চ, ২০২১

দেশের সব শ্রেণির মানুষের প্রধান খাদ্য চাল। কিন্তু সম্প্রতি সরবরাহ সংকটের কারণে বাজারে চালের দামে নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের। এদিকে সরকারের মজুতের পরিমাণও গত জানুয়ারি থেকে কমে এসেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী (৮ মার্চ পর্যন্ত) খাদ্যশস্যের সরকারি মজুত মাত্র ৬.২৬ লাখ টন, যার মধ্যে চাল ৫.২৮ লাখ টন এবং গম ০.৯৮ লাখ টন। অর্থাৎ চালের পাশাপাশি গমের মজুতও কমেছে।

গত ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারের গুদামে খাদ্যশস্যের মজুতের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ২১ হাজার টন, যার মধ্যে চালের পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৩৭ হাজার টন। সংশ্লিষ্টদের মতে, বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সরকারি গুদামে নিরাপত্তা মজুত হিসেবে অন্তত ১০ লাখ টন চাল থাকতে হয়।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল, অভ্যন্তরীণ খাদ্য চাহিদা পূরণের পরও চলতি বছরের জুন পর্যন্ত কমপক্ষে ৩০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, অতিবৃষ্টিতে কয়েক দফা বন্যায় ৩৫টি জেলার আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সারা বছরের উৎপাদন ও চাহিদা বিবেচনা করলে দেশে খাদ্য ঘাটতির ‘আপাতত  কোনো আশঙ্কা নেই’।

কিন্তু ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সেই পূর্বাভাস শেষ পর্যন্ত সঠিক প্রমাণিত হয়নি। ফলে সরকার চাল আমদানির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। সবশেষ ১০ মার্চ সরকার জরুরি ভিত্তিতে জিটুজি পদ্ধতিতে ভারত, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকে তিন লাখ ৫০ হাজার টন সিদ্ধ ও আতপ চাল আমদানির নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়।

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সোর্স থেকে চাল আনার চেষ্টা করছি। এর একটাই কারণ, কোনো জায়গায় ফেল করলে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। সে কারণে আমরা রিস্কটা মিনিমাইজ করার জন্য বা আরো কমিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন সোর্স থেকে কেনার ব্যবস্থা করছি।’

চালের সরবরাহ নিয়ে সরকার কতটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত তা ফুটে ওঠে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে। দ্রুত চাল আমদানি নিশ্চিত করতে দাম নির্ধারণের বিষয়টিতেও আপাতত গুরুত্ব পাচ্ছে না।

অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এখন আমাদের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে চালের দাম সংগ্রহ করবে। এরপর ভার্চুয়ালি আলোচনা করে নির্ধারণ করবে। চাল নিয়ে কোনো রিস্ক না নেওয়ার জন্যই ভারত, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকে চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কত দামে কেনা হবে সেটা পরে ক্রয়সংক্রান্ত কমিটিতে আবার আসবে।’ 

জিটুজি পদ্ধতিতে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের সিভিল সাপ্লাইস করপোরেশন লিমিটেড (পিইউএনএসইউপি) থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টন নন-বাসমতী সিদ্ধ চাল সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে আমদানির নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী অফিসের সাকননাখোন ন্যাশনাল ফার্মস কাউন্সিল থেকে এক লাখ ৫০ হাজার টন নন-বাসমতী সিদ্ধ চাল ও ভিয়েতনামের সাউদার্ন ফুড করপোরেশন থেকে ৫০ হাজার টন আতপ চাল (সাদা) সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে আমদানি করা হবে।

এ প্রসঙ্গে খাদ্য সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানম গণমাধ্যমে জানান, যতদিন না পর্যন্ত বাজারে চালের দাম সহনীয় না হবে ততদিন পর্যন্ত চাল আমদানি অব্যাহত থাকবে। একই সাথে যত দ্রুত সম্ভব এই চাল আমদানি করা হবে বলেও জানান তিনি।

চলতি বছর ধান-চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা ব্যর্থ হওয়ায় পরিস্থিতি সামাল দিতে গত ৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী চাল আমদানির অনুমতি দেন। এজন্য প্রথমদিকে চাল আমদানি শুল্ক ৬২.৫ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়, যদিও পরে ব্যবসায়ীদের দাবি এবং আমদানিকে উৎসাহী করতে শুল্ক ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়।

এরপর খাদ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন শর্তে কয়েক ধাপে বেসরকারি পর্যায়ে মোট ৩২০ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ ১৪ হাজার ৫০০ টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়। পাশাপাশি বিভিন্ন সময় ধাপে ধাপে আমদানি বাড়াতে উদ্যোগ নেয় সরকার। গত ৩ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমার থেকে শর্তসাপেক্ষে এক লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন দেয় সরকার। পরে মিয়ানমারে সেনাশাসন শুরু হওয়ায় সংশোধনীর মাধ্যমে দেশটি থেকে জিটুজি ভিত্তিতে চাল কেনার অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর গত ১ মার্চ নতুন করে আরো ৫৭ ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ ৮০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়।

এদিকে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারেও বর্তমানে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদনে আফ্রিকার দেশগুলোতে চালের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্ববাজারে চালের দাম বৃদ্ধির কারণ বলে জানানো হয়েছে। পাশাপাশি করোনায় বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ার সুযোগে চাল রপ্তানিকারক দেশগুলোও দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব কারণে চালের দাম নাগালে থাকতেই সরকার প্রয়োজনীয় মজুত নিশ্চিত করতে চায়।

খাদ্য সচিব নাজমানারা প্রসঙ্গে বলেন, ‘যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) রয়েছে, সব দেশ থেকেই চাল আমদানি করা হবে। তবে এ ক্ষেত্রে দামের বিষয়টাও বিবেচনায় রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজার দাম অনুযায়ী যেখানে সবচেয়ে কম পাব, সেখান থেকেই আমদানির সব রকম চেষ্টা করা হচ্ছে।’

এদিকে দেশে চালসহ অন্য খাদ্যপণ্যের সংকট না থাকার কথা বরাবরই জানিয়ে আসছিল সরকার। কিন্তু তারপরও কেন এই সংকট তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েই গেছে।

সরকারের কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক চালের ঘাটতির জন্য করোনায় রোহিঙ্গাসহ বিভিন্ন জায়গায় মানুষের মাঝে চাল বিতরণকে দায়ী করেন। তবে অনেকেই মনে করছেন, খাদ্য মন্ত্রণালয় গত বছর ২৬ এপ্রিল থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মজুত বাড়াতে ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল কেনার লক্ষ্য নিলেও কিনতে পেরেছিল ৬ লাখ ৮০ হাজার টন। একইভাবে দেড় লাখ টন আতপ চাল কেনার লক্ষ্য নিয়ে কিনতে পারে ৯৯ হাজার টন। বোরো ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল ৮ লাখ টন। কিন্তু কিনতে পেরেছে মাত্র ২ লাখ ২০ হাজার টন, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ কম। অন্যদিকে ধান চাল আকারে ধরা হলে অভিযান মৌসুমে সরকার মোট চাল সংগ্রহ করতে পারে ৮ লাখ ৩১ হাজার ৪৬১ টন। এর বাইরে ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট চাল আমদানি হয়েছে মাত্র ৪ হাজার টন। এসব মিলে চালের মজুত কিছুটা বাড়লেও তা গুদামে বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। অর্থাৎ সরকারের মজুত বিভিন্ন উন্নয়ন সহায়তার কারণে প্রতিনিয়ত কমতে থাকে।

অন্যদিকে ধানের দাম বৃদ্ধিকে সংকটের জন্য দায়ি করেছেন মিলাররা। বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম খোরশেদ আলম খান বলেন, ‘এবার ধানের সরবরাহ প্রথম থেকেই কম ছিল। আগে প্রতিদিন ৫০ গাড়ি ধান কেনা হতো। এবার তা ১০ গাড়িও পাইনি। ফলে কৃষক পর্যায়ে ধানের দাম ছিল বেশি। পণ্যের দাম বাড়া-কমা নির্ভর করে উৎপাদন ও সরবরাহ পরিস্থিতির ওপর। সরবরাহ কমে গেলে দাম বাড়ে। এখন সেটাই হচ্ছে।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads