ভেজাল ঘি’তে সয়লাব ফেনী

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

ভেজাল ঘি’তে সয়লাব ফেনী

  • সৌরভ পাটোয়ারী, ফেনী
  • প্রকাশিত ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০

ফেনীতে বিষাক্ত কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের ঘি। শহরের নামিদামি মুদি-মনোহারি দোকান থেকে শুরু করে অলিগলিতে পসরা সাজিয়েছেন দোকানিরা। এসব নকল ঘি বিক্রি করে রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যাচ্ছেন কিছু সংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ী। এতে রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। অন্যদিকে ভেজাল ঘি খেয়ে ভোক্তাদের স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ফেনী শহরতলির লালপুলে গ্রামীণ ব্যাংক সংলগ্ন স্থানে গড়ে উঠেছে ভেজাল ঘির কারখানা। বিশাল কারখানায় সাবানের ফেনা, জুতার গাম, বিভিন্ন রং ফ্লেভার ও পামওয়েল এবং কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি হচ্ছে এসব মুখরোচক নকল শাহী ও ভিআইপি ঘি। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই ভেতরে কী হচ্ছে। দরজা বন্ধ করে ভেজাল ঘি শাহী ও ভিআইপি ঘি তৈরি করেন মধুয়াই মোফাজ্জল হকের ছেলে সাইফুল ইসলাম ও ফরহাদ। তারা আগে থেকে বাজারজাত করার জন্য টিনের কৌটা তৈরি করে থাকেন। ৯০০ গ্রাম ওজনের কৌটাগুলো কাটন ভর্তি করে পিকআপে করে বিক্রয় প্রতিনিধির মাধ্যমে ফেনী শহর ও উপজেলার বিভিন্ন বাজারের দোকানে বিক্রি করা হয়। ফেনী থেকে এসব নকল ঘি পার্শ্ববর্তী চৌদ্দগ্রাম, বসুরহাট, কোম্পানীগঞ্জ ও সেনবাগে বাজারজাত করা হয়। এসব ভেজাল ঘি বাজারজাত করতে ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করা জন্য মার্কেটিংয়ে লোকও নিয়োগ দেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের আস্থা অর্জন করতে বিএসটিআইয়ের ভুয়া লোগোও মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখও ব্যবহার করা হচ্ছে এসব ঘিয়ে।

তাদের কর্মচারীদের তথ্যমতে, এসব ভেজাল ঘি তৈরি করতে ১০০ টাকা খরচ হলেও বিক্রি করা হচ্ছে ৪৬০ থেকে ৯০০ টাকায়। এতে ব্যবসায়ীদের চেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে বাবুর্চিরা। বাবুর্চিদের আকৃষ্ট করতে প্রতি কৌটায় টোকেনের মাধ্যমে ২০০ টাকা করে দেওয়া হয়। এতে বাবুর্চিরা লোভে পড়ে বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে এসব ভেজাল ঘি অনেক ক্ষেত্রে ১০-১৫টি ব্যবহার করে। শুধু ডালডা, সাবান তৈরির সোডা, পামওয়েল ও পারফিউম জাতীয় উপকরণ দিয়ে চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হয় এসব ভেজাল ঘি। এসব ঘি দিয়ে তৈরি খাবার খেয়ে অনেকে বিভিন্ন কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

এ ব্যাপারে দাগনভূঞা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের (আরএমও) ডা. আবু তাহের পাটোয়ারী জানান, এসব নকল ঘি খেয়ে বর্তমানে খাদ্য-বিষক্রিয়া ও লিভার সিরোসিসসহ নানান কঠিন রোগ হচ্ছে। এতে হাসপাতালগুলোতে এ জাতীয় রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে।

এছাড়া বিএসটিআইয়ের অনুমোদন ছাড়াই অনেকগুলো ঘি তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। ফেনীর লালপুর, রামপুর, ধর্মপুরসহ শহরের অলিগলিতে ভেজাল ঘির কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। টিনের কৌটায় কারখানায় স্থান চট্টগ্রাম বিসিক এলাকার ষোলশহর ও নোয়াখালীর চৌমুহনীর বিসিক উল্লেখ করা হলেও এসব ভেজাল ঘি গোপনে তৈরি হচ্ছে ফেনীর লালপোল মিতালী স্টোরের মালিকানাধীন লিটনের গোডাউন ও বিরিঞ্চি-হ্যাংকার-শিহাব উদ্দিন স্বপনের গোপন গোডাউনসহ  ফেনী শহরের রামপুর ও ফেনী সদর উপজেলার ধর্মপুরে।

পোলাও, বিরিয়ানি, পরোটা, কোরমা, হালুয়া বা যেকোনো সুস্বাদু খাবার তৈরিতে বিয়ে অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন হোটেল রেস্টুরেন্টে ব্যবহার করা হয় এসব ভেজাল ঘি।

এ সুযোগে ফেনী বড় বাজারে দুই যুগ ধরে সয়লাব হয়ে গেছে এসব ভেজাল ঘি। এসব ভেজাল ঘির কারণে আসল ঘি বাজার থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। ফেনীর বাজার দখলে নিয়েছে ভেজাল মিশ্রিত শাহী স্পেশাল গাওয়া ঘি, অভি স্পেশাল গাওয়া ঘি, ভিআইপি স্পেশাল গাওয়া ঘি, এপি-ওয়ান গাওয়া ঘি, টেস্টি গাওয়া ঘি ও হোমল্যান্ড গাওয়া ঘি, বাঘাবাড়ি ঘি, কোহিনুর ঘি, মিল্ক ক্যারি ঘি, গোল্ড ঘি, এ-ওয়ান গাওয়া ঘি, কুকনি গাওয়া ঘি, সূর্যমুখী, রাণী ঘি-সহ ডাবর গাওয়া ঘি।

বর্তমানে নকল ঘির দাপট ও চটকদার বিজ্ঞাপনের কাছে হার মানছে বিক্রেতা ও ভোক্তারা। ফেনী শহরের বড় বাজারের বণিক স্টোর, মেসার্স মা ট্রেডার্স, রহিম এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স ভূঞা এন্টারপ্রাইজ, মিতালী চা বিতান, রাম ভান্ডার, মহসিন ব্রাদার্সসহ অনেকগুলো দোকানে ভেজাল ঘি দেদার বিক্রি হচ্ছে। নকল-ভেজাল ঘি বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৯০০ টাকায়। আবার কিছু কিছু ২৮০ থেকে ৫৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে ফেনী শহরের লালপুলে দাগনভূঞা উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের আবুল বশরের ছেলে আনোয়ারের কারখানায় নকল ঘি কৌটায় লেখা রয়েছে আধুনিক ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে গাভীর খাঁটি দুধের ক্রিম দিয়ে তৈরি শাহী স্পেশাল গাওয়া ঘি। এগুলোর মূল্য ৮৫০ টাকা। কিন্তু কারখানায় ঘি তৈরির চিত্র দেখলে ক্রেতারা স্পেশাল ঘি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। অথচ ক্রেতা আকৃষ্ট করতে সরকারি রেজিস্ট্রি নাম্বার ব্যবহার করা হয়েছে। লোগো ব্যবহার করা হয়েছে বিএসটিআইয়ের।

শাহী স্পেশাল গাওয়া ঘি, অভি স্পেশাল গাওয়া ঘি, ভিআইপি স্পেশাল গাওয়া ঘি এগুলো লালপোলে তৈরি করে আনোয়ারসহ কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। ঘির কৌটার গায়ে ব্যবহার করছেন নোয়াখালির চৌমুহনী বিসিকের ঠিকানা। অথচ লালপুলে গোপনে বিশাল কারখানায় তৈরি হচ্ছে।

ঘি তৈরির মূল উপাদান খাঁটি গরুর দুধ হলেও এসব ঘি তৈরি হচ্ছে দুধ ছাড়াই। একইভাবে এপি-ওয়ান গাওয়া ঘি, টেস্টি গাওয়া ঘি ও হোমল্যান্ড গাওয়া ঘি তৈরি করেন ফেনীর সদর উপজেলার ধর্মপুরের ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আজহারুল হক আরজুর বড় ভাই স্বপনও।

এ-ওয়ান ঘির এজেন্ট বড় বাজারের নারিকেল পট্টির রামভান্ডার। এসব নকল ঘি ব্যবসা করে রাতারাতি কোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছেন তারা। সরকারও হারাচ্ছে কোটি টাকার রাজস্ব।

নোয়াখালীর আবদুল মালেক মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক অসীম কুমার সাহা জানান, ভেজাল ঘি নিয়মিত খেলে ধীরে ধীরে কিডনি অকেজো হবে। এছাড়া  যেকোনো বয়সে ব্রেইন স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ফেনীর সিভিল সার্জন মো. আবদুল মোমিন জানান, ভেজাল ঘি রোধে শিগগিরই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।

জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুজজামান ফেনীর জানান, ভেজাল ঘির কারখানায় অভিযান পরিচালনা করার জন্য অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads