পবিত্র সরকার
ভাষা আর উপভাষার পার্থক্য নিয়ে অনেকেরই মধ্যে কিছু সংশয় আছে। কাকে বলে ভাষা, তাহলে আর উপভাষা কী? এ নিয়ে ভাষাবিজ্ঞানীরা মোটামুটি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, যে-ভাষার নানা উপভাষার মধ্যে বোধগম্যতার একটি ভিত্তি আছে এবং পরস্পরের স্থানীয় বচনের ভিন্নতা সত্ত্বেও আদান-প্রদানে ও উক্তি-ব্যবহারে কোনো অসুবিধা হয় না, সেই উপভাষা সমষ্টিই হলো ভাষা।
এই পারস্পরিক বোধগম্যতার নানা রকমফের আছে। দুটি উপভাষার লোক প্রত্যেকে নিজের নিজের উপভাষায় কথা বলবে। দুজনে দুজনকে স্বচ্ছন্দে বুঝবে—এমন নাও হতে পারে। ধরা যাক চীনা ভাষার কথা। সে দেশে অন্তত চারটি উপভাষা আছে চার অঞ্চলে—তারা একে অন্যের উপভাষা বুঝতে পারে না বললেই হয়। কিন্তু যেটি মান্য বা স্ট্যান্ডার্ড উপভাষা, সেটি সবাই বোঝে, কারণ তাতে রেডিও চলে, খবরের কাগজ বেরোয়। টেলিভিশনে তা বলা হয়। বই লেখা হয়। আর চীনের ক্ষেত্রে যেটা বিশেষ দ্রষ্টব্য তা হলো তার লিপি। এই লিপি সবাইকে লিখতে হয়। সবাই বোঝে। এই লিপির মূলে আছে ছবি। মানুষ বলতে যে সরল ছবিটি আঁকা হয়, তা চীনের কোণে কোণে মানুষই বোঝায়, তার নাম যে যা বলুক। এর তুলনা খানিকটা হতে পারে ইংরেজি ও বর্ণটি। এটি বাঙালিরা বলবে ‘এক’, ইংরেজি বলবে ‘ওয়ান’, ফরাসি বলবে ‘আঁ’ বা ‘য়্যুন’, পারস্যের লোক বলবে ‘ইয়েক্্’, আবার তেলুগুভাষী বলবে ‘অকোটি’—কিন্তু সবাই বুঝবে ‘এক’; চীনের লিপি তার সব উপভাষাকে এক বন্ধনে, এক ভাষার বন্ধনে বেঁধে রেখেছে। এ নিয়ে কানো কোনো অভিযোগ নেই। সেখানে সব উপভাষার লোক মান্য বেইজিং-এর উপভাষাকে বোঝে, সর্ব চীনীয় লিপিকে বোঝে ও ব্যবহার করে এবং তাদের ভাষার প্রতিনিধি হিসেবে দুটিকেই গ্রহণ করে।
বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও দেখি মেদিনীপুরের লোক সিলেট, নোয়াখালী বা চট্টগ্রামের উপভাষা বোঝেন না। কিছু উপভাষা অন্য ভাষার প্রান্তে থাকলে দুয়ের মিশ্রণে তার বেশ ভিন্ন চেহারা দাঁড়ায়। চট্টগ্রাম ও সিলেটের উপভাষা কিংবা মেদিনীপুরের কাঁথির ওড়িশা সীমান্তবর্তী উপভাষা অনেকটা এই কারণেই অন্যদের কাছে দুর্বোধ্য, তার অর্থ এই নয় যে, সেগুলো বাংলা নয়। বা তারাও এমন মনে করেন না যে সেগুলো অন্য ভাষা। যদি কেউ অন্য মনে করেন তার কারণ বিজ্ঞানে নেই, আছে সংকীর্ণ রাজনীতিতে। আমরা বিজ্ঞান নিয়েই কথা বলব, রাজনীতি নিয়ে নয়। আমরা লক্ষ করব, উপভাষা উপভাষার মধ্যে পরস্পরকে বোঝার সম্পর্ক না থাকলেও তাদের আলাদা ভাষা বলে দাবি ওঠে না—যেমন চীনে। আবার যদি সেই বোঝবার সম্পর্ক একমুখী হয়, অর্থাৎ চট্টগ্রামী উপভাষার ক্ষেত্রে, সেখানকার লোক মান্য ভাষা বোঝেন ও ব্যবহার করেন; কিন্তু অন্য অঞ্চলের লোকেরা তাদের ভাষা ততটা বোঝেন না—তা সত্ত্বেও চট্টগ্রামের মানুষেরা কখনোই মনে করেন না তাদের ভাষা অন্য ভাষা। বা তার ভিত্তিতে ভিন্ন রাজ্যের দাবি তোলেন না। ভাষার অনেক উপভাষা থাকে। তার মধ্যে কোনটি মান্য বা আদর্শ ভাষা হয়ে ওঠে, সেটা ঐতিহাসিক যোগাযোগে ঘটে। হয়তো সেটা রাজধানীর ভাষা—সেখানে নানা অঞ্চলের লোকে এসে ব্যবসা-বাণিজ্য করে, শিক্ষা নেয়। প্রশাসন সেই উপভাষা ব্যবহার করে। ফলে কালক্রমে সেটি মান্য ভাষা হয়ে ওঠে। এইভাবে কলকাতার পাশাপাশি দু-একটি অঞ্চলের উপভাষা একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মান্য উপভাষা হয়ে উঠেছিল।
মান্য উপভাষাও উপভাষা। কিন্তু এটির বৈশিষ্ট্য হলো যে তা-(১) কোনো অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়, অর্থাৎ সকলেরই ব্যবহার্য উপভাষা। (২) তা সমাজের বিশেষ কোনো শ্রেণিতেও সীমাবদ্ধ নয়। শিক্ষিত, নিরক্ষর, মধ্য শিক্ষিত, ছাত্র, শ্রমিক সকলকেই কোনো না কোনো ভাবে, কোনো না কোনো সময়ে, মান্য উপভাষা ব্যবহার করতে হয়। (৩) তার ব্যবহার ব্যাপকতর। অর্থাৎ তার লিখিত মৌখিক দুই রূপেই তা বেতার, দূরদর্শন, খবরের কাগজ, পাঠ্যবই, গল্প-উপন্যাস রচনা ইত্যাদিতে ব্যবহূত হয়।
তাই বলে এই মান্য উপভাষা বা সাধারণ উপভাষা কি অন্যান্য উপভাষার চেয়ে মর্যাদায় উঁচু? ভাষাবিজ্ঞান এ ধরনের কোনো পৃথক মর্যাদা কোনো উপভাষার জন্য স্বীকার করে না। ভাষাবিজ্ঞান বলে, যে-কোনো উপভাষা ইতিহাসের নানা সহায়তা পেলে মান্য উপভাষা হয়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ সম্ভাবনার দিক থেকে যেমন পৃথিবীর সমস্ত মানবশিশু এক, তেমনই সম্ভাবনার দিক থেকে সমস্ত উপভাষা আর ভাষাও এক। কেউ উঁচু নয়, কেউ মাঝারি নয়, কেউ নিচু নয়।
ফলে অমুক উপভাষা যথেষ্ট উন্নত নয়, বিজ্ঞানসম্মত নয়, সুন্দর নয়, সুশ্রাব্য নয়—এসব কথা অবৈজ্ঞানিক। যদি তথাকথিত শিক্ষিত ভদ্র লোকদের এমন ধারণা থাকে যে, আমরা যে উপভাষা বলছি তাই উন্নত, সুন্দর, যুক্তিসঙ্গত—সে ধারণা একেবারেই ভ্রান্ত। এটা এক ধরনের সামাজিক অবিচারের জন্ম দেয়, যার ফল সকলকেই ভোগ করতে হয়। কোচবিহারের উপভাষা বা রাজবংশীদের উপভাষা সম্বন্ধে এ জাতীয় কোনো ধারণা থাকলে তা অবিলম্বে পরিত্যাজ্য। কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষিতের ভাষা সমৃদ্ধ হতে পারে, তার প্রকাশের ক্ষমতা যুগোপযোগী হতে পারে, কিন্তু যে-কোনো উপভাষার সুযোগ হলে এই সমৃদ্ধি আসতে পারে।
ভাষাবিজ্ঞান বলে, Language is a political notion. অর্থাৎ কোনো একটি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রাজ্য, রাষ্ট্র ইত্যাদির সমর্থন যে মান্য উপভাষার পেছনে থাকে সেটিই ভাষার পরিচয় পায়। বলা বাহুল্য, ভাষার এ পরিচয় আংশিক। মান্য এবং অ-মান্য (non-standard) সমস্ত উপভাষার সমষ্টিই হলো ভাষা।
ভাষা পৃথক কি না তার অনেক পরীক্ষা আছে। যে ভাষা থেকে আমি আমরা ভাষাকে পৃথক বলে দাবি করছি, তা কোনদিকে কতটা পৃথক? মান্য ভাষায় শব্দের যে চেহারা আমার উপভাষায় ওই শব্দগুলোর চেহারা কতটা আলাদা? মান্য উপভাষায় শব্দ তৈরির যা নিয়মকানুন আমার ভাষায় শব্দ তৈরির নিয়মকানুন তা থেকে কতটা আলাদা? মান্য উপভাষায় বাক্য তৈরির নিয়মকানুন আমার উপভাষায় বাক্য তৈরির নিয়মকানুন তা থেকে কতটা আলাদা? মান্য উপভাষার লোকের কাছে আমার ভাষা কতটা দুর্বোধ্য, কতটা সুবোধ্য? আমার উপভাষা যে আলাদা ভাষা, সে দাবি আমি বিজ্ঞানের দ্বারা প্রতিষ্ঠা করতে চাই, না রাজনীতি নিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
কোনো ভাষাবিজ্ঞানী তথাকথিত ‘কামতাপুরী’র পৃথক ভাষার দাবি, বিজ্ঞানের বিবেচনার ভিত্তিতে স্বীকার করতে পারেন না। কী ধ্বনিগত, কী পদগঠনগত, কী বাক্যনির্মাণগত—কোনো তফাতই এমন বিপুল নয় যাতে ‘কামতাপুরী’কে আলাদা ভাষারূপে স্বীকার করা যেতে পারে। এ বিষয়ে যারা দাবি করছেন তারা যদি বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা করতে চান, তার ব্যবস্থা করা যেতেই পারে। তারা যদি প্রস্তুত থাকেন বাংলা আকাদেমি তার অয়োজন করতেই পারে। কিন্তু কেবল রাজনীতির সুবিধার জন্য একটি উপভাষাকে ‘ভাষা’ বলে দাবি করা এবং সেই অলীক, অপ্রমাণিত দাবির ভিত্তিতে রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য আন্দোলন করা, এর মধ্যে বিজ্ঞানের প্রতি কোনো স্বীকৃতি নেই।
পরবর্তীকালে এই তাত্ত্বিক আলোচনার ভিত্তিতে ভাষার নানা তথ্য অনুপুঙ্খ নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।
শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক