মুক্তমত

ভালোবাসা দিবসের আড়ালে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস

  • অরণ্য সৌরভ
  • প্রকাশিত ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। কথা বলে আজীবন। প্রতিদিনকার উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পায়, যা কিছু ভালো, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার অভিশাপ-আশীর্বাদ। তাই ইতিহাস সর্বস্তরের মানুষের কাছে ভিন্নধর্মী গুরুত্ব বহন করে চলে। প্রজন্মের পর প্রজন্মের অপসংস্কৃতির চর্চার জাঁতাকলে আলোড়িত ইতিহাসকে খানিকটা ম্লান করা গেলেও কখনো ধূলিসাৎ করা যায় না। ইতিহাস সব সময় চিরতরুণ, শিরদাঁড়া দাঁড় করিয়ে হাসতে থাকা যুবক। ইতিহাস যুগ থেকে যুগান্তরে বেঁচে থাকে, কখনোই মরে না। সাময়িকভাবে ইতিহাসের আলোকে মেঘের আড়াল করা গেলেও শেষ পর্যন্ত জয় ঐ আলোরই। নতুন প্রজন্মকে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে উচ্চ শিরজাগানিয়া ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ নামে একটি দিন বিদ্যমান রয়েছে, তা সম্পর্কে জানতে হবে। নিজেকে উজ্জীবিত করতে হবে যে-কোনো পরাশক্তির বিরুদ্ধে। ভালোবাসা দিবসের বিস্মরণের অতলে হারালেই কি ইতিহাসের ধ্রুব সত্যকে ডুবানো যায়? বাংলাদেশের সামরিক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এক বিস্ময়জাগানিয়া চরিত্র। পৃথিবীর কোনো স্বৈরশাসকই তাদের দেশ ও মানবতাবিরোধী অতীত অপকর্মের জন্য বিনা বিচারে পার পেয়ে যায়নি। কিন্তু পার পেয়েছে এরশাদ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে এবং বাংলাদেশের সংবিধান রহিত করে সাত্তারের জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রিসভা বাতিল ঘোষণা করেন। একই সাথে তিনি নিজেকে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করে সামরিক আইনে জারি করা সব বিধিবিধান ও আদেশকে দেশের সর্বোচ্চ আইন হিসেবে ঘোষণা করেন। এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। সেখানে প্রথম শ্রেণি থেকেই আরবি ও দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য মাপকাঠি করা হয় মেধা অথবা পঞ্চাশ শতাংশ ব্যয়ভার বহনের ক্ষমতা। এটি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয় এবং তারা ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু করেন। শিক্ষার্থীদের তিনটি দাবি ছিল-১. মজিদ খানের গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল, ২. সব ছাত্র ও রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তিদান, ৩. সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এই তিনটি দাবির ভিত্তিতে ছাত্রসমাজ সংগঠিত হতে থাকে। এর মধ্যে ৩ নভেম্বর জেল হত্যা দিবসে ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করার চেষ্টা করলে পুলিশি দমন-পীড়নের মুখে সেটা আর হয়ে ওঠে না। তারপর ৭ নভেম্বর জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগ একটি মিছিল বের করলে সেই মিছিলের সাথে পুলিশের হাঙ্গামা হয় এবং সেই মিছিল পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। সেই মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ সেদিন লাঠিচার্জ, গুলিবর্ষণ ও টিয়ারগ্যাস ব্যাবহার করে। টিয়ারগ্যাসের আঘাতে ও লাঠিচার্জের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকসহ অসংখ্য শিক্ষার্থী আহত হয়। এই ঘটনা সারাদিন চলতে থাকে এবং সন্ধ্যার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে সামরিক সরকারের একটি সমঝোতা হয় যে পুলিশ বিনা অনুমতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আর কখনো প্রবেশ করবে না। এই শর্তের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শান্ত হয়। তিন দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ১১ জানুয়ারি ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সমাবেশ ও সচিবালয় অভিমুখে মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। কিন্তু ১১ জানুয়ারি সকালে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী যখন বটতলায় সমবেত হয়েছে তখন কেন্দ্রীয় নেতারা, যারা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নেতা ছিলাম তাদের (ঘরোয়াভাবে) ডেকে বললেন, অনিবার্য কারণবশত আজকের কর্মসূচি পালন করা যাবে না। যখন তারা প্রশ্ন করলেন, কেন? কী সেই অনিবার্য কারণ? নেতারা একান্তে বললেন, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন প্রস্তুত নয়। এরপর পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি। সেই ১৪ ফেব্রুয়ারিতে বটতলায় সামরিক স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ও জীবন বাজি রেখে সমাবেত হয়েছিল লক্ষাধিক ছাত্র-জনতা। সেখান থেকেই সচিবালয় অভিমুখে শুরু করে শান্তিপূর্ণ মিছিল। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর শান্তিপূর্ণ মিছিলটি হাইকোর্টের গেটের সামনে ব্যারিকেডের সামনে বসে পড়ে এবং ছাত্রনেতারা তারের ওপর উঠে বক্তৃতা শুরু করে। এ সময় পুলিশ বিনা উসকানিতে তারের এক পাশ সরিয়ে রায়ট কার ঢুকিয়ে দিয়ে রযিন গরম পানি ছিটাতে থাকে, বেধড়ক লাঠিচার্জ, ইট-পাটকেল ও বেপরোয়া গুলি ছুড়তে শুরু করে। গুলিবিদ্ধ হয় জয়নাল। এরপর গুলিবিদ্ধ জয়নালকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়। এ সময় দীপালিও গুলিবিদ্ধ হন এবং পুলিশ তার লাশ গুম করে ফেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিহত ও আহতদের অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে নিয়ে আসতে চাইলে ঘটনাস্থলে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ বাহিনী। কিছু না ঘটা সত্ত্বেও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে, এমন অপপ্রচার চালিয়ে সামরিক সরকার উসকে দেয় পুলিশকে। সরকারি হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয় ১,৩৩১ জন ছাত্র-জনতাকে, বাস্তবে এই সংখ্যা আরো বেশি ছিল। খোঁজ মেলেনি অনেকেরই। সেই থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি হয়ে ওঠে মুক্তিকামী মানুষের প্রতিরোধ চেতনার দিন। এভাবেই দিনটি ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’র পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেয়। সেই সময়কার শিক্ষার্থী-জনতার রক্তের ধারাবাহিকতায় যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল নয় বছর সংগ্রামের পর ডা. মিলনের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দেন ও অনানুষ্ঠানিকভাবে এরশাদের পতন হয়। আর আনুষ্ঠানিকভাবে ৬ ডিসেম্বর এরশার সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন ও বাংলাদেশে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বর্তমান প্রজন্ম সেই আগুনঝরা ইতিহাসের দিনটিকে ভালোবাসা দিবসের অন্তরালে ম্লান করে দিচ্ছে। আমরা চাই রাজনীতিবিদদের মধ্যে নৈতিকতার চর্চা বাড়ুক। মহত্তম চরিত্রের আরাধনা করুক সবাই। ছাত্রসংগঠনগুলো দলীয় লেজুড়বৃত্তির বাইরে এসে তাদের আগের শক্তিমত্তা ফিরে পাক। অন্যায় প্রতিরোধে তরুণ প্রজন্ম বা ছাত্রসমাজ যেন সর্বদাই জেগে ওঠে এই মাতৃভূমির ক্রান্তিলগ্নে তেমন মনোভাব নিয়ে সর্বদা প্রস্তুত থাকুক। আমরা আমাদের অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সামনে এনে, শহীদদের স্মরণ করে, এই প্রজন্ম নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে যাই। এই হোক ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ ও ভালোবাসার দিনের শপথ।

 

 

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads