আকিজ মাহমুদ
১৯৬২ সালে সীমান্ত নিয়ে বিরোধের জেরে ভারত-চীনের মধ্যে প্রথম সীমান্তযুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে ভারত চীনের কাছে পরাজিত হওয়ার পর থেকেই সীমান্ত ইস্যুতে চীন বরাবরই ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক। যার সর্বশেষ প্রমাণ হচ্ছে, ২০২০ সালে লাদাখের বিতর্কিত ভূমিকে কেন্দ্র করে চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনার পারদ চরমে ওঠা। দুটি দেশই একে অপরকে দোষারোপ করলেও মূলত চীনের দুটি নীতি এসব খণ্ডযুদ্ধের মাধ্যমে প্রকাশ ঘটে- এক. চীন বরাবরই ভারতের অভিযোগ অস্বীকার করে এবং পতাকা বৈঠক বা সীমান্তে নিরাপত্তা ইস্যুতে সমাধানে বসতে রাজি থাকে। এর মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলে বিশ্বে প্রচারিত হতে থাকে। দুই. ভারতের নীরবতার সুযোগে চীন বারবার ভারতকে যুদ্ধ বাধানোর জন্য নানাভাবে উসকে দেয়। যার প্রমাণ, ভারতের অন্তত ১০ কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে হামলার পর চীন কর্তৃক গালওয়ান উপত্যকার ওপর নিজেদের সার্বভৌমত্ব দাবি করা।
এই কৌশলগুলো অবলম্বনের মাধ্যমে চীন মূলত করোনাভাইরাস যে চীনের ল্যাবে তৈরি করা ভাইরাস বলে আমেরিকা চীনকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করেছিল, সেই অভিযোগ থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতেই চীন ভারতের সাথে স্বল্প সময়ের জন্য সীমান্ত বিতর্কে জড়িয়ে পড়তে চাচ্ছেন এমনটাই ধারণা আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ মহলের। কেননা বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনের নিজ স্বার্থের জন্যই ভারতের সাথে যুদ্ধে জড়ানোর কোনো প্রয়োজন এই মুহূর্তে নেই। আপাতত চীন চাইছে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনা বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে চীনা পণ্যের বাজার আরো বৃদ্ধি করতে। একই সাথে দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আকর্ষণীয় বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশগুলো চীনা বলয়ের আওতায় আনতে।
আঞ্চলিক রাজনীতির যে প্রতিযোগিতা চীন এবং ভারতের মধ্যে শুরু হয়েছে তা মূলত শুধু সীমান্তকে কেন্দ্র করেই নয়। উন্নয়নশীল দুটি দেশই বর্তমানে বাণিজ্য ক্ষেত্রকে অধিকতর প্রাধান্য দিচ্ছে। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষের আবাসস্থল চীন এবং ভারত। তাই বাণিজ্যিক বাজার বিবেচনায় কোনো দেশই পরস্পরকে ছাড়তে নারাজ। যে কারণে আমরা লক্ষ্য করছি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের চাইতে চীনা বাণিজ্যিক রাজনীতির মডেল ভারতও আয়ত্ত করতে চাইছে। আর এজন্যই আমরা দেখেছি চীন-ভারত যুদ্ধের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও কেবল একে অপরকে দোষারোপ করেই গায়ের জ্বালা মিটিয়েছে।
২০১৮ সালে ভারত ও চীনের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। কিন্তু ভারসাম্য একচেটিয়া ভারতের বিপক্ষে ছিল। সে বছরই বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। তবু ভারত সরকার সীমান্ত উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে জনগণের দাবির মুখে কেবল চীনা সফটওয়্যার বন্ধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে, এতে করে বড় ধরনের বাণিজ্যের পরিবর্তন ঘটেনি দেশ দুটিতে। উল্টো ২০২০ সালে করোনাকালীন সময়েও দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
কিন্তু আঞ্চলিক স্বার্থরক্ষায় দেশ দুটি পরস্পর মুখোমুখি অবস্থানে; ভারত এক্ষেত্রে আমেরিকান সান্নিধ্য লাভ করছে মূলত চীনকে বিশ্ব নেতৃত্বের মসনদ থেকে দূরে রাখার আমেরিকান কৌশলের কারণে। ভারতকেন্দ্রিক সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যে পররাষ্ট্রনীতি, তার খুব বেশি হেরফের করবে না বাইডেন প্রশাসন এমনটাই ধারণা বিশেষজ্ঞদের। বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্প আমেরিকাকে যে সংকটে ফেলে দিয়েছেন, সেই অবস্থান থেকে বিশ্ব নেতৃত্বের স্বপ্ন দেখা চীনকে পরাস্ত করতে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতই হতে যাচ্ছে আমেরিকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অংশীদার।
আঞ্চলিক রাজনৈতিক কারণে ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। এবং এটাই সত্য যে ভারতের এই আঞ্চলিক রাজনীতি বাংলাদেশের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা বাংলাদেশ বারবার স্মরণ করে থাকে। বাংলাদেশের প্রায় তিন দিক ঘিরে ভারতের অবস্থান হওয়ায়, বাংলাদেশের জন্য ভারতের যেমন বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব দরকার, ঠিক ভারতেরও বাংলাদেশের অবস্থানকে সম্মান করা দরকার। কিন্তু বিগত কয়েক যুগ ধরে সীমান্ত হত্যা এতটাই উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে যে, বাংলাদেশে ভারতবিরোধী একটি গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং যাদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাণিজ্যের পরিমাণে ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অংশীদার ছিল। কিন্তু ভারতের বিনিয়োগকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার তালিকায় এখন শীর্ষে চীন। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ এসেছে ১৪০ কোটি ডলারের। তবে বিনিয়োগ বাড়িয়ে, বিভিন্ন দেশে ঋণের ফাঁদ তৈরি করছে চীন, এমন অভিযোগও আছে বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বেইজিং ও দিল্লির মধ্যকার এই বৈরিতা থেকে ঢাকা কোনো পক্ষপাতিত্ব অবলম্বন করবে কি না? এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের অবস্থান নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরাকেই যুক্তিযুক্ত মনে করছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বিচরণ সহজ হলে, চীনের নৌ-যোগাযোগ হয়ে উঠবে আরো কার্যকর। আর এজন্যই ভূ-রাজনীতিতে নয়াদিল্লি এবং বেইজিং দুপক্ষের কাছেই ঢাকার কদর বেড়েছে।
ভারত-চীনের দ্বন্দ্ব থাকলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে দুই দেশই বলা চলে বাংলাদেশের বিপক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। চীন রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মধ্যস্থতার কথা বললেও ২০১৯ সালে জাতিসংঘের রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষেই অবস্থান নেয়, ভারত ছিল নিরপেক্ষ ভূমিকায়। ভারতের ভূমিকা নিরপেক্ষ হলেও বাংলাদেশের মানুষের কাছে তা ছিল মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার মতো। চীন খুব চতুরতার সাথে রোহিঙ্গা ইস্যুকে কাজে লাগাচ্ছে; আঞ্চলিক এই সমস্যা সমাধানে চীন মধ্যস্থতার দায়িত্ব নিয়েছে। বাংলাদেশকে যথাযথ সমাধানের কথা বললেও বাস্তবে মিয়ানমার-ঘেঁষা মনোভাব চীনের মধ্যস্থতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে বৈকি! চীনের উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের খবর পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়লেও চীন নানাভাবে এটিকে ধামাচাপা দিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। যদিও মুসলিম দেশগুলো ফিলিস্তিনি এবং রোহিঙ্গাদের মতোই উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়কে নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকে। তারপরও এটাই সত্য যে রোহিঙ্গাদের সমস্যার সমাধানে চীনের একক ভূমিকাই যথেষ্ট।
২০১৯ সালের শেষের দিকের ভারত সরকারের বিতর্কিত নাগরিক নিবন্ধন আইন সংশোধন নিয়ে ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতাদের বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ঢাকাকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলে। এছাড়া হঠাৎ পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করা, ২০১৯ সালে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে ভারতের কিঞ্চিৎ বিরোধিতা, তিস্তাসহ বিভিন্ন আন্তদেশীয় নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সাবলীল সম্পর্ক কিছুটা আস্থাহীন হয়ে পড়েছে। অপরদিকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতেও ধীরে ধীরে চীনের প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এতে করে বেইজিং ধীরে ধীরে দিল্লিকে বন্ধু সংকটে ফেলছে। চীন চাইছে ভারত-চীন ইস্যুতে বাংলাদেশ তার নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখুক। কিন্তু বাংলাদেশের মতো নিঃস্বার্থ বন্ধু ভারত কখনো হারাতে চাইবে না। এজন্যেই দফায় দফায় ভারতের কূটনীতিকরা বাংলাদেশ সফরে এসে বলে গেছেন, ভারতের সাথেই বাংলাদেশ তার নাগরিকদের টিকার আওতায় আনতে পারবে। চীনও পিছিয়ে নেই, তারাও ঢাকাকে বার্তা দিয়ে রেখেছে উপহার হিসেবে বাংলাদেশে চীন উৎপাদিত টিকা প্রথম দফাতেই পৌঁছে দেবে।
চীন-ভারতের এই আঞ্চলিক রাজনীতির দৌরাত্ম্যে বাংলাদেশের প্রাপ্তির অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানিপ্রবাহে চীন ভারতের বিপক্ষে যে নীতির বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে, তার প্রভাব ভাটির দেশ বাংলাদেশেও পড়তে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের কৌশলের দিকেই তাকিয়ে থাকবে, একই সাথে বাংলাদেশ যে কাজটি করতে পারে তা হচ্ছে ভারত-বাংলাদেশে প্রবাহিত নদীগুলোতে পানির ন্যায্য হিস্যা পেতে ভারতের চাপ সৃষ্টি করা।
আঞ্চলিক থেকে বৈশ্বিক রাজনীতি, আধিপত্যের লড়াইয়ের নামে প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্য চলছে বাণিজ্যের লড়াই; যেখানে বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রভাবশালী দেশগুলো বিভিন্ন দেশকে পাশে টানার কৌশলের লড়াইয়ে মত্ত। দক্ষিণ এশিয়ায় যা চীনের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে শুরু হয়েছে। দেখা যাক ভারতের আঞ্চলিক স্বার্থরক্ষা চীনের বিশ্বজয়ের স্বপ্নকে কতটুকু প্রভাবিত করতে পারে। একইসাথে বাংলাদেশ ভারত-চীনের এই লড়াইয়ে কতটুকু ফায়দা তুলতে পারে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়