মুক্তমত

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শারীরিক ও মানসিক যত্ন নিতে হবে

  • প্রকাশিত ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

শাহীন চৌধুরী ডলি

 

 

আজকাল বেশিরভাগ বাবা-মায়ের কিশোর-কিশোরী সন্তান নিয়ে কমন অভিযোগ— সন্তান কথা শোনে না। ডাইনিং টেবিলে বসে পরিবারের সবার সাথে খাবার খায় না। বাসার খাবার গ্রহণে অনীহা এবং বাইরের খাবার বিশেষ করে ফাস্টফুড খেতে পছন্দ করে। অনেকে রাত জেগে অনলাইনে থাকে। সারাক্ষণ কানে থাকে হেডফোন আর চোখ থাকে মোবাইল, ল্যাপটপ বা কম্পিউটারের স্ক্রিনে। ধুমধাম নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়। অনেক সন্তান রাগ সংবরণ করতে না পেরে চিৎকার, চেঁচামেচি করে। এই সমস্যা কেবল আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে কিশোর বয়সের সন্তানদের মধ্যে আচরণের নানা সমস্যা কমবেশি দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশে ২০১৭ সালে পরিচালিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ৫ শতাংশের আত্মহত্যার প্রবণতা আছে। ১১ শতাংশ একাকিত্বে ভোগে, ৮ শতাংশের কোনো বন্ধু নেই। বর্তমানে একক পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে । বাবা-মা ব্যস্ত থাকেন পেশাগত, সামাজিক কিংবা সাংসারিক ব্যস্ততায়। সন্তান নিঃসঙ্গতায় ভোগে যা তার মনোজগতে ভীষণ প্রভাব ফেলে। আজকাল কিশোর-কিশোরীদের বড় অভিযোগ বাবা-মা ওদের বোঝে না।

ছেলেমেয়েরা বয়ঃসন্ধিকালে উপস্থিত হলে নানা সংকট যেন তাদের জেঁকে ধরে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১০-১৯ বছর পর্যন্ত সময়টা কৈশোরকাল। ১০-১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীর মধ্যে মনঃসামাজিক এবং শারীরিক পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। এ সময় বাবা-মায়েরা সন্তানের আচরণ, লেখাপড়া, বন্ধুত্ব, আবেগ ইত্যাদি নিয়ে চিন্তিত থাকেন। কোনো বাবা-মা একটু বেশি নজরদারি করতে চান, যেটা দিনশেষে সন্তানের সামাজিক দক্ষতা বিকাশের অন্তরায় হয়ে যায়। অন্যদিকে কোনো বাবা-মা যদি সন্তানকে অধিক স্বাধীনতা দেন, সেটাও সন্তানকে বিগড়ে দিতে পারে।

ইউনিসেফের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩ কোটি ৬০ লাখ ১০-১৯ বছর বয়সের কিশোর-কিশোরী যা এদেশের মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ। বয়ঃসন্ধির সময়টায় ছেলেমেয়েদের মনে আত্মপরিচয় গড়ে উঠতে শুরু করে। পছন্দ-অপছন্দ, চাওয়া-পাওয়ার ইচ্ছে তৈরি হয়। নিজের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম সম্পর্কে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। এ সময় তারা অনেক নতুন বন্ধুর সাথে মিশে। নতুন নতুন ফ্যাশনের দিকে মনোযোগী হয়। খাবারের প্রতি অনীহা দেখায় এবং কিশোরীরা কম খেয়ে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। এ পর্যায়ে তারা পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। জীবনে গোপনীয়তা বজায় রাখতে চায়। স্নেহ-ভালোবাসার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না। বয়ঃসন্ধিতে শারীরিক পরিবর্তনের কারণে নিজেকে নিয়ে বিব্রত থাকে। বয়ঃসন্ধিতে ছেলেমেয়েদের উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে শারীরিক নানা পরিবর্তন আসে। বয়ঃসন্ধিতে শারীরিক পরিবর্তনগুলো যে স্বাভাবিক, এটা তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে।

এ সময় হরমোনের প্রভাবে আবেগের প্রাবল্য দেখা দেয়। তখন তারা মানসিক ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে যায়। মুড সুইংয়ের কারণে মন-মেজাজ খুব দ্রুত ওঠানামা করে। সন্তানের আবেগ ও উচ্ছ্বাসকে মূল্য দিন।  জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ অনুযায়ী ৭-১৭ বছর বয়সী ১২ শতাংশ শিশু মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। ইউনিসেফের মাতৃ ও কৈশোর স্বাস্থ্যসেবার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের এক বক্তব্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে ৪ শতাংশ ছেলে ও ৬ শতাংশ মেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। ১০ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষের যেকোনো ধরনের মানসিক সমস্যা আছে। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থাকা মানুষদের মধ্যে ৯৪ দশমিক ৪ শতাংশের চিকিৎসার সুযোগ নেই। স্কুলগামী ১-১৪ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ৮৮ দশমিক ৮ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে শাস্তির শিকার হয়। কিশোর-কিশোরীদের মনে এমন অনেক কথা থাকে যা তারা মা-বাবাকে বলতে পারে না। বন্ধুদের সাথে সাক্ষাতে তাদের মধ্যে আনন্দ এবং হাসিখুশি ভাব দেখা যায়। বন্ধুদের সাথে তারা মনের কথা শেয়ার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এবং আনন্দ পায়।

মনোচিকিৎসকদের মতে, কিশোর-কিশোরীর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানে মা-বাবার ও পরিবারের সদস্যদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। সন্তানের মনস্তত্ত্ব বুঝতে হবে। তাদের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হওয়া যাবে না। কোনোভাবেই গায়ে হাত তোলা যাবে না। ছেলেমেয়েরা যা বলবে, তা-ই মেনে নিতে হবে ব্যাপারটা এমন নয়; বরং সন্তানের পছন্দ-অপছন্দ বুঝে, তাদের সম্মানে আঘাত না করে ভালো-মন্দটা বুঝিয়ে বলতে হবে। ছেলেমেয়েদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। তাদের বন্ধুদের সামনে বা অন্যদের সামনে কটু কথা বললে তারা অপমানিত বোধ করে। কারো সাথে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হলে রাগারাগি না করে বিষয়টি নিয়ে তার সাথে আলোচনা করুন। কথা বলার ধরন, কাজ, পরীক্ষার ফলাফল কোনোকিছু নিয়েই তাকে ভাই-বোনের বা বন্ধুদের বা অন্য ছেলেমেয়েদের সাথে তুলনা করা যাবে না। তার বন্ধুদের নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা যাবে না। তাকে সন্দেহ করে তার ব্যাগ চেক করা, মোবাইল চেক করা, লুকিয়ে ডায়েরি পড়া এগুলো একদম করা যাবে না। তাহলে সন্তান বাবা-মায়ের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে অবাধ্য হয়ে ওঠে।

ছেলেমেয়েদের কোনো নিয়মে কঠিনভাবে বেঁধে ফেলাটা অনুচিত। বাবা-মাকে সন্তানের সাথে বন্ধুর মতন মিশতে হবে যাতে সন্তান যেকোনো সমস্যায় অভিভাবককে ভয় না পেয়ে নিজের কথাগুলো শেয়ার করতে পারে। মাদকের নেতিবাচক বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করুন। বাচ্চাদের একটু একটু করে ছাড়তে হবে। এতে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠবে। কৈশোরে ভালো মানসিক বিকাশ গঠনের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সামাজিক সংগঠনের সচেতন ভূমিকা পালন করতে হবে। লেখাপড়াসহ বিভিন্ন কারণে সন্তানের স্ট্রেস বা মানসিক চাপ তৈরি হতে পারে। তার স্ট্রেস কমাতে সুস্থ বিনোদনচর্চা, গুণগত পারিবারিক সময়ের প্রয়োজন। গান, নাচ, বই পড়া, বেড়াতে যাওয়া, খেলাধুলার মতন সুস্থ বিনোদনচর্চার মাধ্যমে এবং পারিবারিকভাবে সময় কাটানোর জন্য তাকে উৎসাহিত করুন। 

সন্তান যেন যৌন নিগ্রহের মুখোমুখি না হয়, আবার যেন নিজে যৌন নিপীড়ক হয়ে না ওঠে, সেজন্য তাকে তার বয়স অনুযায়ী বিজ্ঞানসম্মত যৌনতা নিয়ে কথা বলুন। আমাদের মনে রাখতে হবে, যৌন বিষয় না জেনে কোনো সন্তান কখনোই বড় হয়ে উঠবে না। কোনো না কোনোভাবে সে জানবেই। অবৈজ্ঞানিক আর বিকৃত পর্নোগ্রাফির ওয়েবসাইট বা অশিক্ষিত কারো কাছ থেকে এসব বিষয়ে জানার আগেই আপনি বিজ্ঞানসম্মতভাবে সন্তানের কাছে ব্যাখ্যা করলে সে নিরাপদ থাকবে। বন্ধুরা হয়তো মাদক গ্রহণের জন্য চাপ দেবে। মাদক নিতে অস্বীকার করলে তাকে খ্যাত উপাধিতে আখ্যায়িত করবে। সন্তানকে বুঝিয়ে বলুন অপছন্দের বিষয়ে ‘না’ বলতে পারাটাই স্মার্টনেস।

সন্তানকে রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি, চারপাশে যা ঘটছে সেসব ভাবনা থেকে দূরে রাখবেন না। সেগুলোর ভালো-মন্দ সব তাকে জানতে দিন। তার সঙ্গে আলোচনা করুন। বাবা-মায়ের উচিত পরিবারের সবার প্রতি সম্মান দেখানোর চর্চা করা। পরিবারের গুরুজন, গৃহকর্মী, দারোয়ান, মালি, ড্রাইভার কারো সাথে তাচ্ছিল্য ব্যবহার করবেন না। নারী সদস্যদের প্রতি এমন আচরণ করুন যাতে আপনার কিশোর ছেলেটি তা থেকে ভালো শিক্ষা পায়। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে মানুষ ভাবতে শেখান। অন্য ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে শেখান।

ইউনিসেফের মতে, বাংলাদেশে বয়ঃসন্ধিতে বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে অপুষ্টিতে ভোগে। তাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে পরিবারকে সচেতন থাকতে হবে। কিশোর-কিশোরী উভয়ের জন্য প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, কার্বোহাইড্রেট, জিংক, আয়োডিন, আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানোর পরামর্শ দেন পুষ্টিবিদরা। অনেক সময় টিনএজ সন্তান খাবার গ্রহণে অনীহা দেখায়, অযথা বেশি রেগে যায়, মাদক গ্রহণ শুরু করে, পশুপাখির প্রতি নির্দয় আচরণ করে, পরিবারের সদস্যদের শারীরিকভাবে আঘাত করে, সারা রাত জেগে থেকে দিনে ঘুমায়। এর সবই মানসিক সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। এই বিষয়গুলো সন্তানের মধ্যে দেখা দিলে প্রয়োজনে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। আগামী দিনের উপযোগী একজন মানবিকবোধসম্পন্ন মেধাবী নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে প্র‍য়োজন সন্তানের শরীর-মনের সঠিক যত্ন নেওয়া।

 

লেখক :  নিবন্ধকার

shaheen.babu1971@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads