বছরের শুরুতেই নতুন বই পৌঁছে গেছে দেশের প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সব ছাত্রছাত্রীর হাতে। কোটি শিক্ষার্থী বছরের প্রথম দিনে হাতে বই নিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরেছে। বছরের প্রথম দিনে নতুন বই পাওয়ার এই রীতি শিশু-কিশোরদের মাঝে আনন্দ, উচ্ছলতা আর উৎসবমুখর প্রেরণার দিন হিসেবে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় বই উৎসব হিসেবে এই দিনটি শিক্ষার জাগরণে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
বলা যেতে পারে এর থেকে নির্মল হাসির উৎস আর দ্বিতীয়টি নেই। ছোট ছোট শিশুরা নতুন বই হাতে নিয়ে আনন্দে ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফেরে। এই দৃশ্যটা সত্যিকার অর্থেই শান্তিদায়ক। অপরপক্ষে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীর হাতে নতুন বই তুলে দেওয়ার আনন্দ অনুভব করেন শিক্ষকরাও। ধর্মীয় উৎসব বাদ দিলে বই উৎসব শিক্ষাঙ্গনে একটি বড় উৎসবে পরিণত হচ্ছে। যেখানে সব ধর্মের সব বর্ণের, ধনী গরিব প্রত্যেকেই নতুন বই হাতে নিয়ে বাড়ি ফেরে। তারা নিশ্চয়ই সেদিন বইটি হাতে নিয়ে দেখে। আমরাও এটা করতাম। বইয়ের কোন পৃষ্ঠায় কী আছে এই আগ্রহের আকুলতায় কয়েকদিন কাটত। এই আনন্দের, উৎসাহের সত্যিই কোনো তুলনা হয় না।
সন্তান যখন নতুন বই নিয়ে খুশিমনে বাড়ি ফেরে, তখন সেই খুশি স্পর্শ করে তার অভিভাবককেও। বার্ষিক পরীক্ষার পর থেকেই দেশের কয়েক কোটি কচি মুখ অপেক্ষা করে নতুন বইয়ের জন্য। সরকারের এই উদ্যোগের ফলে হতদরিদ্র পরিবারকেও এখন আর বছরের শুরুতে বই কেনার দুশ্চিন্তায় পড়তে হয় না। বই কেনার জন্য অর্থ জোগাড়ের চিন্তায় পড়তে হয় না অভিভাবকদের। এটা একটা দেশের জন্য কত বড় ব্যাপার, তা বই পেয়ে হাসিমাখা শিশুদের উচ্ছল মুখ দেখলেই বোঝা যায়।
বাংলাদেশ কতটুকু এগিয়েছে তা দেখতে হলে অনেক বেশি অর্জনের তালিকা সামনে আনার প্রয়োজন নেই। তার চেয়ে বরং বছরের প্রথম দিনে রাস্তাঘাটে তাকালেই চোখে পড়বে সেই উন্নয়নের একটি খণ্ডচিত্র। শিশুরা বই নিয়ে বাড়ি ফিরছে। এত বড় একটা কর্মযজ্ঞ যে করা সম্ভব, তা এর আগে কোনো সরকারই ভাবেনি। কারণ বিনামূল্যে এই কোটি কোটি বই প্রদান সহজ কোনো বিষয় নয়। কিন্তু সেই কঠিন বিষয়টাই সহজ করে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শিক্ষাবান্ধব এই সরকার প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে বছরের প্রথম দিনেই কোটি শিশুর মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলারও সহজ উপায় আছে। আর্থিকভাবে অসহায় কোনো শিশুর মুখে নতুন বই পাওয়ার হাসি অটুট রাখার ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই উদ্যোগ বিশ্বেও প্রশংসা কুড়িয়েছে।
আগেও ছাত্রছাত্রীরা বছরের প্রথম দিনে বই পেয়েছে তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা নতুন নয়, পুরনো। গত বছরের উপরের ক্লাসের ব্যবহার করা কোনো ছাত্রছাত্রীর বই। আমাদের সময়ের কথাই যদি বলি, আমরা রীতিমতো খোঁজ করতে শুরু করতাম পরিচিত কে কে প্রমোশন পেয়ে উপরের ক্লাসে উঠেছে। তার বই চেয়ে, কখনো অল্প দামে কিনে পড়তে শুরু করতাম। ফল প্রকাশের পরপরই আশপাশের বইয়ের দোকানগুলোতে বই কিনতে রীতিমতো হুড়োহুড়ি পরে যেত। এখনকার ছাত্রছাত্রীদের কাছে বিষয়টা রীতিমতো অবাক করার মতো ব্যাপার বটে। একসময় এই ঘটনা কেবল গল্পের মতো মনে হবে। যারা তুলনামূলক পয়সাওয়ালা, তাদের সন্তানদের তেমন কোনো সমস্যা হতো না। কিন্তু যাদের নতুন বই কেনার সামর্থ্য থাকত না, তারা পুরনো বই দিয়েই বছর শুরু করত। এমন হতো যে, দুই-তিনটি নতুন বই বহু কষ্টে কিনে দিতে পারলেও অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর প্রথম দুই তিন মাস সেই দুই তিনটি নতুন বই দিয়েই কেটে যেত। সবগুলো নতুন বই পেতে অনেকেরই বছরের অর্ধেক সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। তাছাড়া সে সময় সৃজনশীল পদ্ধতি ছিল না বিধায় পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি গাইড বা নোটবই কিনতে হতো। আমার মতো যাদের নতুন বই কেনার সামর্থ্য ছিল না, তারা আশপাশের উপর ক্লাসের বই মাস দুয়েক আগেই বলে-কয়ে রাখতাম। এই পুরনো বইও আবার নতুন বইয়ের এক-তৃতীয়াংশ দাম দিয়ে কিনতে হতো। তবে পুরনো হলেও আমাদের কাছে তা ছিল নতুন। আর সেই বইয়ের আকর্ষণ আজকের নতুন বইয়ের থেকে কম ছিল না। এদিক থেকে আজকে একটি শিশু আমাদের থেকে অনেক সৌভাগ্যবান। প্রতি বছর অন্তত সে নতুন বই হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারে।
বই ছাপা নিয়ে অনিশ্চয়তা ও বিতর্ক থাকলেও নতুন বই কয়েক কোটি শিশুর হাতে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি কয়েক বছর ধরে বেশ ভালোভাবেই সম্পন্ন করার সফলতা দেখিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ বছরও উৎসবমুখর পরিবেশে সারা দেশে বই বিতরণ হয়েছে। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, যে উদ্দেশ্যে বই দেওয়া হয়, সেই উদ্দেশ্যটা যেন পূরণ হয়। অর্থাৎ বই দেওয়া হয় পড়ার জন্য। অথচ আমরা আজো সেই গাইড বই নির্ভর রয়ে গেছি। মূল বই পড়ার প্রতি আগ্রহ আজো আমাদের ছাত্রছাত্রীদের কম। আমাদের ছেলেমেয়েরা আজো নতুন বইয়ের সঙ্গে সঙ্গে খোঁজ করে গাইড বই। অনেক সময় স্কুলের শিক্ষকরা নিজেরাই বই কেনার জন্য ছাত্রীদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, গাইড বই থেকে কমন থাকার কোনো সুযোগ নেই সৃজনশীল পদ্ধতিতে। প্রশ্ন হলো, তারপরও কেন গাইড বাণিজ্য থামছে না।
কথা হলো, দেশে গাইড বই নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও চোখের সামনে কী করে বিক্রি হচ্ছে এসব বই? গতানুগতিক প্রশ্ন পদ্ধতির পরিবর্তে দেশে কয়েক বছর আগেই চালু হয়েছে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি। এখন গাইড থেকে সরাসরি কিছু কমন পড়ে না। তারপরও কীভাবে যেন গাইড বইগুলো তাদের গাইডের সঙ্গে প্রশ্নের কমন পড়ার বিষয়টি যোগ করে প্রচারণা চালায়। তাই এই আনন্দ উৎসব ও উৎসাহ নিয়ে যে বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে, তার উদ্দেশ্য যেন পূরণ হয় সেদিকে লক্ষ রাখতেই হবে।
লেখক : সাংবাদিক
sopnil.roy@gmail.com





