ব্যয় বেড়ে দ্বিগুণ হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতু নির্মাণ প্রকল্পের। এই বাড়তি ব্যয়ের পরিমাণ ৭ হাজার ৭২ কোটি টাকা। ফলে এই প্রকল্পের মোট ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১৬ হাজার ৮০৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। প্রকল্প অনুমোদনের সময় এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা। নতুন বাড়তি ব্যয়ের ৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা ঋণ দেবে জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা (জাইকা)। বাকি অর্থ সরকারি খাত থেকে আসবে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, প্রকল্পটি নির্মাণ কাজের মূল্য বৃদ্ধি, নতুন কাজ হিসেবে ভূমি অধিগ্রহণ, ভূমি ও অন্যান্য ফ্যাসিলিটি ভাড়ার সংস্থান, একটি জাদুঘর ও পরিদর্শন বাংলো নির্মাণ, ব্যাংক চার্জ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনেকেশন ওয়ার্কাস ও প্যাকেজ-৩-এর কাজের ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দ্বিগুণ হচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, ২০১৬ সালে প্রকল্পটি যখন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন হয়, তখন এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা। তখন জাইকার ঋণ ছিল ৭ হাজার ৭২৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এখন নতুন করে এই প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে ৭ হাজার ৭২ কোটি টাকা। এই বাড়তি ব্যয় মেটাতে সরকারকে আবারো ঋণ করতে হচ্ছে। বাড়তি ঋণের জন্য জাইকাকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা সম্মত হয়েছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে জাইকা। বাকি টাকা সরকারি কোষাগার থেকে দেওয়া হবে। সব মিলিয়ে এই প্রকল্পের মোট ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১৬ হাজার ৮০৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।
ইআরডির আমেরিকা ও জাপান উইংয়ের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) শহিদুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণ’ প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে। বাড়তি ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে জাইকাকে অবহিত করেছি। তারা বাড়তি ঋণ দিতে সম্মতি জানিয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, সংশোধিত প্রকল্পে ডিজাইন ও সুপারভিশন পরামর্শক খাতে সরকারি তহবিল হতে ২১২ কোটি টাকাসহ মোট ৮১৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা বাড়ছে। আবার সরকারি অর্থে ম্যানেজমেন্ট সাপোর্ট পরামর্শক বাবদ ৫২ কোটি টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবে জমি অধিগ্রহণ, জমি ব্যবহার ও আনুষঙ্গিক ব্যয় বাবদ মোট ৩৪৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি অনুমোদিত মূল প্রকল্প প্রস্তাবে ছিল না।
প্রকল্পের কাজের বেশিরভাগ আইটেমের বিশদ নকশা প্রণীত হয়েছে। এ অবস্থায় প্রাইস ও ফিজিক্যাল কন্টিনজেন্সি বাবদ ১২২ কোটি টাকা অতিরিক্ত প্রয়োজন হচ্ছে। সার্বিকভাবে পরামর্শক খাতে ২৮ কোটি ৪১ লাখ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে, এর কারণ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। এছাড়া অনারিয়াম অব ইমপ্লয়ারসের জন্য ১ কোটি টাকা এবং অনারিয়াম ফর আদারস খাতে ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা প্রয়োজন।
প্রকল্পটি ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে এর অগ্রগতি মাত্র ৯ শতাংশ। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, প্রকল্পটি একনেকে ভিন্নভাবে অনুমোদন করা হয়। এসব প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের আগেই ফিজিবিলিটি স্টাডি, নকশা ও সার্ভে করেই একনেকে উপস্থাপন করা হয়। অথচ এসব কাজ না করেই প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদন করা হয়। ফলে প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি নেই বলা চলে। প্রকল্পটি অনুমোদনের পরেই নকশাসহ অন্যান্য কাজ করতেই কালক্ষেপণ হচ্ছে। ফলে প্রকল্পের অগ্রগতি কম। তবে প্রকল্পের জন্য যে বাড়তি সময় ও বাড়তি ব্যয় চাওয়া হয়েছে এর মধ্যেই প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হবে বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক ও প্রকল্প পরিচালক মো. কামরুল আহসান বলেন, নানা কারণে প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বাড়ছে। এই নিয়ে পিইসি সভাও হয়েছে। যে ব্যয় ও সময় চাওয়া হয়েছে এর মধ্যেই প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত করতে পারব।
প্রকল্পের অগ্রগতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রকল্প গ্রহণের আগেই যেসব কাজ করতে হয় তা প্রকল্প অনুমোদনের পরে করতে হচ্ছে। এভাবেই প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন করা হয়েছে। প্রথমে ছয় মাস ফিজিবিলিটি স্টাডি করেছি ফলে পিছিয়ে পড়েছি। পরামর্শক নিয়োগ করতেও সময় লেগেছে। প্রকল্পের নকশা দেড় বছর, টেন্ডার ফাইনাল ১৬ থেকে ১৭ মাস সময় লেগেছে। এই কাজেই সময় লেগেছে। এগুলো না করে ফিজিক্যাল কাজ করা সম্ভব নয়, ফিজিক্যাল কাজ না করলে অগ্রগতিও সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু দেশের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে দুই অংশকে একত্রিত করেছে। সড়কের পাশাপাশি সেতুটিতে রেল সংযোগও রয়েছে। তবে কচ্ছপগতিতে এগিয়ে চলে ট্রেন। কারণ, ট্রেনের আউটার সিগন্যালিং খাঁচা ভেঙে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। এর আগে কয়েকবার সেতুতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছেন যাত্রীরা। এসব কারণে এবার বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতুতে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারের স্টিল রেলসেতু নির্মাণ করবে রেলপথ মন্ত্রণালয়। বিদ্যমান বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর সমান্তরাল ৩০০ মিটার উজানে নির্মিত হবে সেটি। পদ্মা নদীতে ১ দশমিক ৮ কিমি দৈর্ঘ্যের লালন শাহ সড়ক সেতু ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ রেলসেতু যেভাবে পাশাপাশি অবস্থান করছে, একইভাবে যমুনায়ও বঙ্গবন্ধু সেতু ও রেলসেতু স্থাপন করা হবে।
যমুনায় রেলসেতু নির্মাণ প্রকল্পের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। ২০১৪ সালের মে মাসে জাপান সফরে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সে সময় প্রকল্পটির বিষয়ে দুদেশের মধ্যে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছিল। প্রকল্পের তাৎপর্য ও গুরুত্ব এবং বিদ্যমান বঙ্গবন্ধু সেতুর ঝুঁকি বিবেচনা করে ঋণ দিতে সম্মত হয় জাইকা।
আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধার সমন্বয়ে নির্মিত হবে রেলসেতুটি। বঙ্গবন্ধু সেতু ইস্ট (বিবিই) স্টেশন ও বঙ্গবন্ধু সেতু ওয়েস্ট (বিবিডব্লিউ) স্টেশনে স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলিংকিং (সিবিআই) সিগন্যালিং সিস্টেম থাকবে। সেতু বরাবর গ্যাস ট্রান্সমিশন পাইপলাইনও থাকবে। সেতুটি সম্পূর্ণভাবে নির্মিত হলে উত্তরবঙ্গ, পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের কাছে আশীর্বাদে পরিণত হবে বলেও মনে করছে সরকার।