ঋণ আর খেলাপি ঋণে এখন দিশেহারা দেশের ব্যাংকগুলো। ব্যাংকিং সেক্টরে এখন বিরাজ করছে এক ধরনের হতাশা। গ্রাহকরাও এখন আর ব্যাংকে টাকা রেখে স্বস্তিতে নেই। এই দুঃসময় কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজন ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত আর্থিক খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। শুধু বাংলাদেশ নয়, যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বড় চালিকাশক্তি হলো ব্যাংকিং খাত। এবার আশাব্যঞ্জক হলো, সরকার ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমিয়ে সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে জানিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে তা ক্রমবিকাশমান শিল্পের উন্নয়ন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অগ্রগতি, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গঠনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু হতাশাজনক হলেও এ কথা সত্য যে, ব্যাংকের উদ্যোক্তারা ঋণের সুদ সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা আদায় করে নেওয়ার পর এক বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনো সুদ সিঙ্গেল ডিজিটে নামেনি। তাই সরকারের প্রতিশ্রুতি কতটা ফলপ্রসূ হবে এটা এখন দেখার বিষয়।
‘সমৃদ্ধির সোপানে বাংলাদেশ, সময় এখন আমাদের’ শিরোনামে ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এটি দেশের ৪৮তম এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বাজেট। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অঙ্কের এ বাজেট নিয়ে সারা দেশে এখন সরগরম আলোচনা। সরকারি দলের নেতারা সংসদে ও সংসদের বাইরে প্রস্তাবিত বাজেটের পক্ষে বিরামহীন কথা বলছেন। অন্যদিকে বিরোধী দল অনুচ্চকণ্ঠে হলেও বাজেটের কড়া সমালোচনা করছেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা বাজেট নিয়ে আলোচনা করছেন। কথা বলছেন বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষও। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠন গোলটেবিল আলোচনার মাধ্যমেও তাদের বক্তব্য তুলে ধরছে। সবাই নিজের লাভক্ষতির হিসাব কষছেন।
প্রায়ই দেখা যায়, ব্যাংকগুলো বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ দিলেও ক্ষুদ্র অথবা মাঝারি ব্যবসায়ীরা তা থেকে বঞ্চিত হয়। ডাবল ডিজিটের বড় সুদের বোঝা বহন করা দুঃসাধ্য বিধায় তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতেও ভয় পায়। ফলে সম্ভাবনাময় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতগুলোর উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শিল্পের ক্ষেত্রে যদি সহজ শর্তে সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ পাওয়া যায়, তা অবশ্যই তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্যোগী হতে সহায়তা করবে, ত্বরান্বিত হবে ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ও বিনিয়োগ। সাম্প্রতিক সময়ে ঋণের সুদহার ব্যাংক ভেদে ১২ থেকে ১৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যদিও সরকার ব্যাংকগুলোকে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ এবং ৬ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহের নির্দেশ দিয়েছে; কিন্তু সরকারি ব্যাংকগুলো ছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলো এ নির্দেশমতো কাজ করেনি।
বিশ্লেষকদের মতে, সব সুবিধা ব্যাংকের পরিচালকরাই পাচ্ছেন। নিজেরা ভাগাভাগি করে বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়ার পাশাপাশি এখন সিঙ্গেল ডিজিটেও ঋণ সুবিধা নিতে তারা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। যেসব ব্যাংক সিঙ্গেল ডিজিটে শিল্পঋণ দেওয়ার দাবি করছে, তারা হয়তো তাদের পরিচালকদের এ সুবিধা দিচ্ছে। ব্যাংক পরিচালকদের ঋণ ভাগাভাগির মতো সিঙ্গেল ডিজিটের সুবিধাও এখন ভাগাভাগি হয়ে যাচ্ছে। আর এরা রাজনৈতিকভাবে এতটাই প্রভাবশালী যে, বাংলাদেশ ব্যাংকও এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। সরকার যদি সত্যিই চায় ব্যাংকের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনবে, তাহলে হয় সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে অথবা সব ব্যাংক এবং অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করে আমানত আর ঋণের সুদের হার ঠিক করতে হবে। আবার ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় যদি কমানো যায়, তাদের ব্যবস্থাপনা দক্ষতা যদি আরো বাড়ানো যায়, তাহলে তারা ঋণের সুদের হারও কমাতে পারবে সাময়িকভাবে।
অন্যদিকে, ঋণখেলাপি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের অন্যতম প্রধান সমস্যা। সরকারের ভাষ্যমতে, সর্বত্র ব্যাংকিং সেক্টরে সিঙ্গেল ডিজিট চালু হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। যদিও এটা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে অর্থনীতি অঙ্গনে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। এর ফলে প্রথমবারের মতো অবলোপনের হিসাব বাদে খেলাপি ঋণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেল। গত মার্চ শেষে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৩৩ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। ২০১৮ সাল শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। এখন কথা হচ্ছে, গৃহীত পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকার কী সফল হবে খেলাপি ঋণের হার কমিয়ে আনতে? কেননা বড় খেলাপিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর পেছনে আছে প্রভাবশালী ব্যক্তি অথবা রাজনৈতিক চাপ। বর্তমানে ব্যাংক ব্যবস্থা সম্পূর্ণই রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পরিচালিত হচ্ছে। জবাবদিহি না থাকা, স্বজনপ্রীতি, অদক্ষতা, ব্যবস্থাপনা দিনকে দিন ব্যাংক ব্যবস্থাটিকে করে দিয়েছে স্থবির। ব্যাংক ব্যবস্থায় খেলাপি ঋণের অপসংস্কৃতি একদিনে গড়ে ওঠেনি। ঋণগ্রহীতাদের অনেকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী অথবা প্রভাবশালী কারো সহায়তায় ঋণ পেয়েছে। যে কারণে তারা ঋণ ফেরত না দেওয়ার সুযোগ নিচ্ছে। এতে করে সিঙ্গেল ডিজিট সুদ খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে না। কেননা বড় খেলাপিদের ক্ষেত্রে ০% সুদ ধার্য করা হলেও তারা তা পরিশোধ করবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না ব্যাংক খাতে সুষ্ঠু জবাবদিহিমূলক প্রশাসন, স্বচ্ছ ও কার্যকর মুদ্রানীতি নিশ্চিত হবে। যদিও এটা আমার নিজস্ব মতামত। আর আশাব্যঞ্জক যে সরকার যেহেতু প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ নেওয়া হবে এবং বিদ্যমান ব্যাংক-কোম্পানি আইন সংশোধন করে যুগোপযোগী করা হবে।
আমরা চাই সরকার এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের আস্থা অর্জনে সচেষ্ট হবে। সুতরাং এই বিশালাকার বাজেটকে কাজে লাগিয়ে ব্যাংকিং সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা জরুরি হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে এনে বরং তরুণ উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে স্বল্পমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা করা এখন সময়ের চাহিদাই বলব। এর মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব ক্ষুদ্র শিল্পায়নের পথে দেশ এগিয়ে যাবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। অধিক জনসংখ্যার এই বাংলাদেশে বেকারত্বের হারও কমবে। আমরা মনে করি, ‘সমৃদ্ধির সোপানে বাংলাদেশ, সময় এখন আমাদের’ সরকারের এই স্লোগান তখনই সফলতা পাবে।
কাজী আশফিক রাসেল
লেখক : শিক্ষার্থী, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়