সেনা সমর্থিত জরুরি অবস্থার সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিভিন্² ব্যবসায়ীর কাছ থেকে আদায় করা ৬১৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ফেরত দিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়া নির্দেশ রিভিউ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের করা রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদনের প্রাথমিক শুনানিতে গতকাল মঙ্গলবার এ আদেশ আসে। শুনানির পর আদেশটি দেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির বিভাগের বেঞ্চ। আদালতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম। ব্যবসায়ীদের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রোকনউদ্দিন মাহমুদ, আবদুল মতিন খসরু, আইনজীবী আহসানুল করিম ও খায়রুল আলম চৌধুরী। সরকারপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
২০১৭ সালের ১৬ মার্চ সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ জরুরি অবস্থার সরকারের আমলে বিভিন্² ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নেওয়া ৬১৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংককে ফেরত দিতে নির্দেশ দেন। এ টাকা ফেরতের হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের করা আপিল খারিজ করে ওই রায় দেওয়া হয়েছিল। পরে আপিল খারিজের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
হাইকোর্টের রায়ে এস আলম গ্রুপের সাতটি প্রতিষ্ঠানকে ৬০ কোটি টাকা, দি কনসোলিডেটেড টি এন্ড ল্যান্ডস কোম্পানি লিমিটেড এবং বারাউরা টি কোম্পানি লিমিটেডকে ২৩৭ কোটি ৬৫ লাখ, মেঘনা সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজকে ৫২ কোটি, বসুন্ধরা পেপার মিলস লিমিটেডকে ১৫ কোটি, ইউনিক ইস্টার্ন প্রাইভেট লিমিটেডকে ৯০ লাখ, ইউনিক সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজকে ৭০ লাখ, ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টকে ১৭ কোটি ৫৫ লাখ, বোরাক রিয়েল এস্টেট প্রাইভেট লিমিটেডকে ৭ কোটি ১০ লাখ, ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডকে ৩৫ কোটি এবং ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টি ডেভেলপমেন্টের এক পরিচালককে ১৮৯ কোটি ও ইউনিক ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারের স্বত্বাধিকারীকে ৬৫ লাখ টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেন।
জানা যায়, ২০০৭ সালের এপ্রিল থেকে ২০০৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত একটি গোয়েন্দা সংস্থা এবং তৎকালীন টাস্কফোর্স ইন্টেলিজেন্টস (টিএফআই) কর্মকর্তারা প্রায় ৪০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১ হাজার ২৩২ কোটি টাকা আদায় করেন। এ টাকা দুই শতাধিক পে-অর্ডারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের ‘০৯০০ নম্বর’ হিসাবে জমা হয়।
তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ১৯ এপ্রিল জেমস ফিনলে কোম্পানির কাছ থেকে ১১৭ কোটি ৪১ লাখ টাকা আদায় করে। ওই টাকা ১৬টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের ‘কনসোলিটেড ফান্ডে’ জমা দেওয়া হয়। এরপর ২২ এপ্রিল একই প্রতিষ্ঠানের নামে আরো ১৫টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে ১২০ কোটি ২৪ লাখ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হয়। একই প্রক্রিয়ায় পর্যায়ক্রমে দেড় বছর ধরে বিভিন্² তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের সংশ্লিষ্ট হিসাবে টাকা জমা হয়েছে।
ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পরিচয় ছাড়াও ‘অজানা’ উল্লেখ করেও জরুরি অবস্থায় সরকারের প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা ওই ব্যাংক হিসাবে চার দফায় প্রায় ৪৭ কোটি টাকা জমা দিয়েছেন।
দেশের শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের কাছ থেকে কয়েক দফায় বিপুল পরিমাণ টাকা আদায় করা হয়েছে ওই সময়। ২০০৭ সালের ২৮ মে থেকে ২০০৮ সালের ১১ জুন পর্যন্ত বসুন্ধরা গ্রুপের কাছ থেকে ২৫৬ কোটি টাকা নেওয়া হয়।
২০০৭ সালের ১৯ জুন থেকে একই বছরের ২৭ নবেম্বর পর্যন্ত সিকদার গ্রুপের পরিচালক ও সদস্যদের পক্ষ থেকে পারভীন হক সিকদার বাধ্য হয়ে নয়টি পে-অর্ডারের মাধ্যমে মোট ৪২ কোটি টাকা পরিশোধ করেন বলে অভিযোগ আছে।
ওই আমলে যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম বাবুলের ৩০ কোটি, এমজিএইচ গ্রুপের ২৪ কোটি, বিএনপির সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামালের কাছ থেকে ২০ কোটি, কবির স্টিল মিলস লিমিটেডের সাত কোটি, ব্যবসায়ী নূর আলীর ৪০ কোটি ৫০ লাখ, আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশনের ৩২ কোটি ৫০ লাখ, সাগুফতা হাউজিংয়ের ২ কোটি ৫০ লাখ, হোসাফ গ্রুপের ১৫ কোটি, পারটেক্স গ্রুপের ১৫ কোটি, স্বদেশ প্রোপার্টিজের নয় কোটি, ইসলাম গ্রুপের ৩৫ কোটি, কনকর্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আট কোটি, ব্যবসায়ী রেজাউল করিমের ১৭ কোটি, আবু সুফিয়ানের ১৪ কোটি, শওকত আলী চৌধুরীর ছয় কোটি, আশিয়ান সিটির এক কোটি, পিংক সিটির ছয় কোটি ৪১ লাখ, বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের ১৯ কোটি ৪৫ লাখ, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের ১৫ কোটি, ওয়াকিল আহমেদের ১৬ কোটি, এবি ব্যাংক ফাউন্ডেশনের ৩২ কোটি, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ব্যবসায়িক অংশীদার গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের ২০ কোটি ৪১ লাখ, এলিট পেইন্টের ২৫ কোটি ৪৪ লাখ, এবি ব্যাংকের ১৯০ কোটি, কনকর্ড রিয়েল এস্টেটের সাত কোটি, জনৈক মালিকের কাছ থেকে চার কোটি ও ব্যবসায়ী আবদুল আউয়াল মিন্টুর দুই কোটি ২০ লাখ টাকা নেওয়া হয়।





