‘ভাইরে আল্লায় পোলা বানাইছে। হে-ইতো স্কুলে যাইবে। হ্যার অনেক বড় অওন লাগবে। চরের মাইয়ারা বেশি ল্যাহাপড়া কইরগ্যা কী করবে। বাপ-মায় হেইয়ার লইগ্যা বিয়া দিয়া বাঁইচক্যা গ্যাছে।’—স্থানীয় ৭৩নং চর রায়সাহেব প্রাইমারি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছোটভাই শাওনের দিকে ইঙ্গিত করে বলছিল দুই বোন সুবর্ণা ও সাদিয়া। এ সময় সুবর্ণা সন্তানসম্ভবা আর নবম শ্রেণিতে থাকতেই বিয়ের পিঁড়িতে পা রাখা সাদিয়ার কোলে কান্না করছিল তার এক মাস বয়সী পুত্রসন্তান। কন্যাশিশুর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার সুবর্ণা-সাদিয়া। ওদের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফলের মূল ভূখণ্ড বিচ্ছিন্ন তেঁতুলিয়া পাড়ের চন্দ্রদ্বীপের আলগীর চরে।
আলগীর চরের ব্রিজের নিচে চাচাত বোন পাঁচ বছরের শিশু মারিয়াকে সঙ্গে নিয়ে এসে মই জালে মাছ ধরছিল ৯ বছর বয়সী তামান্না। কাঁধে মইয়া (মই জাল) নিয়ে প্রায়ই ছোটে সে আলগীর খালে কিংবা তেঁতুলিয়ার কূলে। স্থানীয় শিশুদের সঙ্গে মইজাল, খুঁচনি জাল কখনো আবার আঁচলে ছেঁকে মাছ ধরে তামান্না। তিথি অনুকূলে থাকলে বাইলা, ছোট চিংড়ি, পুঁটি, দর্গিসহ বিভিন্ন মাছ ধরা পড়ে আলগীর খালে। নদীর জোয়ার-ভাটার সঙ্গে ক্লাসের সময় মিলিয়ে নিয়ে মাছ ধরে সে। কখনো বৈরী আবহাওয়া কিংবা নদী-খালের বিরূপ আচরণে নামে বিপত্তি। তামান্না বলে, ‘মাছ কিনমু কী দিয়া। বেশি কয়ডা পাইলে খাওন যায়, হেইয়া বেইচক্যা (বিক্রি করে) আবার খাতা-কলম কিননও যায়।’ তামান্না আরো বলে, ‘কয়দিন আগে খালে গাছের গোড়ায় জাল বাইজগ্যা গেছিল। শ্যাষে খুঁডাজাল পাততে আইয়া একজনে ছাড়াইয়া দিছে।’ এ সময় মাছ ধরতে না আসা ধানদী হাই স্কুলের ৯ম শ্রেণির ছাত্র বড় ভাই তোফাজ্জেল হোসেনের কথা জিজ্ঞেস করলে সে বলে, ‘ভাই (তোফাজ্জেল) পোলা (ছেলে) অইয়া মাছ ধরবে ক্যা?’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নদীবেষ্টিত নোনাপানির এলাকা, আধুনিক প্রচার প্রচারণার অভাব, শিশু বিবাহ, অশিক্ষা, কুসংস্কার, অভাবসহ নানা কারণে কমছে না কন্যাশিশুর প্রতি নির্যাতন ও বৈষম্য। বিচ্ছিন্ন এসব চর এলাকার অধিকাংশ শিশুর ভাগ্য যেন সুবর্ণা-সাদিয়ার মতো বাল্যবিয়ে, শিক্ষার অভাব, শিশুশ্রমসহ বৈষম্যমূলক আচরণে আটকে আছে।
বৈষম্যের শিকার হচ্ছে চন্দ্রদ্বীপের চরব্যারেট, চরমিয়াজান, চরওয়াডেল, চর বাসুদেবপাশা, পাঁচখাজুরিয়া, দিয়ারা কচুয়া, চর রায়সাহেব, কিসমত পাঁচখাজুরিয়া, অমরখালী, মমিনপুরসহ বিভিন্ন চরের হাজারোর্ধ্ব কন্যাশিশু। এসব শিশু বাসা-বাড়িতে ঝিয়ের কাজ, মাছ ধরাসহ কৃষিভিত্তিক নানা কাজে জড়িত হয়ে পরিবারের আয়ের সহযোগী হচ্ছে। একটা নির্দিষ্ট সময় পরে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে তারা। বৈষম্যের শিকার এসব হতদরিদ্র পরিবারের কন্যাশিশুরা পরিণত হচ্ছে শিশু মায়ে। এমনকি মৃত্যু হচ্ছে অকালে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে। জন্ম দিচ্ছে আবার পুষ্টিহীন শিশু। চরওয়াডেল এলাকায় এক বছর আগে সন্তান প্রসবকালে মারা যায় লোকমান হাওলাদারের স্ত্রী আমেনা। সন্তানটিও মারা যায় তার জন্মের ২-৩ দিন পর। প্রায় বছরখানেক আগে প্রসবকালে নবজাতকসহ মারা যান জহির নলীর স্ত্রী রুনিয়া বেগম ও মুজাম্মেল হাওলাদারের স্ত্রী মাহিনুর। আমেনা, রুনিয়া, মাহিনুরের মৃত্যুর কারণ হিসেবে অনেকেই দায়ী করছেন বাল্যবিয়েকে।
কালাইয়া গ্রামের জামাল বেপারির মেয়ে মৌসুমি (১৫)। পঞ্চম শ্রেণি পার না হতেই তিন বছর আগে বিয়ে হয় চরমিয়াজানের ভান্ডারী বাজার এলাকার আনোয়ার সিকদারের ১৫ বছর বয়সী ছেলে রাসেলের সঙ্গে। ঘর-সংসার কিংবা জীবন-যৌবন কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক সন্তানের মা হন মৌসুমি।
চন্দ্রদ্বীপের দিয়ারা কচুয়ার চরের মিনারা বেগম উনিশ বছর আগে বৌ হয়ে আসেন দরিদ্র কৃষক ইউনুচ জোমাদ্দারের ঘরে। বয়স তখন তার এগার। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় ডলি নামে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন তিনি। ইউনুচ জোমাদ্দারের আশা ছিল মিনারার গর্ভে পুত্রসন্তান আসবে। তিন বছরের মাথায় জন্ম দেন ইরানী নামে অপর এক কন্যা সন্তানের। দ্বিতীয়বারেও আশা পূরণ হয়নি ইউনুচ জোমাদ্দারের। স্বামী ইউনুচ জোমাদ্দারের আশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়ে পুত্র সন্তানের আশায় তৃতীয়বারেও জন্ম দেন রাহিমা নামে আরো এক কন্যা সন্তানের। এভাবেই জামিলা, সুমী, তানজিলা, আছিয়াসহ সাত কন্যা সন্তান জন্ম দেন। কেবল পুত্র সন্তানের আশায় মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে সাতবার গর্ভধারণ করেন এবং সাতটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন তিনি। এতে শারীরিক মানসিক নির্যাতনসহ প্রতিবেশীদের কথার তোপেও পড়তে হয় তাকে। তিনি বুঝতে পারেন পুত্র সন্তান জন্ম দিতে না পারা মায়েরা সমাজ-সংসারে কতটা অসহায়। একজন নারী হয়ে বেঁচে থাকতে পুত্র সন্তানের কতটা ভূমিকা কিংবা আঁতুড় ঘর থেকেই কতটা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে কন্যাসন্তান।
বৈষম্যের শিকার হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া দিয়ারা কচুয়ার ডালিমা বেগম, ডালিমার ফুফু আলেনুর বেগম, ফাতিমা, মুক্তা, চরওয়াডেলের হাজেরা, নাজমা, আমেনা, রুনিয়া, মাহিনুর, চরমিয়াজান এলাকার রেনু বেগম। লেখাপড়া জোটেনি কারো ভাগ্যে। এরা সবাই বরণ করে নিয়েছেন বাল্যবিয়ের অভিশাপ। জীবন-যৌবন তুচ্ছ করে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের রক্তচক্ষু আর তিরস্কারের খড়গ তুলে নিয়েছেন স্বেচ্ছায় সবাই আপন কাঁধে।
কেবল চরভূমিই নয়, মূল ভূখণ্ডেও আছে কন্যাশিশুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ। স্বামী কাজল মোল্লার ছেলে সন্তানের স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করতে গিয়ে তিন কন্যা সন্তানের মা হয়েছেন মূল ভূখণ্ডের ধানদী গ্রামের মর্জিনা। কেবল ছেলের আশায় চার চারটি কন্যাসন্তানের মা হয়েছেন একই গ্রামের ফারুক হাওলাদারের স্ত্রী মোর্শেদা, আবু মাতবরের স্ত্রী সালেহা, কবির হোসেনের স্ত্রী জামেলা বেগম, বাবলু মাতবরের স্ত্রী শিল্পী বেগম, শানু ফরাজীর স্ত্রী আলেয়াসহ আশপাশের গ্রামের বহু নারী। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন এসব কন্যাশিশুই অবহেলা আর বৈষম্যের শিকার হয়ে বেড়ে উঠবে।
চন্দ্রদ্বীপের ৯নং ওয়ার্ড চরদিয়ারা কচুয়ার নুরু হাওলাদার ও অমেলা বেগমের মেয়ে ডালিমা। ডালিমার কোলে দেড় বছরের শিশুসন্তান জান্নাতুল। বাবা-মায়ের অভাবের সংসারের বোঝা নামাতে ৯ বছর বয়সে বিয়ে হয় চরব্যারেটের দিনমজুর শহিদুল বিশ্বাসের সঙ্গে। এখন হয়েছেন শিশু-মা। ডালিমা জানায়, স্বামী সংসারে গিয়ে সাবালিকা হন তিনি। রুজিনা (১০), সুজন (৮) ও তানু (৬) নামে আরো তিন ভাইবোন আছে তার। মেয়ে লেখাপড়া শিখলে বাবার কী লাভ। মেয়ে বড় হলে ঘরে রাখতে নেই, বোঝা হয় সংসারের— এই ভেবে অল্প বয়সেই তাকে বিয়ে দেওয়া হয়; মন্তব্য তার। ডালিমার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় চরওয়াডেলের হাজেরা বেগমেরও (৩২)। হাজেরার কোলে এখন চার বছরের কন্যাশিশু সানজিদা। ২৩ বছর আগে বিয়ে হয়েছিল জামাল বেপারির সঙ্গে। বিয়ের দেড় বছর পর স্বামীর বাড়িতে তুলে দেওয়া হয় তাকে। হাজেরাও সাবালিকা হন স্বামীর বাড়িতে এসে। সেই হাজেরা এখন ছয় সন্তানের মা। অন্তঃসত্ত্বা পুত্রবধূ ১৪ বছরের নাজমা বেগমের সামনেই হাজেরা বলেন, ‘চরের সব মাতারিগো (নারী) পাউচগা (পাঁচ) সাউদগা (সাত) গুরাগ্যারা (সন্তান)। অনেকের ছেলের আশায় বার বার মা অওন লাগে।’ তিনি আরো বলেন, ‘গুরাগ্যারা অইলে সংসারে কামের মানুষ বাড়ে। গুরাগ্যারা জোন্ম দেওনই মাতারিগো কাম। গুরাগ্যারা ছাড়া আর কী সম্পদ আছে মাতারিগো।’
পূর্ব-পুরুষের সূত্র ধরে সোহরাব চৌকিদার (৫০) স্ত্রী তাসলিমা বেগমকে (৪০) নিয়ে বাকেরগঞ্জের কেসনো দূর্গাবাসা থেকে এসে বসতি গড়েছেন চরওয়াডেলের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে। শিশু বয়সে বিয়ের পর ১১ সন্তানের মা হয়েছেন তাসলিমা। কন্যাশিশু বৈষম্যের ব্যাপারে চন্দ্রদ্বীপ ইউপির চেয়ারম্যান এনামুল হক আলকাস মোল্লা বলেন, ‘চরাঞ্চলের অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে কন্যাশিশু ও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে সচেতনতা সৃষ্টি ও সম্মিলিত কাজ করতে হবে। শিশুকন্যাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ পরিহার করে শিশু বিবাহ বন্ধ ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ দিলে কন্যাশিশুরাও গড়ে উঠতে পারে একজন প্রতিষ্ঠিত নারী হয়ে।’
এ ব্যাপারে বাউফলের চরাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে দীর্ঘদিন কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা স্পিড ট্রাস্টের প্রকল্প ম্যানেজার মো. হেমায়েত উদ্দিন জানান, বাউফলের চরাঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৯৬ অথচ মূল ভূখণ্ডে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৮। বিভিন্ন চরে শিশুর সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। সমীক্ষা চালিয়ে দেখা যায়, বছরখানেক আগে চন্দ্রদ্বীপের ১০টি চরে ৬৫টি বিয়ে সংঘটিত হলে তার মধ্যে ৪১টি ছিল বাল্যবিয়ে। চরওয়াডেলের সিদ্দিক মোল্লার মেয়ে ফেরদৌসীর (১৫) সঙ্গে আবুবকর নামে ময়মনসিংহ এলাকার একজনের বাল্যবিয়ের মতো জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্যের শিকার হয়ে খেয়াঘাটের যাত্রি ছাউনিতে কালাইয়া নৌ-ফাঁড়ির পুলিশের সদস্যদের হাতে মারধরের শিকার হন। ফেরদৌসী ও তার বাবা সিদ্দিক মোল্লার নাম উল্লেখ করেন তিনি বলেন, ‘জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্যের শিকার চরের কন্যাশিশুরা। সংসার কিংবা বিয়ের মতো জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশেও তাদের মতপ্রকাশের সুযোগ দেওয়া হয় না। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত চরবাসীর এক বিশাল অংশ নারী। শিশু অধিকার আইনের যথাযথ প্রয়োগ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পূর্ণ সহযোগিতা ও ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা কন্যাশিশুদের ক্ষেত্রে জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য রোধ করতে পারে। কন্যাশিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেতন হলে জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।’
উপজেলা সাবেক পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তা মাহবুব হাসান ভূঁইয়া বলেন, চরের মাঠপর্যায়ে পরিবার কল্যাণ সহকারীর স্থায়ী নিয়োগ না হওয়ায় চরবাসীকে সচেতন করা যাচ্ছে না। বিভিন্ন চরে ৩০ জনের স্থানে কাজ করছে মাত্র একজন কর্মী। দ্রুত আরো কর্মী নিয়োগ করে কন্যাশিশু বৈষম্যসহ স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনার বিভিন্ন বিষয়ে চরবাসীকে সচেতন করতে হবে।’