প্রাকৃতিক ও মানুষের সৃষ্ট কারণে পৃথিবী এখন খাদ্য সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। দরিদ্র বিশ্ব ও যুদ্ধাক্রান্ত দেশগুলোতে এই সমস্যা আরও বেশি তীব্র হয়েছে। বিভিন্ন দেশ তাদের খাদ্যপণ্য রপ্তানি কমানোর মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রথম হলো খাদ্য। বিশ্বজুড়েই খাদ্য সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ক্রমেই বিশ্বকে একটি অনিবার্য পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হতে হচ্ছে। রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের পর বিশ্বজুড়েই যে একটি সংকট উপস্থিত হতে যাচ্ছে এবং অর্থনীতির ওপর আঘাত আসতে পারে সে আঁচ আগেই পাওয়া গিয়েছিল। যুদ্ধের সাথে সাথে যোগ হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ভারতসহ এশিয়ার শীর্ষস্থানীয় চাল রপ্তানিকারক দেশগুলোতে চলতি বছর উৎপাদন কম হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এর ফলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে এসেছে খরা। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগটি হঠাৎ করেই পৃথিবীতে আঘাত করেছে। যদিও এর সাথে বিশ্ব আগে থেকেই বেশ পরিচিত কিন্তু এভাবে একসাথে বড় বড় নদীর শুকিয়ে যাওয়া এবং বৃষ্টিপাত না হওয়া কিছুটা দুশ্চিন্তার সৃষ্টি করেছে। কারণ এভাবে চলতে থাকলে চলতি সংকট আরও বেশি ঘনীভূত হবে। উৎপাদন কমে যাবে এবং আগামী দিনগুলোতে মানুষকে নিশ্চিত খাদ্য সংকটে পড়তে হতে পারে।
সংবাদমাধ্যম বিবিসি সূত্রে জানা যায়, এর মধ্যে গত ৫০০ বছরের মধ্যে ভয়াবহ খরার কবলে পড়েছে ইউরোপ মহাদেশ। গ্লোবাল ড্রাউট অবজারভেটরির সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউরোপ মহাদেশের ৪৭ শতাংশ এলাকা সতর্কতা অবস্থায় রয়েছে। এর অর্থ সেখানকার মাটি শুকিয়ে গেছে। এছাড়া ইউরোপের আরও ১৭ শতাংশ এলাকাও একটি সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। যার অর্থ সেখানকার গাছপাল স্ট্রেসের মধ্যে রয়েছে বলে লক্ষণ পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে, শুষ্ক এই মৌসুম ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চলের কিছু অঞ্চলে আরও কয়েক মাস স্থায়ী হতে পারে। সম্প্রতি কমিউনিকেশনস আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পৃথিবীর মধ্য-অক্ষাংশে এর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে। বর্তমানে গ্রীষ্মকালের কোনো কোনো সময় এখানকার তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা ১০৩ ডিগ্রি (৩৯.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস) বা তার বেশিতে পৌঁছায়।
গবেষণায় লেখক বলেছেন, ২১০০ সালের মধ্যে এই অসহনীয় তাপপ্রবাহের প্রভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের মতো জায়গাগুলোতে গ্রীষ্মকাল দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। গ্রীষ্মপ্রধান দেশে এর প্রভাব আরও ভয়াবহ হতে পারে। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও জলবায়ু রুক্ষ আচরণ করছে। বর্ষাকালে দেখা মেলেনি পর্যাপ্ত বৃষ্টির। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশে এল নিনো বা লা নিনার প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশে ১৯৭৩, ১৯৭৪, ১৯৯৭, ২০১০, ২০১৪, ২০১৫, ২০১৬, ২০১৯, ২০২১ ইত্যাদি বছরগুলো ছিল এল নিনোর বছর।
বিশ্বে মোট উৎপাদিত চালের ৯০ শতাংশই আসে এশিয়ার দেশগুলো থেকে। কিন্তু পরিস্থিতির সাথে সাথে বৈরী আবহাওয়া দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি সংস্থা ইউএসডিএ’র তথ্য অনুযায়ী, শীর্ষ তিন রপ্তানিকারক দেশে চালের যে মজুত রয়েছে তা ২০১৬ সালের শেষ নাগাদ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে এক কোটি ৯০ লাখ টনে উপনীত হবে যা হবে ২০০৩ সালের পর সবচেয়ে বড় বার্ষিক হ্রাস। আইসিজি জানায়, ২০১৬ সালে বিশ্বে চালের উৎপাদন হবে ৪৭ কোটি ৩০ লাখ টন, যা ২০১৫ সালের ৪৭ কোটি ৯০ লাখ টন থেকে কম। এর ফলে ছয় বছরে প্রথম চালের উৎপাদন কমছে এ বছর। সব মিলিয়ে আঘাত এসেছে খাদ্য উৎপাদনের ওপর। সরবরাহের সাথে সাথে উৎপাদন কম হওয়ায় খাদ্য উৎপাদনের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংকট আসতে পারে। রাশিয়ার সঙ্গে বেলারুশের ওপর নিষেধাজ্ঞায় সার আমদানি রপ্তানিতে ভারসাম্যহীনতার কারণে পুরো বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে। আফ্রিকার দেশগুলোতে খাদ্যসংকট তীব্র হচ্ছে। এছাড়াও মূল্যস্ফীতি বাড়ায় উন্নত দেশগুলোতেও খাদ্যপণ্যের মূল্য রেকর্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই খারাপ পরিস্থিতির মধ্যেই বিশ্বে খরার যে প্রকোপ দেখা দিয়েছে তা উদ্বেগের তৈরি করছে। ভবিষ্যতে এই সংকট কীভাবে মোকাবিলা করবে তা নিয়ে এখনই উদ্বিগ্ন বিশ্ববাসী। ইতোমধ্যেই খরায় ইউরোপের বিভিন্ন নদী ও হ্রদের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বিভিন্ন প্রাচীন সম্পদ দৃশ্যমান হচ্ছে। গণমাধ্যমের সুবাদে সে দৃশ্য সবাই দেখেছে। বিষয়টি অনেককে আনন্দ দিলেও মূলত এটি চিন্তার বিষয়। কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই উপাদান এভাবে শুকিয়ে গেলে প্রথমেই আঘাত আসবে উৎপাদনের ওপর। খরা পরিস্থিতি আঘাত হেনেছে চীনেও। সেখানেও নদীর পানির স্তর নেমে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তীব্র দাবদাহের কবল থেকে ফসল রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি চীন চলতি বছরের প্রথম জাতীয় খরা সতর্কতা জারি করেছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে, খরাবিধ্বস্ত হর্ন অব আফ্রিকায় ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ২২ মিলিয়নে পৌঁছেছে। কেনিয়া, সোমালিয়া ও ইথিওপিয়ায় বছরের পর বছর বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ খরার মুখে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থা হয়েছে।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম গত বছরের তুলনায় এ সময়ের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। এখন দিন যতই সামনে এগিয়ে যাচ্ছে ততই অর্থনীতির গতি বোঝা যাচ্ছে এবং করোনার পর বিশ্ব যে এই ধাক্কা সামলানোর জন্য প্রস্তুত ছিল না সেটাও বুঝতে পারছে। একদিকে মানুষের হাতে খাদ্যপণ্য পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। আবার তা সম্ভব হলেও অধিকাংশ মানুষের হাতে তা কেনার মতো অর্থও থাকছে না। এটা একটি মানবিক বিপর্যয়। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরেই বিশ্ব একটি ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। যেখানে উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলোর দরিদ্রতা একটি বড় সমস্যা। সেই অবস্থা থেকে যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চলছিল সেই সময় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে এসেছে। এর মধ্যেই খরার এই অবস্থা বিশ্ববাসীকে একটি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখেই ঠেলে দিয়েছে। বিশ্বের বড় ৬টি নদীর পানি শুকিয়ে যাচ্ছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। নদীর সাথে মানুষের জীবন ও জীবিকা ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে বিদ্যুতের উৎপাদনের নির্ভরতার বিষয়টি। খরার কারণে নদীগুলো ক্রমেই একটি খালে পরিণত হচ্ছে। তলদেশে থাকা মাটিও দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। এর মধ্যে রয়েছে কলোরাডো, ইয়াংজি, রাইন, পো ও লয়ার নদী। যুক্তরাষ্ট্রের এ নদীটি দুটি বৃহত্তম জলাধার দ্বারা সংরক্ষণ করা হয়। এর একটি হলো মিড হ্রদ। যার পানি বর্তমানে আশঙ্কাজনক হারে বং দেশটির তাপপ্রবাহ ছয় দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে চলছে। এখানকার জলবিদ্যুৎকেন্দ্র কমতে শুরু করেছে। এছাড়া চীনের বৃহৎ ইয়াংজি নদীর উপনদীগুলো এরই মধ্যে শুকিয়ে গেছে। সম্প্রতি চীন ৯ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো দেশব্যাপী খরার সতর্কতা ঘোষণা করেছে একটি ধাক্কা সামাল দিতে না দিতেই আরেকটি ধাক্কা মানুষের নাভিশ্বাস ফেলতে বাধ্য করছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে চীন কৃত্রিমভাবে বৃষ্টি ঝরাতেও সফল হয়েছে। বিশ্বজুড়ে মুদ্রাস্ফীতি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং প্রতিদিনের খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় জনগণের জীবনমান নিম্নমুখী হচ্ছে। আগামী কয়েক মাসে পৃথিবী একটি বড় ধরনের সংকটের মুখোমুখি হওয়ার মতো আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এর কারণ হলো প্রথমত করোনার ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, করোনার শেষ হতে না হতেই রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং এর সাথে বহুদিন ধরে চলে আসা সমস্যাগুলো। যেমন— বিভিন্ন দেশে দ্বন্দ্ব সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা এবং শরণার্থী সংকট। এখন এসব সমস্যা আরও বেশি তীব্র হওয়ার মুখে। কারণ বিভিন্ন দেশ খাদ্য সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। এর মধ্যে পৃথিবীজুড়েই তীব্র শরণার্থী সংকট চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা দাঁড় করা কষ্টসাধ্য।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও মুক্তগদ্য লেখক
sopnil.roy@gmail.com