হুরগণ প্রকৃতপক্ষে স্ত্রীজাতি। কিন্তু তাদের সৃষ্টি মানবসৃষ্টির চেয়ে আলাদা এবং আল্লাহরাব্বুল আলামীন আপন মহিমায় তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তারা পদ্মরাগ ও প্রবালসদৃশ্য রমণী। হুরগণ থাকবে তাঁবুতে আবদ্ধ’। (সুরা রাহমান, আয়াত-৫৮, ৭২) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জান্নাতি রমণীদের চার রঙে সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন, সাদা, হলুদ, সবুজ ও লাল। তাদের দেহ জাফরান, মৃগনাভি, আম্বর ও কাফুর দ্বারা সৃষ্টি। তাদের চুল লবঙ্গ দ্বারা সৃষ্টি। পা থেকে হাঁটু পর্যন্ত সুগন্ধি জাফরানের দ্বারা সৃষ্টি। হাঁটু থেকে নাভি পর্যন্ত মৃগনাভির দ্বারা তৈরি, নাভি থেকে ঘাড় পর্যন্ত আম্বরের তৈরি, ঘাড় থেকে মাথা পর্যন্ত কাফুরের তৈরি। যদি একজন রমণী পৃথিবীতে সামান্য থুতু নিক্ষেপ করত, তাহলে সমগ্র পৃথিবী সুঘ্রাণে মুখরিত হয়ে যেত, তাদের বক্ষের মধ্যে আল্লাহর নাম ও স্বামীর নাম লেখা থাকবে। প্রত্যেকের হাতে ১০টি করে স্বর্ণের কাঁকন থাকবে। প্রত্যেক আঙুলে থাকবে মুক্তার আংটি এবং উভয় চরণে থাকবে জহরতের নূপুর।
জান্নাত হলো মুমিনের চিরসুখের ঠিকানা। সেখানে সুখশান্তির অন্ত থাকবে না। সুখশান্তি ও আরাম-আয়েশের জন্য যা প্রদান করা প্রয়োজন তার সব কিছুই মুমিনদের জান্নাতে প্রদান করা হবে। স্বামী-স্ত্রী উভয় মুমিন হলে স্বামী তার দুনিয়ার স্ত্রী পাবে। অন্যথায় স্বামী মুমিন হলে তার জন্য অন্য স্ত্রীর ব্যবস্থা করা হবে। আর শুধু স্ত্রী মুমিন হলে তার জন্য সুখের যাবতীয় সুব্যবস্থা থাকবে।’ (দুররুন-নাসিহিন-১/১০৬ )
তারা হবে উঠতি বয়সের যুবতী রমণী। তাদের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে প্রবাহিত থাকবে নবযৌবনের স্বর্গীয় সুধা। তাদের গাল হবে গোলাপ ও আপেলের মতো লাল মিশ্রিত সাদা বর্ণের। গলায় পরানো থাকবে মণি-মুক্তার অলংকার। তাদের চেহারা সূর্যের মতো উজ্জ্বল চকচকে হবে। তারা যখন হাসবে, তখন তাদের মুখমণ্ডল থেকে বিজলির মতো আলোর চমক বের হতে থাকবে। জান্নাতবাসী একজন পুরুষ তার স্ত্রীর গালে নিজের চেহারা দেখতে পাবেন। যেমন আয়নায় নিজের ছবি দেখতে পাওয়া যায়। মাংস ও পোশাকের ভেতরে আচ্ছাদিত হাড়ের মগজসমূহ বাহির থেকে দেখা যাবে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, সেখানে থাকবে স্বামীর প্রতি দৃষ্টি সীমিতকারিণী হুরগণ, যাদেরকে ইতঃপূর্বে স্পর্শ করেনি কোনো মানুষ ও জিন। (সুরা রহমান, আয়াত-৫৬)
পবিত্র সঙ্গিনীগণ পবিত্রতার মধ্যে থাকবে। ভালোবাসার কাঙ্ক্ষিত হবে আর সৌন্দর্যের ছাঁচে ডাকা অপূর্ব কোমল রমনী হবে। রোগ-শোক-ব্যাধি হবে না।
হুরদের বিশেষ সুন্দর প্রেমের দৃষ্টান্ত হিসেবে দেহ অবয়ব সৃজন করেছেন। চিরকুমারী ও অবিবাহিত সৎকর্মশীলরা যখন চিরকালের স্বর্গবাগিচায় প্রবেশ করবে, তখন বিয়ে করবে, মুখোমুখি হয়ে আলাপ ভাব বিনিময় করবে ও তারা প্রথমে প্রবেশ করে স্পর্শ করবে । আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তৃপ্তিসহকারে খাও ও পান করো, তোমরা যে আমল করতে তার বিনিময়ে। সারিবদ্ধ পালঙ্কে তারা হেলান দিয়ে বসবে। আর আমি তাদেরকে বিয়ে দেব ডাগরচোখা হুরের সঙ্গে। (সুরা তুর, আয়াত- ১৯, ২০)
প্রেমের পর সোহাগিনী এবং বয়স চিরকাল থাকবে। ভালোবাসার দৃষ্টি আনন্দের চেয়ে বেশি মুক্তার মতো লুকানো দেহের রঙ এবং সৌন্দর্য মুক্তার উজ্জ্বলতার সমান। পদ্মারাগমনি এবং প্রবাল এই রঙ এবং উজ্জ্বলতায় শরীরের সৌন্দর্য বিকাশ করবে। চরিত্রবান সকল নারীর ভালো গুণাবলি বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। ডিমের মতো সুরক্ষিত শরীরের হাড় এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হবে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তাদের জন্য সেখানে থাকবে নত আয়তলোচনা হুরগণ। যেন তারা সুরক্ষিত ডিম।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত-৪৮, ৪৯)
আল্লাহতায়ালা হুরদের জান্নাতেই সৃষ্টি করেছেন। তারা প্রস্রাব-পায়খানা করে না। হয় না তাদের ঋতুস্রাব। তারা সবাই হবে সমবয়সী ও চিরকুমারী।। দুনিয়ার মহব্বত শতভাগে বিভক্ত। একজন নারী তার স্বামীকে বা একজন পুরুষ তার স্ত্রীকে শতভাগ ভালোবাসতে পারে না। কিন্তু জান্নাতের নারী হুরগণ-ই পারে তারা স্বামীকে শতভাগ ভালোবাসতে। তার স্বামীর দিকে তাকানো ছাড়া অন্য কারো দিকে তাকাবে না। তাদেরকে এমনভাবে সৃষ্টি করা হবে যে, প্রত্যেক সঙ্গম-সহবাসের পর তারা আবার কুমারী হয়ে যাবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি জান্নাতি রমণীদের বিশেষরূপে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তাদেরকে করেছি চিরকুমারী, সোহাগিনী, সমবয়সী।’ (সুরা ওয়াকিয়াহ, আয়াত-৩৫, ৩৭) প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘জান্নাতি রমণীরা ৭০টি কাপড় পরিহিত থাকবে, সেগুলো ভেদ করে ও তাদের পায়ের গোছার শুভ্রতা এবং অস্থি-মজ্জা দেখা যাবে। কারণ, তাদের সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, যেন তারা পদ্মরাগ ও প্রবাল । আর পদ্মরাগ এমন স্বচ্ছ পাথর যার ভেতর কোনো সুতা প্রবেশ করালে তা বাইরে থেকে দেখা যায়।’ (তিরমিযি, হাদিস নং-২৫৩২)
জান্নাতে হুরদের অনুষ্ঠান হবে। এতে তারা এমন সুমধুর কণ্ঠে গান গাইবে, যা কোনো সৃষ্টিজীব কখনো শোনেনি। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘জান্নাতে আয়াতলোচনা হুরদের সমবেত হওয়ার একটি জায়গা রয়েছে। তারা সেখানে এমন সুরেলা আওয়াজে গান গাইবে, যে আওয়াজ কোনো মাখলুক ইতঃপূর্বে কখনো শুনেনি। তারা এই বলে গান গাইবে আমরা তো চিরঙ্গিনী, আমাদের ধ্বংস নেই। আমরা তো আনন্দ-উল্লাসের জন্যই, দুঃখ-কষ্ট নেই আমাদের। আমরা চির সন্তুষ্ট, আমরা কখনো অসন্তুষ্ট হবো না। তারা কতই না সৌভাগ্যবান যাদের জন্য আমরা এবং আমাদের জন্য যারা।’ (তিরমিযি, হাদিস নং-২৫৬৪)
এমন হুরগণ আমরা নিশ্চিত পেতে চাই। এমন ভালোবাসার আবহে নিজেকে ভাসাতে চাই। তবে আমাদেরকে ওই হুরগণের উপযুক্ত হয়ে এ পৃথিবী ত্যাগ করতে হবে। তাদের সামনে দাঁড়াতে হবে তাদের যোগ্য হয়ে। আর তার জন্য আমাদেরকে আল্লাহর হুকুম সর্বক্ষেত্রে পালন করতে হবে। আর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ বা আদর্শ বাস্তবায়ন করতে হবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। তবেই আমরা পাব এমন হুর যাদের ছোঁয়ায় পুলক জাগে। যাদের সান্নিধ্যে স্বস্তি মেলে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের প্রতিপালকের নিকট তাদের জন্য এমন উদ্যানসমূহ রয়েছে যার নিচ দিয়ে ঝরনাধারা প্রবাহমান। আর সেখানে তারা চিরকাল অবস্থান করবে। সেখানে তাদের জন্য আরো আছে পবিত্রা স্ত্রীগণ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি।’ (সুরা আল ইমরান, আয়াত-১৫)
লেখক : মাহফুজ আরেফীন
শিক্ষার্থী, তামীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা, টঙ্গী