ফাইজুস সালেহীন
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন। ইলেকশন কমিশনের দিক থেকে এ প্রায় স্থির হয়েই আছে। এ ব্যাপারে শাসক দল ও জোটের কোনো আপত্তি নেই। প্রার্থী মনোনয়নের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু না হলেও নৌকার পক্ষে তারা ক্যাম্পেইন শুরু করে দিয়েছেন। ডিসেম্বরে নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপি ও নবগঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সরাসরি আপত্তি না জানালেও, তারা শিডিউল ঘোষণার আগে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের দাবি তুলেছে। অন্যদিকে এই নির্বাচন আদৌ হবে কি-না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন এইচ এম এরশাদ। তার এই সন্দেহের কারণ কী, তা অবশ্য পরিষ্কার নয়। আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র দলগুলোর নেতারা নির্বাচন বানচালের চক্রান্ত করা হচ্ছে বলে অহরহ অভিযোগের আঙুল তুলছেন বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দিকে। চিন্তাশীলরা এসব নিয়ে খুব একটা ভাবছেন না। এগুলোকে মানুষ মেঠো বক্তৃতা বলেই মনে করেন। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে মেঠো বক্তৃতা জিনিসটা সুখাদ্য না হলেও, খেতে মুচমুচে—সুস্বাদু।
চলমান রাজনীতির সার্বিক পরিস্থিতিদৃষ্টে নির্বাচন নিয়ে লোকমনে জমা হচ্ছে অনেক প্রশ্ন। সময়মতো সাধারণ নির্বাচন হবে কি হবে না, হলেও সর্বতো অর্থে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে কি না— এসবই ভাবনার বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে। ২০১৪ সালের পুনরাবৃত্তি কেউ-ই দেখতে চান না। পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সরকারের যেরকম প্রশ্নবিদ্ধ ইলেকশন হয়েছে, সেরকমটিও আর কাম্য নয়। এই বাস্তবতায় সরকার এবং শাসক দল কী চাইছে এবং কেমন করে চাইছে, সেও খুব গুরুত্বপূর্ণ। নতুন মেয়াদে ক্ষমতায় আসার জন্যে এবং ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো নিজস্ব স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে। একটি স্বচ্ছ, সুষ্ঠু, যথার্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন নিশ্চিত করে নতুন মেয়াদে সরকার গঠন করার সক্ষমতা ধরে রাখা শাসকদলের জন্যে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ উত্তীর্ণ হতে না পারলে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ আরো সংকীর্ণ হয়ে যাবে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্যে সেই অবস্থাটি শুভকর হবে না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গণতান্ত্রিক নীতি-আদর্শ থেকে সেটা হবে একটি বড় বিচ্যুতি। দেশ ও বিদেশের মানুষ জানেন যে, দু হাজার চৌদ্দ সালে কী পরিস্থিতিতে একতরফা সাধারণ নির্বাচন অপরিহার্য হয়ে দেখা দিয়েছিল। বিরোধী দল বিএনপির হঠকারী রাজনীতিই সেবার একতরফা নির্বাচনের পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। নির্বাচন প্রতিহত করার নামে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারার যে নিষ্ঠুর রাজনীতি বিএনপি করেছে তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সেই হঠকারী রাজনীতি বিএনপিকেও নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কণ্টকিত করেছে গণতন্ত্র বিকাশের পথ।
কিন্তু আজ একটা নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে যেমন রয়েছে অনেক আশা, তেমনই নিরাশার উপাদান। শাসকদলের সঙ্গে এবং বিরোধীবলয়ে জোটবদ্ধভাবে ছোট-বড় বহু দল ও উপদল সক্রিয়। এই দলগুলোর মধ্যে লক্ষ্য ও আদর্শের বিভিন্নতা রয়েছে। প্যাডসর্বস্ব দলের সংখ্যা অগণিত। এমন অনেক দলও আছে, যাদের দলের নেতার পক্ষেও এককভাবে নির্বাচন করে জামানত হারানোর বিকল্প নেই। এ ধরনের দল শাসকদলের সঙ্গেও আছে, নবগঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টেও আছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে গণবিচ্ছিন্ন যেসব দল-উপদল রয়েছে, বোধগম্য কারণেই নির্বাচন কেমন হলো না হলো তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তাদের চাওয়া হলো আওয়ামী লীগের কাছ থেকে দুয়েকটি আসন বাগিয়ে নেওয়া। সে ক্ষেত্রে ইলেকশনের নামে প্রহসন হলে আরো বেশি সুবিধা। অনায়াসে তারা এমপি হয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের এরকম ফালতু চিন্তা করার সুযোগ ও প্রয়োজন কোনোটাই নেই। আদর্শ ও ইতিহাসের দায় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলটির পক্ষে উপেক্ষা করা অসম্ভব। দলটির কাছে জনগণের যে প্রত্যাশা, সেও কিন্তু এক বিরাট বোঝা। এই ভার বহন করার সক্ষমতা দলটির রয়েছে এবং সেটা তাকে বহন করতেই হবে। মাথা মোটা ছোট দলগুলোর কাছে জনগণের কোনো প্রত্যাশা নেই। কাজেই সেটা তাদের ভাবনার বিষয় নয়।
এই বাস্তবতায় আশা করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, এক্ষণে দৃশ্যপট যে রকমই মনে হোক না কেন, একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই দেশে অনুষ্ঠিত হবে। শুরুতে অনেকে ধরে নিয়েছিলেন যে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট একটি নির্বাচনী মোর্চা। জোটবদ্ধভাবেই তারা ভোটে যাবে। ঐক্যফ্রন্টের আনুষ্ঠানিক যাত্রার আগেই দলছুট হয়ে যাওয়া ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও তার পুত্র আসন ভাগাভাগি নিয়ে যে রকম হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন, তাতে এটিকে নির্বাচনী ফ্রন্ট বলে ভ্রম হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। এখন ফ্রন্টের প্রধান নেতা ড. কামাল হোসেন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, এটা কোনো নির্বাচনী মোর্চা নয়। একটি অবাধ, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য ইলেকশন নিশ্চিত করার জন্যেই তারা জোটবদ্ধ হয়েছেন। আর তিনি নিজেও নির্বাচনে দাঁড়াবেন না। ভবিষ্যতে সরকারের কোনো পদ-পদবিও তিনি চান না। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সাত দফার ভিত্তিতে শিডিউল ঘোষণার আগে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের দাবি জানিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সংলাপের কোনো যৌক্তিকতা নেই। যুক্তির কথা বলা আর নাকচ করে দেওয়া এক জিনিস নয়। প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়ে তেমন কিছু বলেননি।
স্মরণযোগ্য, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের প্রক্রিয়া যখন চলছিল, তখন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একাধিকবার বলেছেন যে, আওয়ামী লীগকে ছাড়া কোনো জাতীয় ঐক্য হতে পারে না। কাদের সাহেব আওয়ামী লীগের কেবল মাঠ গরমকরা কোনো সাধারণ নেতা নন, দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাকে সভাপতির স্পোকসম্যানও বলা যায়। তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট ছিল যে, আওয়ামী লীগ নিজেও জাতীয় ঐক্য বা ঐকমত্যে আগ্রহী। আর সেই জাতীয় ঐক্য যে নির্বাচন প্রশ্নে, তাও দূরধিগম্য নয়। সব মিলিয়ে আশাবাদীরা যথার্থই দেখতে পাচ্ছেন আশার আলো।
আশাবাদীরা বলছেন, খুব শিগগিরই আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু হবে। আলোচনার মাধ্যমে একটি অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভবপর হবে। চৌদ্দ সালে বিএনপির অস্বাভাবিক নেতিবাচক অবস্থানের মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলোচনার দুয়ার উন্মোচন করেছিলেন। এমনকি বিএনপিকে নির্বাচনকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেওয়ার কথাও বলেছিলেন। কিন্তু যে কোনো বিবেচনাতেই হোক, বিএনপি আওয়ামী লীগের প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। সেটা ছিল বিএনপির জন্যে মারাত্মক ভুল। সেই ভুলের খেসারত বিএনপি এখনো দিচ্ছে। এবার আওয়ামী লীগের আত্মবিশ্বাসের জায়গাটি মনে হয় আরো বেশি মজবুত। এই পাঁচ বছরে সামগ্রিকভাবে যে উন্নয়ন হয়েছে তা দেশবাসীর কাছে অস্পষ্ট নয়। বিশ্বব্যাংকের সহায়তা প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরেও নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়ে চলেছে। পদ্মা সেতু দক্ষিণবাংলার মানুষকে উজ্জীবিত করেছে। তারা কিছুতেই চাইবেন না যে, এই সেতুর কাজ অসমাপ্ত পড়ে থাক। দক্ষিণের ভোটার সাধারণ বোধগম্য কারণেই সেরকম কোনো ঝুঁকির মধ্যে যেতে চাইবেন না। ভোটের বাক্সে দক্ষিণের জনমন যে নৌকার পক্ষেই যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাজধানীতে এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে, মেট্রোরেল, বিমানবন্দর-গাজীপুর র্যাপিড ট্রানজিট ওয়ের কাজও দৃশ্যমান। রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধা-অসুবিধা সারা দেশের মানুষকেই স্পর্শ করে। ফলে সারা দেশেই এসব কাজ নৌকার বাক্সে ইতিবাচক ফল দেবে।
তবে এও অনস্বীকার্য যে, বেশি উন্নয়ন ও কম গণতন্ত্র— এরকম একটা তত্ত্ব সামনে নিয়ে এসেছেন সরকারের একশ্রেণির চাটুকার বুদ্ধিজীবী, টকার ও অপেশাজীবী কলাম লেখক। সরকারের কোনো কোনো কাজ এবং ঘটনাচক্র এমনটি বিশ্বাস করার জায়গাও তৈরি করেছে। সেটা আওয়ামী লীগের জন্যে প্লাস পয়েন্ট নয়। সেই ঋণাত্বক পয়েন্টকে এখন প্লাস করে নেওয়া আওয়ামী লীগের জন্যে মোটেও কঠিন হওয়ার কথা নয়।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবেই ৪৯ শতাংশ ভোটারের সমর্থন লাভ করে। সেবার বিএনপির ভোটার সমর্থন ছিল মাত্র ৩৩ শতাংশ। এর আগে ১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সর্বাধিক সংখ্যক আসন পেয়ে আওয়ামী লীগ জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করতে সক্ষম হলেও তার ভোটার সমর্থন ছিল ৩৭ শতাংশ। ২০০১ সালের ইলেকশনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে না পারলেও তার সমর্থন ছিল শতকরা ৪০ ভাগ। বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও সেবার তার ভোটার সমর্থন ছিল ৪১ ভাগ। অর্থাৎ উনিশ-বিশ ব্যবধান। এতে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের জনসমর্থন ক্রমবর্ধমান। মাঝখানে দশ বছরে আওয়ামী লীগের জনসমর্থনের ব্যারোমিটার নিচে নেমে যাওয়ার কোনো কারণ ঘটেনি। এই যখন বাস্তবতা, তখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরো স্বচ্ছ ও শক্তিশালী করতে আওয়ামী লীগ কেন দ্বিধা করবে? কম গণতন্ত্র এবং বেশি উন্নয়নের খারাপ তত্ত্ব আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে বিভ্রান্ত করবে এমনটি আমরা বিশ্বাস করতে চাই না।