মো. কায়ছার আলী
‘জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য এবং জনগণের শাসনই গণতন্ত্র’-পৃথিবীর শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট ১৯ নভেম্বর ১৮৬৩ সালে গেটিসবার্গ বক্তৃতায় গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ সংজ্ঞা প্রদান করেন। যিনি এই সংজ্ঞা প্রদান করেন তিনি হলেন মধুর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, সহযোগিতামূলক আচরণ, চারিত্রিক দৃঢ়তা, পরমতসহিষ্ণুতাসম্পন্ন, মানবতাবাদী, গণতন্ত্রপ্রেমী এবং বাগ্মিতায় অনন্য অসাধারণ আব্রাহাম লিঙ্কন। কিন্তু যে মানুষটি গণতন্ত্রের উত্তম সংজ্ঞা প্রদান করলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য, তাকেই পৃথিবী থেকে চলে যেতে হলো অগণতান্ত্রিক শক্তির হাতে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় থাকার সময় নিজ পুত্রকে বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে প্রধান শিক্ষককে সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে যে চিঠিখানা লিখেছিলেন তিনি, তা এক ঐতিহ্যসিক চিঠি। ছোটবেলা থেকেই তার ছিল প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস অর্থাৎ প্রতিকূল পরিবেশের জন্য পরিশ্রমী ও সাহসী। একুশ বছর বয়সে ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত, বাইশ বছর বয়সে আইনসভায় পরাজিত, চব্বিশ বছর বয়সে আবার ব্যবসায় অসফল, ছাব্বিশ বছর বয়সে প্রিয়তমার মৃত্যু, চৌত্রিশ বছর বয়সে কংগ্রেস নির্বাচনে পরাজিত, পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে সাধারণ নির্বাচনে পরাজয়, সাতচল্লিশ বছর বয়সে ভাইস প্রেসিডেন্ট চেষ্টায় ব্যর্থ এবং উনপঞ্চাশ বছর বয়সে সিনেট নির্বাচনে আবার পরাজয়। তবে তিপ্পান্ন বছর বয়সে অর্থাৎ ১৮৬০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে এক গ্রামের স্টেশনে এগারো বছর বয়সি সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী গ্রেস বেডেল বলেছিল, তুমি দাঁড়ি রাখলে সুন্দর দেখাবে এবং নির্বাচনে জয়ী হবে। সত্যিই তাই হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে ঐ স্টেশনে ট্রেন থামিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই আমেরিকার পতাকাতলে দাঁড়িয়ে আছি। তোমরা কি আমার সাথে থাকবে?’ পরে মেয়েটির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। লিঙ্কন তিনজন পরাজিত প্রার্থীকে ইতিহাসের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী বানালেন। তার মন্ত্রিপরিষদকে বলা হয় ‘The team of Rivalsoe’ অর্থাৎ বিরোধীদের নিয়ে সংঘ। ১৮৩৭ সালে নামকরা প্রতিপক্ষ উকিল কোর্টের মধ্যেই লিঙ্কনকে হেয় করে কটূক্তি ও বাজে মন্তব্য করেছিলেন। সেই স্ট্যানস্টনকেই তিনি যুদ্ধমন্ত্রী নিযুক্ত করেছিলেন। এ রকম নেতৃত্ব পৃথিবীবাসী আগে কখনো দেখেনি। কুখ্যাত দাসপ্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় আমেরিকায় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ শুরু হলেও তিনি দেশকে বিভক্ত না করে ভৌগোলিক অখণ্ডতা বজায় রেখে ১৮৬৩ সালের ১ জানুয়ারি চূড়ান্তভাবে ক্রীতদাসদের মুক্তি ঘোষণায় স্বাক্ষর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনত ক্রীতদাস প্রথার অবসান ঘটে। ১৮৬৩ সালের জুলাই মাসের প্রথম তিন দিন গেটিসবার্গ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৫ এপ্রিল ১৮৬৫ সালে থিয়েটার হলে পৌঁছলে সমগ্র দর্শকরা তাকে অভিনন্দন জানালেন। সেখানে একজন অভিনেতা আততায়ী হিসেবে ভেতরে ঢুকে লিঙ্কনের মাথা লক্ষ্য করে গুলি চালান। তিনি চেয়ারের ওপরেই লুটিয়ে পড়লেন। নয় ঘণ্টা অজ্ঞান থাকার পর সকালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। মৃত্যু পথযাত্রী লিঙ্কনের পাশে দাঁড়িয়ে সেক্রেটারি অব ওয়ার স্ট্যানস্টন বলেছিলেন, ‘ঐ যে শায়িত রয়েছেন পৃথিবীর সবার চেয়ে যোগ্য একজন শাসক।’ দৈহিকভাবে মৃত্যু হলেও তার নীতি ও আদর্শের গণতন্ত্র সারা পৃথিবীতে ব্যাপকভাবে আজ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
বর্তমান বিশ্বে সর্বাধিক জনপ্রিয় সরকার ব্যবস্থা হলো গণতন্ত্র। ১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস। গণতন্ত্রের ইংরেজি প্রতিশব্দ Democracy শব্দটি এসেছে Demo এবং Kratia দুুটি গ্রিক শব্দ হতে। এ শব্দ দুটি অর্থ যথাক্রমে ‘জনগণ’ এবং ‘শাসন বা কর্তৃত্ব’। সুতরাং ব্যুৎপক্তিগত অর্থে গণতন্ত্র হলো জনগণের শাসন। পৃথিবীর রাষ্ট্রসমূহের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল করে মানুষের সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস পালনের উদ্দেশ্য। রাষ্ট্রীয় কাজে অধিক সংখ্যক জনগণকে অংশগ্রহণের শ্রেষ্ঠ উপায় গণতন্ত্র। গণতন্ত্র একদিকে মানুষকে সহনশীল হতে শেখায় অন্যদিকে পরমতসহিষ্ণুতা ও বহুমতকে সহ্য করার প্রতি ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে অনুপ্রেরণা দেয়। গণতন্ত্রের মাধ্যমে সর্বাধিক মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব। জনগণের জন্য, জনগণের মাধ্যমে গঠিত এ তন্ত্র বাক্স্বাধীনতাসহ মানুষের সার্বিক বিকাশে সর্বদা কার্যকর। ফলে এটি সর্বত্র, সবসময়, সর্বজন কর্তৃক আনন্দময় ও অর্থবহ বলে বিবেচিত। স্বাধীনতার মূল্যবোধ, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা এবং মুক্ত ও নিরপেক্ষ নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য অত্যাবশ্যক। সত্যিকার মূল্যবোধ ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। ১৯৯৭ সালে ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (IPU) গণতন্ত্রের বিশ্ব ঘোষণা করে। এই ঘোষণায় গণতন্ত্রের নীতি, গণতান্ত্রিক সরকার পরিচালনার উপাদান ও সরকার পরিচালনায় গণতন্ত্রের প্রয়োগ এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের প্রসার সুনিশ্চিত করার প্রত্যয়ে বিভিন্ন নির্দেশনা ব্যক্ত করা হয়। ১৯৮৮ সালে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট কোরাজন সি একুইনো গণতন্ত্র নবায়ন ও পুনরুদ্ধারের আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের সূচনা ঘটান। প্রাথমিকভাবে সরকার, সংসদ সদস্য ও সিভিল সোসাইটি সদস্যদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আন্তঃসরকারি ফোরাম গঠন করা হয়। এ সম্মেলনে গণতন্ত্রের নীতি ও মূল্যবোধকে বিশ্বব্যাপী কার্যকরভাবে প্রয়োগের লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়। সম্মেলনের আলোকে কাতার আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করে। পরবর্তীতে আলোচনাক্রমে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০০৭ সালের ৮ নভেম্বর গৃহীত এ/৬২/৭ নং রেজুলেশনের অনুবলে প্রতি বছর ১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস পালনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
সাধারণ অর্থে গণতন্ত্র হচ্ছে মূলত সংখ্যা গরিষ্ঠের সাথে গঠিত ও পরিচলিত সরকার। এর অর্থ এই নয় যে, গণতন্ত্র সংখ্যালঘুর মতামত ও স্বার্থকে উপেক্ষা করবে বরং গণতন্ত্রে আইনের দৃষ্টিতে সকলে সমান। গণতন্ত্র সর্বপ্রথম প্রাচীন গ্রিসের এথেন্সে প্রচলিত হয়। মধ্য যুগে ধর্ম ও রাজার দ্বৈত শাসন, স্বৈরতান্ত্রিক শাসক ও সামন্ততান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় অনেকটা সময় কেটে গেছে। দীর্ঘকাল পরে ইউরোপে গণতন্ত্রের পুনর্জন্ম ঘটে সপ্তদশ ও অষ্টদশ শতাব্দীতে। উনিশ ও বিশ শতকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রচলন দেখা যায়। অষ্টাদশ শতকের গণতান্ত্রিক ভাবধারা উৎসমূল হিসেবে ইংল্যান্ডকে চিহ্নিত করা হয়। বর্তমানে গণতন্ত্রের বিকাশ এতই সাফল্যজনক পরিস্থিতি লাভ করেছে যে, আধুনিক সভ্যতা গণতান্ত্রিক সভ্যতায় পরিণত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইংল্যান্ডের নির্বাচনে বাগ্মী, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, প্রজ্ঞা, দূরদর্শী সম্পন্ন, লেখক, চিত্রকর, ইতিহাসবিদ, প্রায় বিস্ময়কর ও অলৌকিক পর্যায়ের বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন, দুর্বিনীত সাহস ও সাহিত্যে নোবেল জয়ী উইনস্টন চার্চিলের (১৮৭৪-১৯৬৪) নেতৃত্ব ছিল অনন্য। এ জন্য তাকে উপাখ্যানের মহানায়কও বলা যায়। মিত্র শক্তির কাছে তিনি একজন দিকনির্দেশক। তার সঠিক নেতৃত্ব, মেধা আর অসীম সাহসের জন্যই সেদিন মিত্রশক্তির বিজয় ঘটেছিল। নির্বাচনে পরাজয়ের পর উইনস্টন চার্চিল অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কিন্তু জনগণের রায় দুঃখ ভারাক্রান্ত হূদয়ে মেনে নিয়েছিলেন। এরপর ঘর থেকে তিনি খুব একটা বের হতেন না। কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন না। নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করেই তিনি দিন কাটাচ্ছিলেন। এমনি অবস্থায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ার তাকে আমেরিকা সফরের জন্য চিঠি লিখলেন। চিঠি পেয়ে চার্চিল খুশি হয়ে বন্ধুর সাথে দেখা করার জন্য আমেরিকায় যান। চার্চিল বিমানবন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গেই হাজার হাজার মানুষ এবং সাংবাদিক এসেছিলেন তাকে দেখতে এবং তার সাক্ষাৎকার নিতে। তারা তাকে কাছে পেয়ে ঘিরে ধরে প্রশ্ন করা শুরু করলেন, আপনি ব্রিটেনের জন্য এতকিছু করলেন আর ব্রিটেনের মানুষ নির্বাচনে আপনাকে প্রত্যাখ্যান করল কেন? কেউবা বললেন, নির্বাচনে পরাজয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কি? চার্চিল অনেকক্ষণ সাংবাদিকদের প্রশ্নগুলো শুনলেন। কিন্তু কারো প্রশ্নের কোন জবাব দিলেন না। পরিশেষে বললেন, ‘সাংবাদিক বন্ধুরা, আমি আমার পুরোনো বন্ধুর কাছে ব্যক্তিগত সফরে বেড়াতে এসেছি। এ অবস্থায় আমার দেশ বা দেশের মানুষের সম্পর্কে আমি কোনো কথা বলব না। তাতে আমার দেশের অসম্মান হবে। আমার দেশের মানুষ আমার প্রতি অবিচার করেছে বলে মনে হলেও দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে যুদ্ধবিধ্বস্ত ব্রিটেনকে গড়ার জন্য যা করার দরকার তাই করব। জনগণের সিদ্ধান্ত আমি শ্রদ্ধার সাথে মেনে নিয়েছি, এটাই গণতন্ত্রের রায়। আবার যদি কোনোদিন ডাক আসে দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ব। কিন্তু দেশের সম্পর্কে, দেশের মানুষের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে পারব না। প্লিজ, ক্ষমা করবেন।’
সবাই স্তম্ভিত হলেন। চার্চিলের দেশপ্রেম, গণতন্ত্রের জন্য শ্রদ্ধা ও জাতির প্রতি তার আনুগত্যের কথা ভেবে সেদিন সকল সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবী মুগ্ধ হয়েছিলেন। পরিশেষে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে আমি মনে করি, গণতন্ত্রই হলো সর্বজননন্দিত প্রকৃষ্ট শাসন ব্যবস্থা। এর শ্রেষ্ঠত্ব বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে এবং কাম্য শাসন ব্যবস্থা। যদিও একজন মহানুভব প্রেসিডেন্ট নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন এবং আরেকজন মহান ও উদার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। কিন্তু তারপরও তারা গণতন্ত্রের পতাকাকে আকাশে পতপত করে উড়িয়েছেন। গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রেখেছেন। এটাই সত্য, এটাই বাস্তব।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক