মানুষের অসুস্থতা বিচিত্র কোনো বিষয় নয়। অসুস্থ হলেই ওষুধের প্রয়োজনীয়তা জরুরি হয়ে যায়। ওষুধ ব্যবহার করে শুরু হয় সুস্থ হওয়ার প্রচেষ্টা; আর এমন স্বাস্থ্যসংকটে সচেতন মানুষের কাছে বিজ্ঞানসম্মত ওষুধই ভরসা। জীবন রক্ষাকারী উপাদান ওষুধ চিকিৎসাবিজ্ঞানের মহত্তম সৃষ্টি। বিজ্ঞানীদের গবেষণাপ্রসূত সূত্র ধরেই তৈরি হচ্ছে ওষুধ।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা আজো সৃষ্টি করে চলেছেন নানা ব্যাধির অসংখ্য ওষুধ। চলমান আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ দেশের শিল্পোদ্যোক্তা ও মেধাবী কর্মীদের নিত্যকর্মে, দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে বিশ্বমানের ওষুধ। আর সেই ওষুধ তৈরিতে মুনশিয়ানা দেখিয়েই চলেছে এ দেশের ওষুধ পরিবার।
আমাদের ওষুধশিল্পের অভিযাত্রা অল্পদিনের নয়। কয়েক দশকের বিদগ্ধ সাধনায়, দীর্ঘ পথের সিঁড়ি ভেঙে, মেধা ও দক্ষতাকে সঙ্গী করে তবেই আজ পৌঁছেছে সাফল্যের এ শিখরে। এখন ওষুধ শিল্পের প্রসারিত দুনিয়ায় আমরা নতুন দিগন্তে প্রবেশ করেছি। দিন দিন এর পরিধি বিস্তৃতই হচ্ছে। দেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ততোধিক শিল্পোন্নত না হলেও শিল্পসমৃদ্ধ অনেক দেশ আমাদের ওষুধের ক্রেতা। এটা সত্যি গর্বের। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বাংলাদেশ থেকে ৫৪টি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন দেশে ওষুধ রপ্তানি করে আসছিল। ২০১১ সালে দেশের সংখ্যা ছিল ৪৭টি। এরপর কয়েক বছর কোনো প্রতিষ্ঠান তালিকায় যুক্ত হয়নি। কিন্তু ২০১৫ সাল নাগাদ কোম্পানির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১১৩টিতে। বর্তমানে ২৫৭টিতে এসে পৌঁছেছে। আর রপ্তানি করছে আমেরিকার উত্তর ও দক্ষিণের ২৫টি দেশসহ ইউরোপের ২৬টি, আফ্রিকার ৩৪টি, অস্ট্রেলিয়ার ৫টি ও এশিয়ার ৩৭টি দেশে।
ওই সব দেশের বাজারে মানের প্রশ্নে ও দামের বিচারে এ দেশের ওষুধ জায়গা করে নিয়েছে। শিল্পে সমৃদ্ধ উন্নত জীবনযাপনের পথে যাদের পদচারণা, তারা কি না সুস্থ থাকতে আমাদের উৎপাদিত ওষুধে আস্থা রাখছে; এর চেয়ে বড় অর্জন আর কী হতে পারে? এটাই তো আমাদের পরম অর্জন। বিশ্বে ওষুধের রপ্তানি বাজার ১৭০ বিলিয়ন ডলার। এর ১০ শতাংশ ধরা গেলে রপ্তানি আয় ১৭ বিলিয়ন ডলার হবে। ২০৩০ সাল নাগাদ ওষুধ রপ্তানিতে বাংলাদেশ এক নম্বর হতে পারে, এমন সম্ভাবনা দেখছেন অভিজ্ঞ মহল। ২৫৭টি ওষুধ কোম্পানির উৎপাদিত ওষুধের বর্তমান বাজার মূল্য বার্ষিক ২ বিলিয়নের ওপরে। প্রকাশিত আরেক সংবাদে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাস মহামারিতে দেশের বিভিন্ন শিল্প খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেও ওষুধশিল্পে রপ্তানি আয় বেড়েছে। রপ্তানি পণ্যের তালিকায় কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ব্যবহূত ওষুধের অন্তর্ভুক্তি, গুণগত মানের উন্নয়ন ও সরকারের নীতিসহায়তার কারণে সুবাতাস বইছে এ খাতে। সদ্য শেষ হওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১৬ কোটি ৯০ লাখ ২ হাজার ডলারের বিভিন্ন ধরনের ওষুধ রপ্তানি করেছে। বর্তমান বাজার দরে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ১ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা। এই অঙ্ক আগের অর্থবছরের (২০১৯-২০) চেয়ে ২৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেশি। ওষুধশিল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, গত অর্থবছরে কেবল কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ব্যবহূত ওষুধ রপ্তানি থেকেই আয় হয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।
বর্তমানে দেশের দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠান ৫ হাজার ব্র্যান্ডের ৮ হাজারেরও বেশি ওষুধ উৎপাদন করছে। এর মধ্যে বড় ১০টি কোম্পানি দেশের চাহিদার ৮০ শতাংশ মিটিয়ে যাচ্ছে। বড় ২০টি কোম্পানি বিবেচনায় নিলে মোট চাহিদার ৯০ শতাংশ সরবরাহ করছে এ কোম্পানিগুলো। আর ৪০টি কোম্পানি ১৮২টি ব্র্যান্ডের সহস্রাধিক রকমের ওষুধ রপ্তানি করছে। এর মধ্যে দেশের আরো ১০-১২টি কোম্পানি বিভিন্ন দেশে রপ্তানিতে নিবন্ধন পেয়েছে।
সত্তরের দশকে যেখানে দেশের চাহিদার ৭০ শতাংশ ওষুধ আমদানি করতে হতো, সেখানে এখন নিজেদের ৯৮ শতাংশ চাহিদা মিটিয়ে ১৫১টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করে প্রতি বছর বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে বাংলাদেশ। বর্তমানে মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ ওষুধ আমদানি করতে হয়। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে স্থিরভাবে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি পণ্যের আসন ধরে রাখবে ওষুধ।
ওষুধ শিল্পের উন্নয়নের পেছনে রয়েছে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং দক্ষ ওষুধকর্মীদের সমন্বিত শ্রম। শুধু কি তাই, বর্তমানে ক্যানসারের মতো জটিল রোগের ওষুধও দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। এ অর্জন জনমানসে সত্যি বিস্ময় সৃষ্টি করে। এ অর্জনকে সুরক্ষা দিয়ে এ শিল্পের সঙ্গে আগামীর পথে আরো এগিয়ে যাওয়াই আমাদের কর্তব্য। কিছুদিন আগে এক জাতীয় সেমিনারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওষুধকে ২০১৮ সালের ‘প্রোডাক্ট অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করেছেন। প্রতি বছর বিশ্ববাজারে এ দেশীয় ওষুধের গ্রহণযোগ্যতা প্রসারিত হতে থাকায় প্রধানমন্ত্রী ওই ঘোষণা দেন। এ ঘোষণা ওষুধ শিল্পসংশ্লিষ্টদের শুধু উৎসাহিতই করেনি, সেইসঙ্গে আগামীর পথচলায় ওষুধ শিল্প পরিবারে অনুপ্রেরণাও সৃষ্টি করেছে। কদিন আগে রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হলো ‘এশিয়া ফার্মা এক্সপো-২০১৮’। এই প্রদর্শনীতে ছিল ওষুধ উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তির বিশাল সমাহার। ওষুধ শিল্পের সর্বশেষ প্রযুক্তি নিয়ে হাজির হয়েছিল দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। আয়োজনটি দেশের ওষুধশিল্পের ভাবমূর্তি আরো একধাপ উজ্জ্বল করেছে নিঃসন্দেহে।
আরেকটি বিষয় ওষুধের কাঁচামাল। ওষুধপ্রযুক্তি ও কাঁচামাল সরবরাহকারী দেশগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বাংলাদেশ। এখনো দেশের বেশিরভাগ ওষুধের কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। দেশে ওষুধের কাঁচামালের বাজার প্রায় ১২০০ কোটি টাকার। কাঁচামালের জন্য একটা সুব্যবস্থাপনা দেশের অভ্যন্তরে থাকলে উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার অনেক সাশ্রয় হতো। সেইসঙ্গে ওষুধের কাঁচামাল বিদেশে রপ্তানি করা যেত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। কাঁচামাল সুব্যবস্থাপনার জন্য একটা উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। মুন্সীগঞ্জের এপিআই পার্ক পুরোপুরি চালু হলে ওষুধশিল্পের কাঁচামালের জন্য আর পরমুখাপেক্ষী হতে হবে না। বরং রপ্তানি হবে। বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের অগ্রযাত্রার মূল কারণ বলা যেতে পারে ওষুধনীতির যথাযথ বাস্তবায়ন। ১৯৮২ সালে এ দেশে যে ওষুধনীতি করা হয়েছিল, তার সুফল এখন উঠে এসেছে এ শিল্পের দোরগোড়ায়। দেশের বৈদেশিক আয়ের প্রধান উৎস তৈরি পোশাক। তৈরি পোশাকের পরই চলে আসছে ওষুধ শিল্প। ওষুধশিল্পের সমস্যাগুলো গভীরভাবে নিরীক্ষণ করে সময়োপযোগী ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদেশি অর্থ আয়ের উদীয়মান এই সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। তাহলেই কেবল এ শিল্প দ্রুত এগিয়ে যেতে পারে রপ্তানির বিশ্ব-আঙিনায়।
লেখক : মোবারক হোসেন
সাংবাদিক