বিশ্ব অর্থনীতির হালচাল

প্রতীকী ছবি

মুক্তমত

করোনাকাল

বিশ্ব অর্থনীতির হালচাল

  • প্রকাশিত ৬ মে, ২০২১

মো. ফুয়াদ হাসান

করোনা আতঙ্কে ধুঁকছে বিশ্ব। কান্না আর মৃত্যুর লম্বা সারি প্রতিদিন দীর্ঘায়িত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত সংক্রমণ আর মৃত্যুর সংখ্যায় রেকর্ড গড়ছে বিশ্ব। উন্নত বিশ্ব থেকে শুরু করে দরিদ্র বিশ্ব-সবখানে এর তাণ্ডব সমহারে বাড়ছে। দক্ষিণ এশিয়ায়ও করোনার প্রভাব খুবই প্রকট। প্রতিনিয়ত মৃত্যু আর নিত্যপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা দ্রব্যের সংকটে ভাসছে ভারত। মৃত্যুহারের সব রেকর্ডকে হার মানাচ্ছে প্রতিবেশী এই দেশ। প্রাণের দেশ বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। করোনার এই ছোবল থেকে বাঁচতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। জীবন বাঁচানোর তাগিদে লকডাউনের সিদ্ধান্ত সমীচীন। তবে গরিব, খেটে খাওয়া মানুষের জন্য লকডাউন কতটা যৌক্তিক? আর কত গৃহবন্দি থাকবে তারা? প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। প্রশ্নটির সমাধানের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বহুগুণে বাড়াতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, ক্ষুধার জ্বালা করোনার থেকেও ভয়াবহ। বৈশ্বিক লকডাউনের ফলে বিশ্ব বাণিজ্যের চেইন বিকল হয়ে পড়ছে। এর প্রভাব পড়ছে দেশের আমদানি-রপ্তানিসহ বিশ্ব বাণিজ্যে। ফলে বিশ্ব অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে বৈশ্বিক মন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে। ২০১৯ সালের শেষের দিকে চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনায় বিশ্ব অর্থনীতি হুমড়ি খেয়ে পড়ে। দীর্ঘ প্রচেষ্টা আর সুনিপুণ সব পদক্ষেপে ২০২০ সালের শেষের দিকে বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। স্বাভাবিক হয়ে ওঠে আমদানি-রপ্তানিসহ অর্থনীতির সকল কার্যত্রুম। ফলে  চলতি বছরের প্রারম্ভে বৃহৎ অর্থনীতিগুলো বেশ কিছু প্রবৃদ্ধির বিশ্ব রেকর্ড গড়ে। কিন্তু চলমান শ্বাসরুদ্ধকর করোনার দ্বিতীয় ঢেউের ফলে আবারো হুমকির মুখে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। নিষেধাজ্ঞা, কারফিউ, লকডাউন ও বিমান চলাচল বন্ধের মতো সিদ্ধান্ত দ্রুত বিশ্ব বাণিজ্যের সকল চেইন বিকল করে তুলছে। ফলে বিশ্ব অর্থনীতি আবারো অচল হয়ে পড়ছে। এর বিরূপ প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির উচ্চ আকাঙ্ক্ষাসহ বিশ্ব পণ্যবাজারেও পড়ছে। দেশে  খাদ্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যর সংকট ও দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএস) তথ্য বলছে, দ্রত সংকট সমাধান করা না হলে ২০২৫ সালের মধ্যে ৯ লাখ কোটি ডলার হারাবে বিশ্ব অর্থনীতি (সূত্র বণিক বার্তা ২৩/০৪/২১)।

মহামারীর পূর্বে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হারে উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির অবদান ছিল দুই- তৃতীয়াংশ। করোনার ফলে উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের এ গতি থমকে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছে বিশ্বব্যাংক। করোনা মারামারীর  তাণ্ডবে এরই মাঝে বিশ্ব পণ্যবাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। খাদ্যপণ্য, জ্বালানি, কৃষি পণ্য, এমনকি কৃষির প্রাণ সারের দামও বাড়তির দিকে। পরিসংখ্যানের তথ্য বলছে, চলতি বছরের শুরুতে (জানুয়ারি-মার্চ) থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করা চালের দাম ছিল ৫৪২ ডলার (টনপ্রতি), যা গত বছর একই সময়ে ছিল ৪৬৫ ডলার। ২০২১ সালের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম ছিল ৩৫০ ডলার (টনপ্রতি)। ২০২০ সালের একই সময় দাম ছিল ৩০০ ডলার।

গত বছর একই সময় ভোজ্যতেলের দাম ছিল ৮৯৫ ডলার (টনপ্রতি), যা ৬৭ শতাংশ বেড়ে চলতি বছরের একই সময় ১ হাজার ৪৯৪ ডলারে বিক্রি হয়েছে। চলতি বছর একই সময় টনপ্রতি ইউরিয়া সার বিক্রি হয়েছে ৩১৭ ডলারে, যা গত বছর একই সময় ছিল মাত্র ২২০ ডলার (সূত্র বণিক বার্তা ২৩/০৪/২১)। মহামারী থেকে বাঁচতে দেশে দেশে চলমান লকডাউনের ফলে বিশ্ব পণ্য বাজারের সরবরাহ চেইন বিকল হয়ে পড়ছে। ফলে পণ্যের দাম হুহু করে বেড়ে চলেছে। অন্তর্জাতিক পণ্য বাজারের অস্থিশীলতার প্রভাব সরাসরি পড়ছে দেশের পণ্য বাজারে। ফলে পণ্য বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে উঠেছে। তা ছাড়া এসব পণ্যের দেশীয় চাহিদা পূরণ করতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্তর্জাতিক পণ্য বাজারের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে বার্ষিক চিনির চাহিদা ১৮ লাখ টন, যার সিংহভাগ মিটাতে হয় আমদানি করে। চালে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছিল বাংলাদেশ। তবে মাঝে মাঝেই বাংলাদেশকে এ পণ্য আমদানি করতে হয়। বর্তমান উৎপাদন হ্রাস, মহামারীর প্রভাব ও সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া বিফল হওয়ার ফলে মজুত কমছে, ফলে আমদানির প্রতি নজর দিতে হচ্ছে আমাদের। পণ্য বাজারের বিরূপ প্রভাব সরাসরি পড়ছে নিম্নআয়ের তৃণমূল মানুষের ওপর। করোনার প্রভাবে বিশ্বে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্ম হারিয়েছে। ফলে আয় কমা এসব মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। একদিকে পণ্যের দাম বেশি, অন্যদিকে নিম্ন ক্রয়ক্ষমতার ফলে প্রতিনিয়ত নির্বাচন সমস্যায় ভুগছে এসব মানুষ। তা ছাড়া মহামারীর ফলে বহু সংখ্যক মানুষ উচ্চবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণিতে নেমে এসেছে। যারা প্রতিনিয়ত লোকলজ্জা আর অভাবের সাথে লড়ায় করে টিকে আছে।

সম্প্রতি এক গবেষণায় বলা হচ্ছে, মহামারীতে ভেঙে পড়া অর্থনীতি দ্রুত প্রবৃদ্ধির দেখা পেলেও, করোনায় দ্রুত বর্ধমান বেকার সমস্যা সমাধান সম্ভব হবে না। মানে প্রবৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে কর্মস্থান সৃষ্টি হবে না। সম্প্রতি শত শঙ্কা আর হতাশার মাঝেও একটু স্বস্তির সংবাদ শুনাল বার্তা প্রতিষ্ঠান রয়টার্স। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের মার্চ মাসজুড়ে চলা এক জরিপে অংশগ্রহণকারী অর্থনীতিবিদদের ৫৫ শতাংশই ২০২১ সালে বিশ্বের ৪৪টি দেশ অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি পাবে বলে মত দিয়েছেন। অর্থনীতির এই প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে। জানুয়ারিতে প্রবৃদ্ধির হারের এই পূর্বাভাস ছিল ৫ দশমিক ৩ শতাংশ (সূত্র ডেল্টা টাইমস ২৪/০৪/২১)।  করোনা মহামারীর ফলে পৃথিবীর  জান ও মালের  ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারস্পরিক সহযোগিতার বিকল্প নেই। প্রভাবশালী, ধনী ও দরিদ্র অর্থনীতি ভুলে সকলের একযোগে কাজ করতে হবে। সে সব দেশের প্রতি সদয় হতে হবে যাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সর্বোপরি, পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ আর সহযোগিতায় পৃথিবী ফিরে পাক তার চিরচেনা রূপ। বিশ্ব অর্থনীতিতে ফিরে আসুক গতিশীলতা।

লেখক : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads