বিলীন হয়ে যাচ্ছে কক্সবাজার সৈকতের ঝাউবাগান

জোয়ারের ঢেউয়ে বিলীন হওয়া সৈকতের ডায়াবেটিক পয়েন্টের ঝাউবাগান

ছবি: বাংলাদেশের খবর

জাতীয়

বিলীন হয়ে যাচ্ছে কক্সবাজার সৈকতের ঝাউবাগান

  • মাহাবুবুর রহমান, কক্সবাজার
  • প্রকাশিত ১ জুলাই, ২০১৯

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের মনোরম সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূলবাসীদের রক্ষা করে আসছিল বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত সমুদ্র পাড়ের ঝাউ বাগান। উপকূলবাসীর রক্ষাকবচ ও সৌন্দর্যবর্ধনকারি ঝাউবাগান বর্তমানে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জোয়ারে ঢেউয়ের তোড়ে গোড়ালি থেকে মাটি সরে গিয়ে উপড়ে পড়ছে এসব ঝাউগাছ। পাশাপাশি কিছু ঝাউগাছ কাঠ চোরচক্রও কেটে নিয়ে যাচ্ছে।

কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, কক্সবাজার সদর রেঞ্জের নাজিরারটেক থেকে শীলখালী পর্যন্ত ১৯৭২-১৯৭৩ সাল থেকে ২০১৭-১৮ সাল পর্যন্ত ৪৮৫ হেক্টর বালিয়াড়িতে ঝাউ গাছের চারা রোপণ করা হয়। বর্তমানে সেখানে অর্ধেকের মত ঝাউগাছ রয়েছে।

কিন্তু বন বিভাগের দেওয়া তথ্যের সাথে ব্যাপক গড়মিল রয়েছে। কারণ স্থানীয়দের দাবী বর্তমানে যে পরিমাণ ঝাউগাছ রয়েছে সেটা অর্ধলক্ষাধিক এর চেয়ে বেশি হবে না। ৪৮৫ হেক্টরের মধ্যে বর্তমানে ৪০ থেকে ৫০ হেক্টর জমিতে ঝাউগাছ রয়েছে। এছাড়া ইনানী, হোয়াক্যং, শিলখালী ও টেকনাফ রেঞ্জের আওতাধীন ঝাউ বাগান নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। তবে সব চেয়ে সৌন্দর্য বর্ধনকারি পর্যটকদের প্রধান আর্কষণ সৈকতের হিমছড়ি থেকে নাজিরার টেক পর্যন্ত প্রতিনিয়ত বিলীন হচ্ছে ঝাউ গাছ। জোয়ারের ঢেউয়ের তোড়ে উপড়ে পড়ছে ঝাউগাছগুলি। এলাকার সৌন্দর্য ধরে রাখার জন্য ঝাউগাছগুলো রক্ষা করা জরুরি হয়ে পড়ছে।

কক্সবাজার সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন সভাপতি প্রফেসর এম এ বারী জানান, উপকূল ও সৈকতের সৌন্দর্য রক্ষার্তে দ্রুত সময়ে বাধ নির্মাণ করে সমাধান জরুরি। অন্যথায় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত ঝাউগাছ ধংসের পাশাপাশি উপকূলবাসীও সাগরের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পাবে না। 

সূত্র মতে, কক্সবাজার সদর রেঞ্জের নাজিরারটেক থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত ১৯৬১-৬২ সালে ১২ হেক্টর বালিয়াড়িতে প্রথমে সৃজন করা হয় ঝাউ গাছ। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ঝাউবাগানের প্রসার ঘটানো হয়। তখন থেকেই এ ঝাউ বাগান সমুদ্র পাড়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উপকূলবাসীদের রক্ষা করে আসছে। তবে ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে অর্ধেকের বেশি বাগান বিলীন হয়।

সূত্র আরো জানায়, ১৯৯১-৯২ সালে ১২ হেক্টর বালিয়াড়িতে নতুন করে প্রায় ৩০ হাজার চারা রোপণ করা হয়। ১৯৯৬-৯৭ সালে ১১৫ হেক্টর বালিয়াড়িতে রোপণ করা হয় ৩ লক্ষাধিক ঝাউ চারা। ১৯৯৭-৯৮ সালে ৪০ হেক্টরে লক্ষাধিক চারা, ১৯৯৮-৯৯ সালে ৫ হেক্টরে সাড়ে ১২ হাজার চারা, ২০০২-০৩ সালে ৮ হেক্টরে ২০ হাজার চারা, ২০০৩-০৪ সালে ৮৭ হেক্টরে ২ লাখ ১৭ হাজার চারা ও ২০১০-১১ সালে ৫ হেক্টরে সাড়ে ১২ হাজার চারা রোপণ করা হয়। প্রতি হেক্টরে আড়াই হাজার করে প্রায় ৩০০ হেক্টরে সাড়ে ৭ লক্ষাধিক ঝাউগাছ সৃজন করা হয়। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জোয়ারের ঢেউয়ের ধাক্কায় ভাঙতে থাকে সৈকতের বালিয়াড়ি। সমুদ্রপৃষ্ঠের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জোয়ারের ঢেউয়ের তোড়ে গোড়া থেকে বালি সরে যায়। এতে বিলীন হতে থাকে নয়নাভিরাম ঝাউবাগান।

স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ী আবু সায়েম ডালিম জানান, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে সৈকতের ১০০ মিটারের অধিক প্রস্থে ঝাউ বাগান বিলীন হয়ে যায়। নতুন করে ঝাউ বাগান সৃজন করা হলেও ভাঙ্গন রোধ করার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এছাড়াও ঝাউ বাগানের পাশে অবৈধ বসবাসকারীরা রাতের অন্ধকারে ঝাউ গাছ কেটে পাচার করে আসছে। এ ভাঙ্গন রোধ ও কাঠ চোরদের দমন করতে না পারলে আগামী ৫ বছরের মধ্যে সৌন্দর্য বর্ধনকারী ঝাউবাগান নিশ্চিন্ন হয়ে যাবে।

কক্সবাজারের পরিবেশ সংগঠন ইয়ুথ এর নির্বাহি পরিচালক ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, ঝাউগাছ বিলীনের বিষয়টি দীর্ঘদিনের। এই বিষয়ে অনেক আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কোনো দপ্তর ঝাউ গাছ রক্ষায় এগিয়ে আসেনি।

সৈকতের হিমছড়ি থেকে নাজিরারটেক পর্যন্ত বাঁধ নির্মাণের দাবি কক্সবাজারবাসীর। এর মাধ্যমে  উপকূলবাসীর পাশাপাশি ঝাউগাছ রক্ষা পাবে বলেও মনে করেন তারা।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ হুমায়ন কবির জানান, প্রাকৃতিক কারণে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে জোয়ারের সময় ঢেউয়ের ধাক্কায় ঝাউ গাছের গোড়া থেকে বালি মাটি সরে যাওয়ায় বিলীন হতে থাকে ঝাউ বাগান। তবে ১৯৭২-৭৩ সাল থেকে এই পর্যন্ত ৪৮৫ হেক্টর জমিতে ঝাউগাছ লাগানো হয়েছে। চলতি বছরেও ৬০ হেক্টর বালিয়াড়িতে ঝাউ গাছ সৃজনের কাজ চলছে।

বন কর্মকর্তা আরো জানান, যদি পানি উন্নয়ন বোর্ড কিংবা অন্য কোনো প্রকল্পের মাধ্যমে উপকূল রক্ষায় সাগর তীরে আধুনিক পদ্ধতিতে কোনো বাঁধ নির্মান করা যেত তাহলে উপকূলবাসী রক্ষার পাশাপাশি বিশে^র দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য বর্ধনকারি ঝাউবাগানও রক্ষা পেত।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads