সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শিবিরে ভাঙনের দিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কড়া নজর রাখছে। বিএনপির নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্ট থেকে জোটসঙ্গীদের বের হয়ে যাওয়া এবং অন্যান্য দলের বের হয়ে যাওয়ার হুমকির ঘটনাগুলো নিবিড় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ শিবিরে আসলে কী ঘটছে বা কী ঘটতে পারে, সেসব বিষয়ে তীক্ষ নজর রাখার পাশাপাশি বিষয়গুলো জনগণের কাছে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরার সিদ্ধান্তও নিয়েছেন সরকারি দলের শীর্ষ নেতারা।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের সূত্র জানায়, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক জোটে ভাঙন ও টানাপড়েনে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে অনেকটা স্বস্তিতে আছে। ভাঙনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি রাজনীতির মাঠে আরো দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। সরকারবিরোধী জোটের সংঘাত ও অনৈক্য জনগণের কাছে তুলে ধরলে তাতে রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগেরই লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই সরকারি দলের নেতারা বিএনপি-জামায়াত জোটের দুর্বলতা তুলে ধরবেন। ‘বিএনপি নেতিবাচক রাজনীতি’ থেকে সরে না আসায় দলটির ও দলটির নেতৃত্বে জোট আজকের অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে- এমন প্রচারও চালাবেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণফোরামের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হওয়ার সময় আওয়ামী লীগ থেকে বলা হয়েছিল, ঐক্যফ্রন্টের গঠন প্রক্রিয়াতেই ভাঙনের সুর আছে। ফ্রন্ট ভাঙনের মুখে পড়বে এবং বিএনপিও ভাঙন থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না। বিএনপি ও ফ্রন্টের অবস্থা শুরু থেকেই লেজেগোবরে। সংসদ নির্বাচনের মাত্র চার মাস পর ঐক্যফ্রন্টে ভাঙন ধরার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের কথাই সত্য হলো বলে মনে করছেন দলটির শীর্ষ নেতারা। বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরে অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি অনুযায়ী কোনো ধরনের রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করতে হয় কি-না, সেদিকেও খেয়াল রাখছে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব।
আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিএনপি নেতৃত্বের ২০ দলীয় জোট থেকে অনেকেই পালাতে শুরু করেছেন। ভবিষ্যতে আমরা আরো অনেককেই দেখতে পাব ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। নেতৃত্বের পরিবর্তন ছাড়া বিএনপি ঘুরে দাঁড়িয়ে জনগণের দল হতে পারবে বলে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি না।’
তথ্যমতে, একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রবীণ আইনজ্ঞ ও গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব গত বছরের ১৩ অক্টোবর বিএনপিসহ চারটি দল নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়। ফ্রন্টে আরো আছে গণফোরাম, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। গঠিত হওয়ার পরই ফ্রন্ট হয়ে উঠে গত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের মহাজোটের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। তবে গঠিত হওয়ার মাত্র সাত মাস পরই বিএনপির কর্মকাণ্ডে ফ্রন্টের শরিকরা ‘অস্বস্তিতে’ আছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত ঐক্যফ্রন্টের দুই প্রার্থী ফ্রন্টের সিদ্ধান্ত না মেনে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেওয়ায় একজনকে বহিষ্কার ও অন্যজনকে কারণ দর্শানোর চিঠি দেয় গণফোরাম। এ নিয়েও ফ্রন্টের শরিকদের মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়।
ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে অনেক ‘অসঙ্গতি’ রয়েছে আর এক মাসের মধ্যে তা ‘সুরাহা’ না হলে আগামী ৮ জুন ফ্রন্ট থেকে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ বেরিয়ে যাবে বলে জানান দলটির সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার মতিঝিলে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ ঘোষণা দেন।
শপথ না নেওয়ার বিষয়ে ‘অবিচল’ থাকার কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত ২০ দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই বিএনপির নির্বাচিত পাঁচজন সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেন। এতে সন্দেহ দানা বাঁধে ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটে। জোট ছাড়ার ঘোষণা দেয় আন্দালিব রহমান পার্থের নেতৃত্বের বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)। বিএনপি না ‘শোধরালে’ বিজেপির মতো জোটের অন্য শরিকরাও ২০ দল ছাড়ার ‘হুমকি’ দিয়েছে। ঐক্যফ্রন্ট ও বড় দলের অহমিকা ত্যাগ করাসহ নানা শর্ত দিচ্ছেন তারা। তাদের দাবি, বিএনপি বারবার ভুল করছে। ভুলের ভাগীদার হয়ে তারা আর খেসারত দিতে চান না।
অবশ্য বিজেপির ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়াকে ‘মান-অভিমান’ বলে আখ্যায়িত করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। ‘অচিরেই এ সমস্যার অবসান হবে’ বলেও দাবি করে তিনি বলেন, ‘জোটের অন্তর্ভুক্ত অনেকের মধ্যেই মান-অভিমান থাকতে পারে। তবে সেগুলোর অবসান হয়ে যাবে। বিশেষ করে বিএনপি ও জোটের আরও যারা নেতা আছেন, তাদের হস্তক্ষেপে এগুলো থাকবে না।’
১৯৯৯ সালে জামায়াত ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট আর বিজেপিকে নিয়ে চারদলীয় জোট গড়ে তোলে বিএনপি। ২০১২ সালে সমমনা আরো রাজনৈতিক দল নিয়ে ১৮ দলীয় জোট গঠিত হয়। পরে আরো দুটি দল শরিক হলে তা ২০ দলীয় জোটে পরিণত হয়।