বিরক্তিকর দুর্গন্ধযুক্ত শ্বাস

মুখের এই দুর্গন্ধ কেন হয়, তা নিয়ে বিজ্ঞানের গবেষণা বহুকাল ধরে চলে আসছে

সংগৃহীত ছবি

ফিচার

বিরক্তিকর দুর্গন্ধযুক্ত শ্বাস

  • প্রকাশিত ১৮ অক্টোবর, ২০১৮

dr. orupratan_1

অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী

মুখের দুর্গন্ধ (হ্যালিটোসিস) হচ্ছে এমন একটি বিব্রতকর সমস্যা, যা মানুষকে সামাজিক জীবন থেকে দূরে সরিয়ে একঘরে করে ফেলে। মুখের দুর্গন্ধের কারণে মানুষ জনসম্মুখে যেতে লজ্জাবোধ করে। মুখের দুর্গন্ধ সম্পর্কে সবচেয়ে মজার তথ্যটি হলো, এটা ব্যক্তি নিজে বুঝতে পারেন না এবং অবলীলায় সবার সঙ্গে কথা বলে যান; কিন্তু অন্যরা বুঝতে পারেন যারা তার কাছাকাছি থাকেন। এটাই মুখের দুর্গন্ধের একটি বড় সমস্যা। এতে সহকর্মী এবং বন্ধু-বান্ধব ছিটকে যায়, কাছে ঘেঁষতে চায় না। অনেকেই বন্ধু ও প্রিয়জনের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হন এবং অপ্রিয় হয়ে যান। এ ধরনের অবস্থায় লাজ-লজ্জা ভুলে নিকটজন কাউকে জিজ্ঞেস করা ভালো যে, তার মুখে কোনো দুর্গন্ধ আছে কি-না অথবা কী তার সমস্যা। সবার কাছে লজ্জা পাওয়ার চাইতে এক বন্ধুর কাছে একটু লজ্জা পাওয়া খারাপ নয় নিশ্চয়ই অথবা নিজের মুখের সামনে হাত রেখে জোরে হা করে বাতাস বের করে নাকের দিকে ফিরিয়ে নিলে নিজেই বুঝতে পারা যাবে মুখে দুর্গন্ধ আছে কি-না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বন্ধু স্ত্রী হলে স্বামী অথবা স্বামী হলে স্ত্রীর পরামর্শ নেওয়া ভালো, সন্তান হলে মাকেও প্রশ্ন করা যায়।

সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগী নানা সমস্যার সম্মুখীন হন দুর্গন্ধযুক্ত শ্বাস ও আনুষঙ্গিক কারণে। তাই কেউ কেউ হরেকরকম মাউথওয়াশ ব্যবহার করে বিরক্তিকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় খোঁজেন। তাতে ফল কতদূর পাওয়া যায় তা বলতে পারবেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বসে নেই, একের পর এক চালিয়ে যাচ্ছেন নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তেমনি সম্প্রতি পরিচালিত সমীক্ষা শেষে একদল মার্কিন বিজ্ঞানী একটি নতুন তথ্য উপস্থাপন করেছেন। তাদের ভাষায়, দুর্গন্ধযুক্ত শ্বাস দূরীকরণে এবং সুগন্ধি শ্বাসের জন্য মিন্ট বা পারফিউমের চেয়ে অধিক কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম ম্যাগনোলিয়া ফুল গাছের বাকল বা ছাল।

মুখের এই দুর্গন্ধ কেন হয়, তা নিয়ে বিজ্ঞানের গবেষণা বহুকাল ধরে চলে আসছে। সেসব গবেষণা থেকে সুনির্দিষ্টভাবে কয়েকটি কারণকে চিহ্নিত করা গেছে। সেগুলোর মধ্যে প্রতিবার খাবার গ্রহণের পর মুখের ভেতরে খাদ্য আবরণ দাঁতের ফাঁকে, মাড়ির ভেতর জমে থেকে, যা থেকে জন্ম নেয় ডেন্টাল প্লাক এবং মাড়ির প্রদাহ। মুখের যে কোনো ধরনের ঘা বা ক্ষত অথবা আঁকাবাঁকা দাঁত থাকার কারণে খাদ্যকণা ও জীবাণুর অবস্থান। দেহে সাধারণ রোগের কারণে মুখের ভেতরে ছত্রাক ও ফাঙ্গাস জাতীয় ঘা (ক্যানডিজিস) অথবা মুখের ক্যানসার, ডেন্টাল সিস্ট বা টিউমার হয়ে থাকে। তা ছাড়া দুর্ঘটনার কারণে ফ্র্যাকচার ও ক্ষত, দেহের অন্যান্য রোগের কারণেও মুখের দুর্গন্ধ হতে পারে, যেমন- পেপটিক আলসার বা পরিপাকতন্ত্রের রোগ, লিভারের রোগ, গর্ভাবস্থা, কিডনি রোগ, রিউমেটিক বা বাতজনিত রোগ, ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র, হাইপার টেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ, গলা বা পাকস্থলীর ক্যানসার, এইডস, হৃদরোগ, মানসিক রোগ, নাক, কান, গলার রোগ।

নিম্নোক্ত পন্থাগুলো অবলম্বন করে মুখের দুর্গন্ধ দূর করা যায় :

বাজারে অনেক ধরনের মাউথওয়াশ পাওয়া যায়। তবে অ্যালকোহলযুক্ত মাউথওয়াশ ব্যবহার করা উচিত নয়। এটা মুখ গহ্বরকে শুষ্ক করে তোলে, এই পরিবেশে ব্যাকটেরিয়া বেশি জন্মায়। অতএব ওই সময় মাউথওয়াশ ব্যবহার না করে অল্প গরম লবণ মিশ্রিত পানি দিয়ে কুলকুচি করা ভালো।

তা ছাড়া এর পরিবর্তে অর্ধেক পানি এবং অর্ধেক হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের মিশ্রণ ব্যবহার করা যেতে পারে। যেহেতু হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড মুখের ভেতর ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে দেয় না।

১. সজীব নিঃশ্বাসের জন্য টুথব্রাশে দাঁত ব্রাশ করার সময় যোগ করা যেতে পারে কয়েক ফোঁটা চা পাতার তেল অথবা পুদিনার তেল, যা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে অনেক দক্ষতার সঙ্গে।

২. যারা মুখের দুর্গন্ধে ভুগছেন, তাদের উচিত প্রতিবার খাবার গ্রহণের পর ভালোভাবে কুলকুচি করা। তাহলে মুখের ভেতরে জমে থাকা খাদ্যকণা বের হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়া জন্মানোর কোনো সুযোগ থাকবে না।

৩. বেশিরভাগ মানুষ শুধু তাদের দাঁত পরিষ্কার করেন, জিহবা পরিষ্কার করেন না। কিন্তু দাঁত ব্রাশের পাশাপাশি জিহবা পরিষ্কার করাও জরুরি। টাং স্ক্র্যাপার বা টাং ক্লিনারের সাহায্যে এটা করা যায়। জিহ্বাতেও অনেক ধরনের ব্যাকটেরিয়া থাকে, যা দুর্গন্ধের জন্য দায়ী।

৪.  যাদের মুখগহবর বেশি শুষ্ক, তারা মুখের দুর্গন্ধের সমস্যায় বেশি ভোগেন। তাই তাদের প্রচুর পানি পান করতে হবে। এক্ষেত্রে অল্প অল্প করে বার বার পানি খেতে হবে। মুখের লালা নিঃসরণ বাড়াতে চিনিবিহীন গাম অথবা লজেন্স বা সুগারলেস চুইংগাম মুখে রাখতে হবে।

৫. ক্যাফেইন এবং অ্যালকোহলও মুখের শুষ্কতার জন্য দায়ী। তাই এসব গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে।

৬.  নিকোটিন হচ্ছে মানুষের শরীরের সবচেয়ে বড় শত্রু। দাঁত এবং জিহ্বাতে এই নিকোটিন জমে। ধূমপান মুখ গহ্বরকে অধিক পরিমাণে শুষ্ক করে তোলে। এতে পর্যাপ্ত পরিমাণে লালা তৈরি হয় না। তাছাড়া পান সুপারি জর্দা ব্যবহার থেকেও বিরত থাকতে হবে।

৭. বিশেষভাবে যা করবেন : দাঁত ব্রাশ করলেই ময়লা বা খাদ্যকণা পরিষ্কার হয় না। কারণ দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে বা মাড়ির ভেতরে ভেতরে জমে থাকা খাদ্যকণায় পচন শুরু হলে মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে। তাই যাদের দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে খাদ্যকণা জমা হয়, তাদের ডেন্টাল ফ্লস (এক ধরনের পিচ্ছিল সুতা) বা ডেন্টাল টুথ পিকস (এক ধরনের জীবাণুমুক্ত শলাকা)-এর সাহায্যে খাদ্যকণাগুলো বের করা প্রয়োজন। এই ডেন্টাল ফ্লস বা সুতা এবং জীবাণুমুক্ত শলাকা ব্যবহার বিধি একজন ডেন্টাল সার্জনের কাছ থেকে জেনে নেওয়া ভালো। অনেক সময় এ ফাঁকগুলো ডেন্টাল ক্যারিজ বা মাড়ির রোগের কারণেও হতে পারে। তাই কোনো সিদ্ধান্তের আগে ডেন্টাল এক্স-রে করিয়ে নেওয়ার পর নিশ্চিত হয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হতে পারে।

লেখক : মুখ ও দন্তরোগ বিশেষজ্ঞ, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানস

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads