মো. রাফছান
আতঙ্ক, মহামারী, অবরুদ্ধ-চারপাশে আটকে গেছে ধ্বংসশালী মানবতা। অজানা আতঙ্কে অকস্মাৎ থমকে গেছে জনতা, ঘরবন্দি হয়েছে কোটি কোটি শ্রমবাহিনী শরীর। কী এক নিদারুণ পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে আমরা। ভবিষ্যৎ নয়, চারদিকে শুধু বেঁচে থাকার হা-পিত্যেশ! আইসিইউ নেই, ভালো চিকিৎসক নেই, ভালো হাসপাতাল নেই, উন্নত চিকিৎসার জন্য নেই প্রয়োজনীয় অর্থ। এরকম হাজার নাইয়ের মধ্য দিয়ে দ্রুতবেগে এগিয়ে চলছে মৃত্যুর মিছিল, ক্রমাগত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে লাশের সারি।
এতসব কিছুর বিনিময়েও জীবননাশী করোনাভাইরাসকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। পর্যাপ্ত অক্সিজেন আর সঠিক চিকিৎসার অভাবে অতি সহজেই মৃত্যুকে আপন করে নিচ্ছে অসহায় মানুষ। উন্নত আইসিইউ, প্রশিক্ষিত ডাক্তারদের চোখের সামনেই মানুষ মারা যাচ্ছে একের পর এক। সবকিছু উপেক্ষা করে এক প্রকার বাধ্য হয়েই পেটের তাগিদে জীবন হাতে নিয়ে এদিক-ওদিক ছুটছে একদল খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ন্যানোমিটারের এক ভাইরাসেই পরাক্রমশালী মহাকাশজয়ী পৃথিবীর মৃত্যুর কাছে কী এক অসহায় আত্মমর্পণ! কী অবলীলায় একের পর এক ব্যর্থ হচ্ছে করোনাভাইরাস মোকাবিলার হাজারও প্রচেষ্টা। মৃত্যুর সংখ্যায় হ্রাস টানতে যথেষ্ট হচ্ছে না ভ্যাকসিনেশন কিংবা কঠোর লকডাউনও।
করোনার ভয়াবহতায় গত বছরের ২৬ মার্চ থেকেই দেশে আনুষ্ঠানিক লকডাউনের শুরু, সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল ১৭ মার্চ ২০২০ থেকে। সংকট মোকাবিলায় মে মাসের শেষের দিকেই তুলে দেওয়া হয়েছিল লকডাউন, স্বল্প পরিসরে খুলে দেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন ধরনের গার্মেন্টসহ সব ধরনের সরকারি দপ্তর। করোনার প্রকোপে বারংবার লকডাউন দেওয়া এবং তুলে নেওয়ার মাঝেই পেরিয়ে গেছে পুরো ১টি বছর। অস্থিতিশীল অবস্থা মোকাবিলায় করোনার বিস্তার কমাতে ১৪ এপ্রিল থেকে পুনরায় ঘোষণা করা হয়েছে সাত দিনের কঠোর লকডাউন। এই সময়ে জরুরি সেবা ব্যতীত সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিতসহ সব ধরনের অফিসের পাশাপাশি কল-কারখানা ও যান চলাচল বন্ধ থাকবে।
এই মহামারীতে পরিবর্তন এসেছে আমাদের জীবনযাত্রায়, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় এবং কর্মকৌশলে। ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে রোগাক্রান্ত ও মৃত্যুর হার কমে এলেও এই মহামারী এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। বর্তমানে ভারতের দিল্লিতে করোনা মহামারীর প্রকোপে প্রতিদিনই প্রাণ হারাচ্ছে ২ হাজারেও বেশি মানুষ। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নতুন প্রতিবেদন অনুযায়ী করোনাভাইরাস সৃষ্ট লকডাউনের কারণে ২০২০ সালের শেষ নাগাদ নিম্নআয় ও মধ্যআয়ের দেশের প্রায় ২৬ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ তীব্র খাদ্যাভাবের মুখোমুখি হয়েছে। মে মাসে প্রকাশিত ব্র্যাকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনা মহামারীর কারণে দেশের প্রায় ৩৬ শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, কাজের সুযোগ হারিয়েছেন পুরো দেশের ৬২ শতাংশ দিনমজুর।
সপ্তাহব্যাপী কঠোর লকডাউনে বিপাকে দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। আর্থিক দৈন্যদশা আর প্রয়োজনীয় খাবারের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন দেশের বিভিন্ন অংশের এই চাকরিচ্যুত, খেটে খাওয়া প্রান্তিক জনগণ। জীবন-জীবিকা পরিচালনার এক কঠিন প্রশ্নে পিছলে গেছে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত। করোনা সংকটের পূর্বে ৭.৫-৮% জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ এগোচ্ছিল ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে। ফলস্বরূপ দারিদ্র্যের হার কমে আসার পাশাপাশি ভিন্ন ভিন্ন সূচকেও এসেছিল ইতিবাচক পরিবর্তন। খানা আয়-ব্যয় জরিপ অনুসারে, ২০১০ সালে যেখানে অতি দারিদ্র্যের হার ছিল ১৭.৬ শতাংশ, ২০১৬ সালের তা নেমে এসেছিল ১২.৯ শতাংশে (প্রায় ২ কোটি ২১ লক্ষ মানুষ)। কিন্তু সম্প্রতি ব্র্যাকের একটি জরিপে বলা হয়েছে, মহামারীর এই অস্থিতিশীলতায় অতি দারিদ্র্য বেড়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। অর্থাৎ লকডাউনের পর দেশে অতি দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছে প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ।
প্রকৃতির এই করুণ খেয়ালে ধসে পড়ছে বিশ্ব অর্থনীতি। করোনায় বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান খাত গার্মেন্ট শিল্পে ধস নেমেছে। করোনাকালীন এই দুঃসময়ে একমাত্র বৈদেশিক রেমিট্যান্সের পরিমাণই ঊর্ধ্বমুখী। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট এক হাজার ৮২০ কোটি ৩০ লাখ (১৮.২০ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসী শ্রমিকরা, যা ছিল গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি। তবে দেশীয় পরিবহন, উৎপাদন এবং রপ্তানিমুখর শিল্পেও ক্রমাগত নিম্নমুখী হচ্ছে রাজস্ব আয়ের হিসাব। তথাপিও অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার শর্তে গার্মেন্ট, শিল্প খুলা রেখে ভঙ্গুর অর্থনীতির বেহাল অবস্থা দূরীকরণে পুরোদমে কাজ করছে সরকার। করোনাভাইরাসের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ইতোমধ্যে ৭২ হাজার কোটি টাকারও বেশি আর্থিক প্রণোদনার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে বর্তমান সরকার। যার মধ্যে শিল্প ঋণের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ২০ হাজার কোটি, রপ্তানিমুখর শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে বরাদ্দ হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি নিম্নআয়ের মানুষ ও কৃষকের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা, রপ্তানি উন্নয়ন ফান্ড ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, প্রিশিপমেন্ট ঋণ ৫ হাজার কোটি টাকা, গরিব মানুষের নগদ সহায়তা ৭৬১ কোটি টাকা, অতিরিক্ত ৫০ লাখ পরিবারকে দশ টাকা কেজিতে চাল দেওয়ার জন্য ৮৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতে অতিরিক্ত ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
মৃত্যুবাণে দুর্বার প্রতাপে এগিয়ে চলা করোনাকে থামানো যাচ্ছে না কোনো ক্রমেই। অবিরাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়িয়ে চলেছে তার শিকারের সংখ্যা। অনিঃশেষ ধেয়ে চলা এই করোনার আজ পৃথিবীময় রাজত্ব। আপন রক্ত ছেড়ে যাচ্ছে আপন হূদয়, পাশে থেকেও বাড়ছে কাছে থাকার দূরত্ব। এক অজানা আশঙ্কায় ভীতসন্ত্রস্ত পুরো মানবসমাজ। এক করোনায় এসে মিলিত হয়েছে বড়-ছোট, উঁচু-নিচুর বাধা, ব্যবধান। আরো একবার স্রষ্টায় বিশ্বাসের প্রয়োজনবোধ জন্মেছে বর্বর, স্বার্থপরায়ণ মানব হূদয়ে। অহিংসা, ভ্রাতৃত্ব ফের এসেছে মহামারীর আতঙ্কের ডেরায়। বর্ণবিদ্বেষ ভুলে সকল ধর্মের মানুষ করোনা মোকাবিলায় একজোট হয়েছে, যার ইতিবাচক ফলাফলে ক্ষণে ক্ষণে মানুষে মানুষে তৈরি হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতার কিছু অনন্য উদাহরণ।
করোনায় আতঙ্কিত নয়, সতর্ক হওয়া প্রয়োজন আমাদের করণীয় কর্মকাণ্ডে। জেনে নেওয়া দরকার ঠিক করণীয় কিংবা কোনটা করা উচিত। সর্বত্র মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহার এবং ঘনঘন সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করার পাশাপাশি মানতে হবে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সতর্কতা। সময়-অসময়ের কিছু পছন্দ, শখ আর ভালো লাগার বলিদান দিতে হবে মানবতার প্রয়োজনে। অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে স্রষ্টার দেওয়া ধর্মীয় বিধিনিষেধ। ধনী-গরিব আর বর্ণবৈষম্য ভুলে হাঁটতে হবে সমবায় ও সমতার পথে।
করোনার এই ক্রান্তিপর্বে ডানা মেলুক বেঁচে থাকার নতুন কোনো দুর্বোধ্য সমীকরণ। বিবেকের আইসিইউতে আরো একবার পরিশুদ্ধ হোক কৃষ্ণকায় নষ্ট হূদয়। লকডাউনের এই দুর্বিষহ করুণ সময় নতুন করে জানতে শিখাক প্রয়োজনবোধ, শিখিয়ে দিক অস্থিতিশীল জরুরি দুরবস্থায় টিকে থাকার অভাবনীয় কলাকৌশল। দুঃসময় পেরিয়ে বেঁচে থাকুক নির্বিবাদী, সত্যনিষ্ঠ অসহায় প্রতিবেশী সমাজ।
লেখক : শিক্ষার্থী, মেরিন সায়েন্স, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়