কবিরুল ইসলাম, সিলেট থেকে
কাকডাকা ভোরেই বিভিন্ন এলাকা থেকে আসতে শুরু করেছেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আর এলাকাবাসী। সবাইকেই আপ্যায়ন করতে হচ্ছে। কেউ ফুল, কেউবা আবার মিষ্টি নিয়ে আসছেন লাওস ম্যাচের জয়ের নায়ক বিপলু আহম্মেদের বনকলা এলাকার বাড়িতে। মানুষের এমন ভিড় সামলাতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে বাবা-মা ও ভাইবোনদের। তবে এমন বিড়ম্বনাতে কোনো আক্ষেপ নেই তাদের। সবাইকে সানন্দে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। বসতে দিচ্ছেন বৈঠকখানার ঘরে। বাড়ির বিশাল আঙ্গিনায় করতে হয়েছে আসনের ব্যবস্থা। বাড়িতে যেন বইছে ঈদের আমেজ। এ আনন্দ উৎসবটা শুরু হয়েছে বাংলাদেশ-লাওস ম্যাচের পর থেকেই। ম্যাচ শেষ হওয়ার পর সিলেট সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহম্মেদ নিজেই মিষ্টি নিয়ে চলে আসেন বিপলুদের বাড়িয়ে। রাতে বিশাল মিছিলও করেছেন এলাকাবাসী। ২১ বছর বয়সী বিপলু এখন সিলেটের নায়ক। এক ম্যাচেই বনে গেছেন ‘মহাতারকা।’
সাত ভাই, দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট বিপলুর এমন কীর্তিতে আনন্দে মাতোয়ারা বাবা-মা, ভাইবোনরা। খুশিতে কেঁদেছেনও তারা। তবে এ অশ্রু আনন্দের। এ অশ্রু অনেক বড় সফলতার। যাকে ঘিরে এ উৎসব, সেই বিপলুও কাল ছুটি নিয়ে বাসায় ছুটে আসেন দুপুরে। ১টা ৩৫ মিনিটে বাড়িতে প্রবেশ করতেই ছুটে আসেন বড় বোন। কপালে এঁকে দেন চুমো। বা-মাকে বুকে জড়িয়ে নেন বিপলু নিজেই। তাদের সালাম করে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কারটি তুলে দেন বাবার হাতে। ছেলের খেলা দেখতে পরশু মাঠে যেতে পারেননি বাবা-মা। ঘরে বসেই খেলা দেখেছেন। ৬০ মিনিটে বিপলুর পা থেকে যখন জয়সূচক একমাত্র গোলটি আসে, তখন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না বাবা রেহান মিয়া। মা হালিমা বেগম গোলের পর পরই খুশিতে কেঁদে ফেলেছেন। রাতে ছেলের সঙ্গে ভিডিও কলে কথাও বলেছেন। কিন্তু মোবাইল ফোনে কথা বলে কি আর মন ভরে? তাই তো বাসায় আসার জন্য অনুরোধ করেছিলেন আদরের ধনকে। মায়ের আবদার রাখতেই বিপলু দুপুরে চলে আসেন বাসায়। ছেলেকে নিজ হাতে খাইয়ে দেওয়ার জন্য রান্নাও করে রেখেছিলেন।
সাত ভাইয়ের মধ্যে ছয়জনই ফুটবল খেলে থাকেন। তবে বিপলু ও তার বড় ভাই শিপলু ছাড়া ঢাকার মাঠে আর কারো খেলার অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু জেলা পর্যায়ের শীর্ষ ক্লাবে খেলেছেন সবাই। পুরো সিলেটেই তারা ‘ফুটবল পরিবার’ হিসেবে পরিচিত। ফুটবল পরিবারে জন্ম নেওয়া বিপলু মূলত আজকের এ অবস্থানে এসেছেন বড় ভাই বাবলু আহম্মেদের অনুপ্রেরণায়। তার হাত ধরেই প্রথম ফুটবলে হাতেখড়ি জাতীয় দলের এ অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের। ছোট ভাইয়ের এমন সফলতায় দারুণ উচ্ছ্বসিত বাবলু, ‘দল বেঁধে সবাই গিয়েছিলাম মাঠে খেলা দেখতে। সে যখন গোল করেছে তখন আমি আনন্দে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। ওকে নিয়ে আমার প্রত্যাশা অনেক। আমি চাই দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ভারতের জনপ্রিয় টুর্নামেন্ট আইএসএলের মতো টুর্নামেন্টে সে অংশগ্রহণ করুক।’
বাবা রেহান মিয়া ছেলের এমন পারফরম্যান্সে বেজায় খুশি, ‘আমি খুবই আনন্দিত। সিলেটের জন্য এবং হযরত শাহজালালের (রহ.) মান রেখেছে আমার ছেলে। আমার ৭ ছেলের সবাই কমবেশি খেলাধুলা করেছে। কাউকেই আমি খেলার জন্য কখনো মানা করিনি। আজ আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।’ মা হালিমা খাতুন নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে বার বার কেঁদে ফেলছিলেন- ‘টিভিতে যখন দেখলাম আমার বিপলু গোল করেছে, তখন খুশিতে আমার কান্না চলে এসেছিল। সকালেই প্রতিবারের মতো আমাকে ফোন করে দোয়া করতে বলেছিল ও (বিপলু)।’
যার পা থেকে আসা একমাত্র গোলে বাংলাদেশ আজ স্বপ্ন দেখছে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের সেমিফাইনালে খেলার, সেই বিপলু জানান- ‘হোম গ্রাউন্ডে খেলা ছিল তাই টেনশনটাও ছিল বেশি। তবে বড় ভাই বাবলু সকালে টিম হোটেলে গিয়ে আমাকে প্রেশার না নিয়ে স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে বলেছিলেন। ম্যাচের শুরু থেকেই আমার চেষ্টা ছিল গোল করার। কিন্তু হচ্ছিল না। যখন ওই সুযোগটা পেয়েছি তখনই বলটা আউটসুইং করেছিলাম। আর সেটাই কাজে এসে যায়।’