বিনিয়োগ কর্মসংস্থান ও রফতানিতে হতাশা

বিনিয়োগ কর্মসংস্থান ও রফতানিতে হতাশা

প্রতীকী ছবি

রাজস্ব

বাড়তি প্রবৃদ্ধির হাতছানি

বিনিয়োগ কর্মসংস্থান ও রফতানিতে হতাশা

  • জাহিদুল ইসলাম
  • প্রকাশিত ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) সাড়ে ৫ ভাগ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যের বিপরীতে গড় অর্জন ছিল ৪ ভাগ। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যের মাত্র ৭২ দশমিক ৭৩ শতাংশ অর্জন হয়েছিল। ২০১১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সময়ে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যের বিপরীতে অর্জন ছিল সর্বোচ্চ ৮৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। বাংলাদেশে বাস্তবায়ন হওয়া দশটি মধ্যমেয়াদে পরিকল্পনার একটিও শতভাগ বাস্তবায়ন হয়নি। তবে প্রচলিত ধারার বিপরীতে এই প্রথমবার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অর্জন লক্ষ্য ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৪০ শতাংশ লক্ষ্যের বিপরীতে প্রবৃদ্ধি এসেছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছাড়িয়ে যাচ্ছে চলতি অর্থবছরেই। পাঁচ বছরে ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ গড় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যের বিপরীতে প্রথম দুই বছরেই অর্জন ৭ দশমিক ৪২ ভাগ। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মধ্যবর্তী মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

গতকাল রাজধানীর এনইসি সম্মেলন কেন্দ্রে প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলমের সভাপতিত্বে সভায় ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সভাপতি শফিউল আলম মহিউদ্দিন, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য আসিফ-উজ-জামানসহ বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি, গবেষক ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধির পাঁচ বছরের লক্ষ্যের ৯৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ প্রথম দুই বছরে অর্জিত হয়েছে বলে অনুষ্ঠানে জানানো হয়েছে।

প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছাড়িয়ে গেলেও বিনিয়োগ, রফতানি, প্রবাসী আয়, কর্মসংস্থান, রাজস্ব আহরণ, সরকারি ব্যয়, দক্ষ শ্রমিকের বিদেশ যাত্রাসহ প্রবৃদ্ধি অর্জনের অনুষঙ্গের অনেক সূচকেই এ সময়ে লক্ষ্য পূরণ হয়নি বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এমনকি জিডিপির তুলনায় বেশ কিছু সূচকে অবনতি হয়েছে। বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও রফতানি কমে আসার বিপরীতে জিডিপির বাড়তি প্রবৃদ্ধি অর্জন হওয়ায় গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, বাংলাদেশে অতি ধনী বাড়ছে। এটাকে অতি ধনী না বলে বলা যায় সম্পদ বাড়ছে। এটা আনন্দের ব্যাপার। আমাদের সম্পদের সবচেয়ে অভাব। এ অবস্থায় সম্পদ বাড়লে সরকার তার সুরক্ষা দেবে। ফলে সম্পদ আরো বাড়বে। তিনি আরো বলেন, দারিদ্র্য নিরসন এক নম্বর আলোচনায় থাকবে। আর আঞ্চলিক বৈষম্য আমাদের অদৃষ্টের পরিহাস। যে আঞ্চলিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করলাম। সেই বৈষম্য দেশের ভেতরেই। তবে এই আঞ্চলিক বৈষম্য সারা বিশ্বে আছে।

মন্ত্রী আরো বলেন, বৈষম্য কমিয়ে সম্পদ বাড়াতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার আনতে হবে। পুরনো আইনগুলো সংস্কার করতে হবে। জড়তা, অসারতা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এসব কমাতে হবে। বিধিবিধান সংস্কার না করলে আমলারা কিছুই করতে পারবে না। তিনি বলেন, সবচেয়ে আনন্দের বিষয় রফতানি বেড়েছে। এ ছাড়া নতুন বাজার সৃষ্টি হচ্ছে।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় ড. শামসুল আলম জানান, পরিকল্পনাটি ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর মেয়াদে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর মধ্যে মধ্যবর্তী মূল্যায়ন করা হচ্ছে পরিকল্পনাটির। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জিডিপির ৩১ শতাংশ লক্ষ্যের বিপরীতে বিনিয়োগ হয়েছে সাড়ে ৩০ শতাংশ। ব্যক্তি খাতে ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ লক্ষ্যের বিপরীতে বিনিয়োগ হয়েছে ২৩ দশমিক ১ শতাংশ। আর সরকারি খাতে ৭ দশমিক ১ শতাংশের লক্ষ্য ছাড়িয়ে বিনিয়োগ হয়েছে জিডিপির ৭ দশমিক ৪ শতাংশ।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২০২০ সালের মধ্যে রফতানি আয় জিডিপির ১৬ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য রয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ খাতে অর্জন জিডিপির ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ। যদিও ২০১৪-১৫ অর্থবছর রফতানিতে আয় হয়েছিল জিডিপির ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ। এ হিসাবে রফতানির প্রকৃত পরিমাণ কমেছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছর জিডিপির ৮ শতাংশের সমান প্রবাসী আয় এলেও তা কমে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৫ শতাংশে। ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে সরকারি ব্যয় জিডিপির ২১ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য রয়েছে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। সর্বশেষ হিসাবে ২০১৬-১৭ অর্থবছর সরকারি ব্যয় জিডিপির ১৩ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে।

সরকারি বিনিয়োগ বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে শামসুল আলম বলেন, বেসরকারি বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে সরকারি বিনিয়োগ বেড়েছে। এ ছাড়া ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ লক্ষ্য ছিল ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ। এটি এখনো অর্জিত হয়নি। তবে অর্জনের পথে রয়েছে। জাতীয় সঞ্চয় জিডিপির ৩০ দশমিক ২ শতাংশ লক্ষ্য থাকলেও এখনো অর্জিত হয়নি। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, প্রবাসী আয় ঠিক মতো আসেনি। সেই সঙ্গে রফতানি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পুরোটা অর্জিত হয়। তাই সঞ্চয় কম হয়েছে।

কাঙ্ক্ষিত হারে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হয়নি বলে জানান শামসুল আলম। তিনি বলেন, ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে আড়াই লাখ কর্মসংস্থান হয়। তবে এ হারে এখন আর হচ্ছে না। যন্ত্রপাতির ব্যবহার, স্বয়ংক্রিয়করণসহ নানা কারণে একই কাজে কম মানুষ ব্যবহার হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান বাড়ানোর লক্ষ্য থাকলেও তা পূরণ হয়নি। বিদেশি কর্মসংস্থানও বাড়ছে না প্রত্যাশিত হারে।

সিডিপির ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, রফতানি, বিনিয়োগসহ প্রবৃদ্ধির জিডিপির অনেক সূচকেই কাঙ্ক্ষিত উন্নতি নেই। লক্ষ্যের চেয়ে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা কম বিনিয়োগ করেও বাড়তি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রবৃদ্ধির গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। মুস্তাফিজ আরো বলেন, প্রবৃদ্ধির বিপরীতে কর্মসংস্থানের স্থিতিস্থাপকতার হার কমছে। এসব খাতের লক্ষ্য পূরণে সংস্কারে গুরুত্ব দিতে হবে।

তিনি আরো বলেন, উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হলে অনেক সুবিধাই আর পাওয়া যাবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপি সুবিধা বাড়তি তিন বছর থাকলেও অন্যান্য সুবিধা সঙ্কুচিত হবে। ওষুধ শিল্পের মেধাস্বত্বে ছাড় এলডিসি দেশগুলোর জন্য ২০৩৫ সালের জন্য বর্ধিত হলেও বাংলাদেশকে এ সুবিধা ছাড়তে হবে। এসব সুবিধা ধরে রাখতে আলোচনা শুরু করার পরামর্শ দেন তিনি।

এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল আলম মহিউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশে এখনো ব্যবসার খরচ বেশি। তবে সরকার এ বিষয়ে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বেড়েছে। তবে সেটির সঠিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads