জামালপুর সদর উপজেলার ইটাইল ইউনিয়নের গানকান্দা গ্রামে পল্লী বিদ্যুতের নতুন সংযোগ পাচ্ছেন ২৫০ গ্রাহক। এই সংযোগ পেতে নানা ভোগান্তির কথা তুলে ধরেন তাদের অনেকে। গানকান্দার ৯৪ গ্রাহক জানান, নিয়মের বাইরে অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয়েছে এজন্য। সবার অভিযোগ, আবেদন করে মিটার পেলেও এক বছরে তাদের কেউ এখনো সংযোগ পাননি।
কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার কেরুয়ালা গ্রামে সংযোগ পাওয়ার অপেক্ষায় থাকা ২৬ গ্রাহকের সবাই বাড়তি অর্থ ব্যয়ের অভিযোগ করেছেন। আবেদন করার ছয় মাসে তারা এখনো বিদ্যুৎ পাননি। ঘুষ দিয়েও ছয় মাসে সংযোগ পাননি টাঙ্গাইলের নাগরপুরের তারাবাড়ি গ্রামের ৩০ গ্রাহক। বিলম্ব আর ঘুষের বিষয়ে অভিযোগ ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার চানপুর গ্রামের ৪০০ গ্রাহকের সবার। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে সরকারের পক্ষ থেকে বিপুল উদ্যোগ থাকলেও এর সুবিধা পেতে বিভিন্ন ধরনের বিড়ম্বনা পোহাতে হচ্ছে গ্রাহকদের। পল্লী বিদ্যুতের সংযোগ পেতে অন্তত ৭১ শতাংশ গ্রাহক ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
আইএমইডি সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা বিভাগে ২০১৮ সালের জুনের মধ্যে পল্লী বিদ্যুতের ৪ লাখ গ্রাহক সৃষ্টি করতে ১ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরে প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১৪ সালে। নির্ধারিত সময়ে এ প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। বরাদ্দের ৭৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ অর্থ ব্যয়ের পর সংশোধন করে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। আগামী বছরে শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকা প্রকল্পটির বাস্তবায়ন তদারক করতে সম্প্রতি নিবিড় পরিবীক্ষণের আয়োজন করে আইএমইডি। প্রকল্পটি প্রণয়ন থেকে বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে অব্যবস্থাপনা, অবহেলা, অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ উঠে এসেছে পরিবীক্ষণের সমীক্ষায়।
এতে বলা হয়েছে, ১০ হাজার কিলোমিটার নতুন লাইনের মধ্যে এ পর্যন্ত স্থাপন হয়েছে ৯ হাজার ৬৫৪ কিলোমিটার। নির্ধারিত ৫০ উপকেন্দ্রের মধ্যে ১৬টির কাজ শেষ করে ২ লাখ ৭৮ হাজার গ্রাহককে বিদ্যুৎ দেওয়া হয়েছে। উপকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শেষ হলে বিপুল সংখ্যক গ্রাহক সৃষ্টি হতে পারে। তবে মিটার সঙ্কটের কারণে এ প্রকল্পের আওতায় নতুন গ্রাহককে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অথচ ৪ লাখ গ্রাহককে বিদ্যুৎ দিতে প্রকল্পের আওতায় ৪ লাখ মিটার কেনা হয়েছে। প্রকল্প চলমান অবস্থায় ১ লাখ ২২ হাজার মিটারের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অব্যবস্থাপনার কারণে সরকারের তহবিল থেকে বেশ কিছু খাতে বাড়তি অর্থ ব্যয় হয়েছে। উপকেন্দ্র নির্মাণ ও ট্রান্সমিটারে প্রযুক্তি নির্বাচনে দক্ষতা দেখাতে পারলে অন্তত ২৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা সাশ্রয় হতে পারত। সরেজমিন পরিদর্শনে লাইনে পোল কম পোঁতা, ৩৩ কেভি লাইনের অধিকাংশ স্প্যানে স্কাই ওয়্যার না থাকা, পোল হেলে থাকা, ভাঙা পোলের ব্যবহার ও নকশায় দুর্বলতার মতো বেশ কিছু ত্রুটি চিহ্নিত করা হয়েছে।
পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বেশিরভাগ লাইন রাস্তার পাশে তৈরি করা হয়নি। ট্রান্সফরমার উত্তোলন না করেই কিছু লাইন তৈরি হয়েছে। এসব লাইনে ট্রান্সফরমার উত্তোলন করে গ্রাহকদের সংযোগ দেবে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলো। নিজস্ব অর্থায়নে এ কাজ করবে সমিতি। এতে সমিতির স্বাভাবিক কাজকর্মে সমস্যা তৈরি হতে পারে। এ ধরনের লাইনে গ্রাহক হয়রানি, অসন্তোষ এবং অনিয়ম করার সুযোগ তৈরি হতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রকল্পের সুফল পেতে নতুন গ্রাহকরা বিভিন্ন ভোগান্তিতে পড়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, ৭১ শতাংশ গ্রাহক বিদ্যুৎ পেতে কোনো-না-কোনো ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। ভোগান্তির শিকার গ্রাহকদের অন্তত ৯৭ শতাংশ বিদ্যুৎ পেতে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য হয়েছেন। বিদ্যুৎ পেতে বাড়তি সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে ৭৮ শতাংশ গ্রাহককে। ৪৯ শতাংশ গ্রাহক আবেদনের এক মাসের মধ্যে বিদ্যুৎ পেলেও বেশি সময় লেগেছে ২৩ শতাংশ সংযোগে। ২৩ শতাংশ গ্রাহক আবেদনের এক মাসের বেশি সময়ে বিদ্যুৎ পেয়েছেন। আবেদনের ২ থেকে ৬ মাস পরে বিদ্যুৎ পেয়েছেন ১২ শতাংশ গ্রাহক। বিদ্যুৎ চেয়ে ছয় মাসের বেশি অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৬ শতাংশ গ্রাহককে।
তৎকালীন ঢাকা বিভাগের ২১ জেলায় বাস্তবায়নের জন্য পল্লী বিদ্যুতায়ন সম্প্রসারণ ঢাকা বিভাগীয় কার্যক্রম-২ শীর্ষক প্রকল্পটি প্রস্তাব করে বিদ্যুৎ বিভাগ। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। প্রকল্প প্রণয়নে দুর্বলতার দিক তুলে ধরতে গিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৬ উপকেন্দ্র চালুর আগে ৬৯ দশমিক ৫ শতাংশ গ্রাহককে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট ৩৪ উপকেন্দ্র নির্মাণ শেষ হলে কেন্দ্রগুলোর পুরো সক্ষমতা ব্যবহার সম্ভব হবে না। আরো কম উপকেন্দ্র নির্মাণের মাধ্যমে ৪ লাখ গ্রাহককে সংযোগ দেওয়া সম্ভব বলে মনে করে আইএমইডি।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড একই ধরনের বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ করছে। একই ঠিকাদারের কাছে বিভিন্ন প্রকল্পের একাধিক লাইন নির্মাণের কার্যাদেশ বিদ্যমান। যন্ত্রাংশের গায়ে প্রকল্পের নাম লেখা না থাকায় এক প্রকল্পের মালামাল অন্য প্রকল্পে সহজেই ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। নিবিড় পরিবীক্ষণের আওতায় আসা প্রকল্পের ১ লাখ ২২ হাজার মিটার এই সুযোগে অন্য কোনো প্রকল্পে ব্যবহার হচ্ছে বলে ধারণা করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।
এ বিষয়ে আইএমইডির সচিব মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার সরকারি লক্ষ্যের সঙ্গে প্রকল্পটির সঙ্গতি রয়েছে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে চার লাখের বেশি গ্রাহক নতুন করে বিদ্যুতের সংযোগ পাবেন। অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের বেশ কিছু পর্যায়ে দুর্বলতা দেখা গেছে। এসব বিষয় চিহ্নিত করে প্রতিবেদনটি সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পের কাজ মানসম্মত উপায়ে দ্রুত শেষ করতে প্রতিবেদনের সঙ্গে কিছু সুপারিশ জুড়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানান সচিব। এসব সুপারিশ মানা হলে প্রকল্পটি থেকে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
অবশ্য প্রকল্পটির পরিচালক আরইবির সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার আবদুর রহিম মল্লিক এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ বিষয়ে মোবাইল ফোনে কল করা হলে আরইবি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মঈন উদ্দিন কল রিসিভ করেননি। বিষয় উল্লেখ করে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও সাড়া দেননি আরইবি চেয়ারম্যান।