সন্ধ্যা হলেই রাজধানীর ফুটপাতে জ্বলে উঠে কয়েক লাখ বৈদ্যুতিক বাতি। স্থানীয় প্রভাবশালী ও একশ্রেণির দালাল এসব বিদ্যুৎ লাইনের সংযোগ দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। তাদের সাথে পকেট ভরছে ডিপিডিসির একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া গণহারে বিদ্যুৎ চুরি সম্ভব নয়। যা সিস্টেম লস হিসেবে দেখানো হচ্ছে। আর এসব লস নিয়মিত ভোক্তাদের কাছ থেকে সমন্বয় করছে কর্তৃপক্ষ।
অবৈধভাবে ব্যবহূত এই বিদ্যুৎ-এর সঠিক কোনো হিসাবও কারো কাছেই নেই। তবে ডিপিডিসি সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে প্রাপ্ত আনুমানিক হিসেবে দেখা যায়, শুধু ঢাকা শহরেই ডিপিডিসির (ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি) সরবরাহকৃত বিদ্যুতের ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অবৈধভাবে ব্যবহূত হচ্ছে। আর এ অবৈধ বিদ্যুতের অধিকাংশই ব্যবহার করা হচ্ছে রাতের বেলায় ঢাকার ফুটপাতে। ফুটপাতে বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য মিটারের ব্যবস্থা নেই। তাই কতটুকু বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে তারও কোনো হিসাব নেই।
জানা গেছে, ১ হাজার ৫২৯ বর্গ কিলোমিটারের ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রায় ১৬৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ফুটপাত। এসব ফুটপাতে সন্ধ্যা হলে লাখ লাখ বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে ওঠে। চলে গভীর রাত পর্যন্ত। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফুটপাতের বেশিরভাগ সংযোগই অবৈধ। তবে কিছু কিছু বৈধ সংযোগও আছে। অবৈধ সংযোগের জন্য ঢাকার কয়েকটি এলাকায় দালাল নিয়োগ করা আছে। তারাই নিজ এলাকার ফুটপাতের বৈদ্যুতিক সংযোগ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এজন্য তাদের কয়েক গুণ বেশি টাকা দিতে হয়।
একটি ২০ ওয়াটের এনার্জি সেভিং বাল্ব রাতে পাঁচ ঘণ্টা জ্বললে মাসে দুইশ টাকার বেশি বিল হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ফুটপাতে জ্বালানোর জন্য প্রতিদিন দিতে হয় বাল্বপ্রতি ৩০ টাকা। অর্থাৎ মাসে ৯শ টাকা। এই বাড়তি টাকা যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট দালাল, প্রভাবশালী, বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় মাস্তানদের পকেটে। রাজধানীর মতিঝিল, গুলিস্তান ও জুরাইন এলাকার ফুটপাতের হকারদের সাথে কথা বললে কয়েকজন হকার জানান, মিটার আছে কি নাই তা তাদের জানা নাই। বাল্বপ্রতি ৩০ টাকা করে তারা প্রতিদিন বিল দেন। রাস্তার হকাররা একটি এবং ফুটপাতের হকাররা তিনটি থেকে পাঁচটি লাইটও ব্যবহার করে। দালালকে সেই হিসাবেই টাকা দিতে হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিদিন এক বাতির জন্য দোকানিদের দিতে হয় ২৫ থেকে ৩০ টাকা। দুই বাতিতে ৫০ আর তিন বাতির বিল ৭০ টাকা। এই বিল বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকানি বলেন, বিদ্যুতের টাকা নেয় এটা যারা চালায় তারা। এক বাতি ৩০ টাকা নেয়। আরেক দোকানি বলেন, বিদ্যুৎ বিল ২৫ টাকা নিয়ে যায়।
পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানীর ফুটপাত ও রাস্তার সাড়ে তিন লাখ দোকানে প্রায় পাঁচ লাখ অবৈধ বিদ্যুৎ বাতি জ্বলে। বাতিপ্রতি গড়ে ২০ টাকা হিসেবে দিনে আদায় হয় এক কোটি টাকা। সে হিসাবে মাসে ৩০ কোটি আর বছর শেষে সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬০ কোটিতে।
হাতেগোনা কিছু বৈধ মিটার থাকলেও সেখানে খরচ কয়েক গুণ। ২০ ওয়াটের একটি বাতিতে মাসে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা বিল হলেও আদায় করা হয় ৬০০ থেকে ৯০০ টাকা। এক দোকানি বলেন, আমরা লাইন চালাই। কিন্তু এটা কোথা থেকে নিয়েছে, আমরা জানি না।
রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বর, সোনালী ব্যাংকের পেছনে, আলিকো ভবন থেকে মধুমিতা সিনেমা হল, দৈনিক বাংলা মোড় থেকে ফকিরেরপুল, বিমান অফিসের আশপাশে, রাজউক ভবনের সামনে, সড়ক ভবনের সামনে ও স্টেডিয়ামের গেটের দু-দিকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় কয়েক হাজার দোকান বসে। এসব দোকানে সন্ধ্যা হলেই হাজার হাজার বাল্ব জ্বলে। দোকানগুলোর আশপাশের মেইন লাইন থেকে বৈদ্যুতিক সংযোগ নেওয়া।
রাজধানীর গুলিস্তানের গোলাপশাহ মাজারের চারদিকের ফুটপাত আর রাস্তায় হাজারও দোকানে গভীর রাত পর্যন্ত আলো ঝলমলে থাকে পুরো এলাকা।
যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার সামাদ সুপার মার্কেট হতে শহীদ ফারুক রোডের খানকা শরীফ মসজিদ পর্যন্ত প্রধান সড়কে ও ফুটপাতে রয়েছে ছোটবড় প্রায় তিন-শ দোকান। আর এসব দোকানে প্রতিদিন ব্যবহূত হচ্ছে ৩ শতাধিক বৈদ্যুতিক বাতি বা লাইট। এসব বাতি জ্বালাতে বাসাবাড়ির আবাসিক একটি মিটার থেকে বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ সংযোগ দিচ্ছে একটি চক্র। এই একটি মিটার দেখিয়ে তারা অবৈধ বিদ্যুৎ দিয়ে চাঁদাবাজি করছে বলে জানা যায়। শুধু তাই নয়, এই রাস্তার পাশে অবস্থিত কয়েকটি বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে অবৈধভাবে লাইন টেনে প্রায় তিনশ বাতিতে সংযোগ দিয়ে আসছে চক্রটি। বিনিময়ে তারা প্রতি বাতি থেকে প্রতিদিন চাঁদা নিচ্ছে বাতিভেদে ৩০ থেকে ৪০ টাকা।
এ চক্রের মূলহোতা আওলাদ হোসেন। তার সাথে রয়েছে ফায়েম ওরফে অস্ত্র ফায়েম, শাকিল ওরফে চাঁদাবাজ শাকিল, শফি ওরফে বাবা শফি ও শামু ওরফে বোম শামু। এরা স্থানীয় প্রভাবশালী বলে জানা যায়। এরা এতই ক্ষমতাবান যে, ১০৪/এ শহীদ ফারুক সড়ক, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর মুন্না নামের একজনের বাড়ির আবাসিক বৈদ্যুতিক মিটার এই চক্রের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হন। মুন্নাও বিক্রয়ের কথা স্বীকার করেন। আর এই মিটার দিয়েই অবৈধভাবে ফুটপাতের দোকানের কিছু বাতির সংযোগ দেওয়া হয়। অন্যদিকে একসময় এসব দোকানের বাতিতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া ইয়াছিন মিঠু নামক এক ব্যক্তির বাণিজ্যিক দুইটি মিটারের সংযোগ কেটে দেয় চক্রটি। এব্যাপারে মিঠু বলেন, তারা আমার বৈধ মিটারের লাইন কেটে দেয়। আমি প্রতিবাদ করলে আমাকে দুইবার মারধর করে ও মেরে ফেলার হুমকি দেয় চক্রটি।
এ প্রসঙ্গে স্বামীবাগ ডিপিডিসি-র নির্বাহী প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন জানান, এখানে আমাদের কেউ জড়িত নয়। যদি কেউ জড়িত থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা এসব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।
এদিকে ফুটপাতের দোকানে বিদ্যুৎ খরচের বেশির ভাগ হিসাব নেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে। এক কর্মকর্তা বলেন, ফুটপাতের ওপর যেসব দোকান অবৈধভাবে করে, সেখান থেকে কোনো সংস্থার কোনো প্রকার অর্থ নেওয়ার সুযোগ নাই। কেউ কেউ যদি নিয়ে থাকে সেগুলো অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান বলেন, এগুলো বন্ধে গত মাসে আমরা অভিযান চালিয়েছি। কিছু কিছু অসাধু লোক আছে, তারা এসব করছে। তাদের পেছনে আমরা আছি। শুধু রাজধানীতেই নয়, বেশির ভাগ জেলা শহরের একই চিত্র।
ডিপিডিসি সূত্র জানায়, বিদ্যুৎ আইন ২০১৮-এর ৩৮(খ) ধারা অনুযায়ী লিখিত অনুমতি ব্যতীত মিটার থেকে কোনো ব্যক্তিকে পার্শ্ব সংযোগ দিলে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। আবাসিক, বাণিজ্যিক, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, স্ট্রিট লাইটের জন্য ৫শ টাকা, সেচ সংযোগ-৫ হাজার টাকা, শিল্পকারখানা (৪৫ কেভিএ পর্যন্ত)-৭ হাজার ৫শ টাকা, শিল্পকারখানা (৪৫ কেভিএ থেকে ৭৫ কেভিএ পর্যন্ত) শিল্প কারখানা (৭৫ কেভিএ-এর ঊর্ধ্বে) ১৫হাজার টাকা। কিন্তু ফুটপাতের ক্ষেত্রে এসব বিধান শুধু কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিতরণ সংস্থার অসাধু সদস্যদের সহায়তায় এই বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন প্রভাবশালীরা। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, এভাবে ব্যবহার হওয়া বিদ্যুৎ তারা সিস্টেম লসে দিয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি ভোক্তাদের কনজাম্পশন বেশি দেখিয়ে দিচ্ছে। এসব লস নিয়মিত ভোক্তাদের কাছ থেকে সমন্বয় করছে।