মুক্তমত

বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন চাই

  • অনলাইন ডেস্ক
  • প্রকাশিত ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৩

রুহুল ইসলাম টিপু:

১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস অনুষ্ঠিত হয়েছে । ৫২তম বিজয় বার্ষিকী উদযাপনে দেশে এখনও সাজ সাজ আয়োজন। বিজয় দিবস স্বাধীনতা দিবস শহীদ দিবস জাতীয় শোক দিবসসহ দেশের দিবসগুলো বাংলাদেশ বাঙালিকে নাড়িয়ে দেয়। স্মরণে আসে নানান কথা। দেশের কথা। দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সম্বলিত এলাকা অঞ্চল। মুক্তিযোদ্ধাদের তিতিক্ষা, কৌশল, সংগঠন, বীরত্ব, আত্মত্যাগ জীবন উৎসর্গ মনের আঙিনায় ভেসে বেড়ায়। হানাদার বাহিনীর নিপীড়ন, উৎপীড়ন, পৈশাচিক নির্যাতন, রাজাকার, আল-বদর বাহিনী, এদেশের দোসর কর্তৃক ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ, মানুষ হত্যার বর্বরতার ঘটনা মন বিষিয়ে দেয় ভরাক্রান্ত করে তোলে। নানান কথা বিচিত্র বিষয় একাত্তর হচ্ছে বাঙালির চেতনা ও ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ এর বিশালতা হচ্ছে সমুদ্রকে হার মানানো আকাশের সীমাহীন দিগন্ত। এবারের বিজয় দিবসে আরেক মাত্রা যুক্ত হচ্ছে- দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সন্নিকটে। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন এর ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী- ০৭ জানুয়ারি ২০২৪ এ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাতীয় নির্বাচন। চলছে প্রার্থীদের আপীল কার্যক্রম। মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৭ ডিসেম্বর। এর পরদিন প্রতীক বরাদ্দ। প্রচারণা চলবে ০৫ জানুয়ারী ২০২৪ পর্যন্ত। ভোট এবং গণতন্ত্র সেতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নিবিড়তম সম্পৃক্ততা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি ’৭০ এর সাধারণ নির্বাচনের ভিত্তি। মানুষের মুক্তির জন্য মুক্তিযুদ্ধ। পরাধীনতার শিকলে আটকে ছিল জাতি। দেশের তরে এ জাতির জন্য মানুষের ছিল অফুরন্ত ভালোবাসা। দেশের সূর্য সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের বিনিময়ে দেশ রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ’৭১ এর পিছনের ইতিহাস বড় লম্বা। বেঙ্গল প্যাক্ট ১৯২৩ থেকে শুরু করে নেহেরু রিপোর্ট ১৯২৮, জিন্নাহর ১৪ দফা ১৯২৮, লাহোর প্রস্তাব ১৯৪০, পাকিস্তান প্রস্তাব ১৯৪৬, কেবিনেট মিশন ১৯৪৬, যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা ১৯৫৩, পূর্ববঙ্গ শ্মশান কেন? ১৯৫৫, ভাসানীর ২৪ দফা ১৯৫৫, ন্যাপের ১৪ দফা ১৯৬৫, শেখ মুজিবের ৬ দফা ১৯৬৬, সিপিইপি (এমএল) এর ৮ দফা ১৯৬৭, পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের ১১ দফা ১৯৬৮, কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্নয় কমিটির ২০ দফা ১৯৬৯, সংগ্রামী ছাত্র সমাজের ১১ দফা ১৯৬৯, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ১৯৭১ সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

 

উত্তাল মার্চ হতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হওয়ার সাথে সাথে- মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। ০২ মার্চ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলা হলো। ০৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের জনসভায় জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি নির্বাচন করা হলো। দেওয়া হয় কারফিউ- মানুষ জীবন বাজি রেখে নেমে পড়ে পথে। সেনাবাহিনীর গুলিতে মানুষ মারা যাচ্ছে তারপরও কেউ থেমে থাকেনি। তবুও মানুষের মুখে উচ্চারিত হতে থাকে স্বাধীনতার শ্লোগান : ‘জয় বাংলা’, বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ ২৫ মার্চ একাত্তরে গণহত্যা শুরুর পর বাংলাদেশের কেউই নিরাপদ ছিল না। কমান্ডো বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে যায়। এর পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার আহŸান জানান। স্বাধীনতার ঘোষণাটি তৎকালীন ইপিআর এর ট্রান্সমিটারে করে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। যখন ঘোষণাটি প্রচারিত হয়, তখন মধ্যরাত পেরিয় ২৬ মার্চ হয়ে যায়। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হচ্ছে ২৬ মার্চ।

 

গতকালই পথের পাশ থেকে আয়লা-বিদ্যানগর গণহত্যা- তানভীর সালেহীন ইমন এবং ডাঙ্গা গণহত্যা- সুরাইয়া আক্তার বই ক্রয় করি। কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার আয়লা ও বিদ্যানগর গ্রামের গণহত্যা এবং নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার ডাঙ্গা উইনিয়নের গণহত্যার তালিকা ছবি এবং বর্বরোচিত হামলার ঘটনা পড়ে ও ছবি দেখে চোখে ঝাপছা দেখতে থাকি। মানিকগঞ্জের গণগত্যা, চুকনগরের গণহত্যা, মিরপুরে গণহত্যা, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের গণহত্যাসহ সহ¯্রাধিক গণহত্যার ঘটনার সাক্ষী বাংলাদেশ। ৩০ লক্ষ শহীদানের রক্তের মাটিতে বসবাস এদেশের সকল মানুষের। পরিসংখ্যান হচ্ছে- স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০ হাজার, মিলিশিয়া বাহিনী ছিল আরো ২৫ হাজার, বেসামরিক বাহিনী প্রায় ২৫ হাজার, রাজাকার, আলবদর, আলসামশ আরো ৫০ হাজার। মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ৭৫ হাজার। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রায় আড়াই লক্ষ নারী পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর তাদের পদলেহী বিশ^াসঘাতক দেশদ্রোহীদের নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। ১ কোটি মানুষ দেশত্যাগ না করলে তাদের প্রত্যেকেই হয়ত এদেশে হত্যা করা হতো।  

 

বিজয় দিবসে স্বাধীনতার আনন্দ এবং বিজয়োৎসব যেমন জাতির উচ্ছ¡াস উল্লাসকে বাড়িয়ে দেয়। তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের চিরতরে হারিয়ে এদেশের মানুষের হত্যা লাশের উপর দাাঁড়িয়ে নতুন করে দেশ বিনির্মাণের কঠিন এক ব্রত এসে পড়ে বাঙালির জীবনে। তবুও দেশের সকল মানুষের সৌভাগ্য-বিজয়ের মাত্র ১০ মাস ১৮ দিনের মধ্যে ০৪ নভেম্বর ১৯৭২ এ প্রণীত হয় বাংলাদেশের সংবিধান। রাষ্ট্রের তিনটি প্রধান বিভাগ- নির্বাহী বিভাগ বা শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগ। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলমন্ত্র জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ইতোমধ্যে দেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করেছে। একই সময়ে রাষ্ট্র পালন করেছে জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ মুজিববর্ষ। মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অবিনাসূত্রে গাঁথা। ঠিক এ-ই সময়ে যুক্ত হয়- জাতির জীবনের অন্যতম অর্জন স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ।

 

মুক্তিযোদ্ধা  কল্যাণ ও  মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে বর্তমান অর্থবছর ২০২৩-২৪ এর বাজেটে বলা হয়েছে, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, স্মৃতি ও স্মারক সংরক্ষণে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। জীবিত মুক্তিযোদ্ধা এবং মৃতদের ক্ষেত্রে পরবর্তী সুবিধাভোগীদের নাম-পরিচিত নিশ্চিত করে তাঁদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংবলিত প্রস্তুত করা হয়েছে। বিনা মূল্যে বিতরণের জন্য ৩০ হাজার ‘বীর নিবাস’ নির্মাণের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে ৫ হাজার নিবাস হস্তান্তর করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থানসমূহ সংরক্ষণ ও স্মৃতি যাদুঘর নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ৬৪ জেলার ২৯৩টি উপজেলার ৩৬০ টি স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ/যাদুঘর নির্মাণ করা হচ্ছে।

 

মহান মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশে এখনও দারিদ্র্য। এটা মেনে নেওয়া যায় না। মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে জাতির প্রত্যাশা ছিলো দারিদ্র্য থাকবে যাদুঘরে। ২০২২ এ দারিদ্র্য হার ১৮.৭ শতাংশ। ২০১০ এ ছিলো ৩৫.২ শতাংশ। ২০২২ এ চরম দারিদ্র্য হার ৫.৬ শতাংশ। ৫০ বছরে দারিদ্র্য কমেছে ৭০ শতাংশ। ১৯৭২ সালে আমাদের দারিদ্র্যের হার ছিল ৯০%। বাংলাদেশ তো পৃথিবীতে একা চলে না। চলতে হয় বৈশি^ক পরিবার নিয়ে। কোভিড, ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ কমে যাওয়া, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ, নানাবিধ চ্যালেঞ্জও রয়েছে আগামীর বাংলাদেশের নিকট। তারপরও বিজয় বলে কথা। এদিন তো বাংলাদেশ এবং বাঙালি মাতোয়ারা হবেই। 

বাংলাদেশের বিজয়ের ৫২ বছরের লাল সবুজের মহোৎসব চলছে। বিজয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন চাই। আবারও জেগে উঠতে চাই। বলতে চাই প্রিয় জন্মভূমি। আমার সোনার বাংলা। তোমায় ভালোবাসি। 

 

উন্নয়ন কর্মী ও কলাম লেখক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads