পৃথিবীতে মানুষ বাড়ছে। বাড়ছে তাদের দৈনন্দিন চাহিদা। বাড়তি চাহিদা মেটাতে বাড়ছে যন্ত্রের ব্যবহার। সেগুলো চালাতেও দরকার হচ্ছে বাড়তি জ্বালানির। অল্প কিছু ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার শুরু হলেও এক্ষেত্রে এখনো প্রধান ভরসা জীবাশ্ম জ্বালানি। তবে পৃথিবীতে জ্বালানির উৎস অসীম নয়। মাটির নিচে জমে থাকা জীবাশ্ম জ্বালানির ভান্ডার কমে আসছে দিন দিন। পেট্রোলিয়াম নামে পরিচিত এসব জ্বালানি পরিবেশ দূষণ ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিশেষ ভূমিকা রাখে বলে দীর্ঘদিন ধরে বিকল্প উৎসের কথা ভাবছেন গবেষকরা। শুরু করেছেন নানা গবেষণা ও অনুসন্ধান। সেই ধারাবাহিকতায় বিকল্প জ্বালানি হিসেবে আসে মিথেন হাইড্রেটের নাম। সাধারণ প্রাকৃতিক গ্যাসের তুলনায় ১৬৪ গুণ বেশি শক্তির জোগান দিতে পারে এটি। দেখতে বরফের মতো হওয়ায় গবেষকরা এর নাম দিয়েছেন ‘দাহ্য বরফ’।
সাধারণত ভূগর্ভে বা সমুদ্রের তলদেশে নিম্নতাপ ও উচ্চচাপে মিথেন হাইড্রেট গঠিত হয়। জমাট বরফের অণু দিয়ে তৈরি জালের মধ্যে আটকে থাকা হিমায়িত মিথেন গ্যাসই যৌগটির প্রধান উপাদান। যেটি সরাসরি আগুন জ্বালাতে ব্যবহার করা যায় আবার প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে এর থেকে পাওয়া যায় মিথেন গ্যাস।
এ বিষয়ে বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী নিউ সায়েন্টিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভূগর্ভস্থ হিমায়িত অঞ্চল বা সাগরের তলদেশে প্রচণ্ড চাপে ও অত্যন্ত নিম্নতাপমাত্রায় মিথেন হাইড্রেট তৈরি হয়। জীবাশ্ম জ্বালানির মধ্যে এটির এখনো ব্যবহার করা হয়নি। সারা বিশ্বে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের মোট পরিমাণ যেখানে প্রায় ৫ হাজার টিসিএফ, সেখানে মিথেন হাইড্রেটের পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন টিসিএফ। এছাড়া সাধারণ প্রাকৃতিক গ্যাসের তুলনায় ১৬৪ গুণ বেশি শক্তির জোগান দিতে পারে মিথেন হাইড্রেট। সবচেয়ে বড় কথা জীবাশ্ম জ্বালানি হলেও এটিকে সবুজ জ্বালানি বিবেচনা করা হয়। এটি পোড়ালে তেল বা কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানির প্রায় অর্ধেক কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয়।
যৌগটির মজুদের সন্ধানে ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো জার্মানির একটি অনুসন্ধানী দল সমুদ্রে অনুসন্ধান শুরু করে। তবে ২০১৩ সালে জাপানের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে সমুদ্রের গভীরে নরম কাদার মতো বরফে পরিণত হওয়া মিথেন গ্যাসের ভান্ডার খুঁজে পান দেশটির গবেষকরা। সে বছর উপকূল থেকে মিথেন হাইড্রেট সংগ্রহ করার লক্ষ্যে পরীক্ষামূলক অভিযানে নামে জাপান ওয়েল, গ্যাস অ্যান্ড মেটালস ন্যাশনাল করপোরেশন। সমুদ্র তলদেশের ৩০০ মিটার গভীর থেকে মিথেন হাইড্রেট উঠিয়ে এনে কয়েক হাজার কিউবিক মিটার গ্যাস আহরণে সফল হয় জাপান। বিশ্বের অন্যতম বড় প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানিকারক দেশটি তখন জানায়, প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত নানকাই অঞ্চলে যে পরিমাণ মিথেন হাইড্রেট রয়েছে, তা জাপানে ১০০ বছরের প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা মেটাতে পারে। এছাড়া ওই প্রযুক্তি পুরো এশিয়ার জ্বালানি গ্যাসের চাহিদা মেটাতে অবদান রাখতে পারে।
২০১৭ সালেও দেশটি মিথেন হাইড্রেটের সন্ধানে আরেক দফা অনুসন্ধানে নামে। সে সময়ও দেশটির উপকূলীয় এলাকায় বিপুল পরিমাণে সন্ধান মেলে এই যৌগটির। ওই বছর ডিসেম্বর মাস থেকে পুরোদমে কাজ শুরু করে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিথেন হাইড্রেট থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আহরণে যৌথভাবে কাজ শুরু করে জাপান। দেশ দুটির গবেষকরা এর প্রায়োগিক ব্যবহারে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন।
এ বিষয়ে হাইয়াই ন্যাচারাল এনার্জি ইনস্টিটিউটের সাবেক গবেষক আই ওসাইমা সম্প্রতি বিবিসিকে বলেছেন, জাপানের এই উদ্যোগটি নিয়ে অনেকেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। স্বাগত জানিয়েছেন। জাপানিদের আশা, এ খাতে সফলতা এলে জ্বালানির জন্য আর কোনো দেশের ওপর নির্ভর করতে হবে না। বিষয়টি নিয়ে একটা জটিলতার কথাও উল্লেখ করেন তিনি। তার মতে, অধিক পরিমাণে মিথেন হাইড্রেট আহরণ করতে হলে সমুদ্রের তলদেশে বিস্ফোরণ হয়ে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। যার ফলে সৃষ্টি হতে পারে সুনামির মতো বিপর্যয়।
যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে পরিচালিত গ্যাস হাইড্রেট প্রকল্পের প্রধান ক্যারোলিন রাপ্পিলও তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন, বিষয়টি নিয়ে জনমনে শঙ্কা রয়েই গেছে। তাদের ধারণা, সমুদ্র তলদেশ থেকে একবার মিথেন গ্যাস উিগরণ হতে শুরু করলে তা আর থামানোর কোনো সুযোগ থাকবে না। ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় হতে পরে।
তবে প্রকৌশলগত সব বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে, নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্ছিদ্র না করে গবেষকরা সমুদ্রের তলদেশ থেকে এই মিথেনের বরফ তোলা শুরু করবেন না বলে জানান ক্যারোলিন রাপ্পিল।
এদিকে ২০১৭ সালে দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মিথেন হাইড্রেট উত্তোলনে সফল হয় চীন। পরে শেনহু এলাকায় বসানো ভাসমান শোধনাগারে সেই ‘দাহ্য বরফ’কে প্রাকৃতিক গ্যাসে রূপান্তর করেন চীনের প্রকৌশলীরা। সে সময় দেশটির ভূমি ও সম্পদ মন্ত্রণালয় বলে, এই সাফল্য দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বড় ভূমিকা রাখবে। দেশটির ভূমি ও সম্পদমন্ত্রী শিয়াং দামিং বলেন, বিশ্বে জ্বালানি শিল্পে বিপ্লব ঘটিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা এটি।
চীন ও জাপান দুই দেশই পরিকল্পনা করছে ২০৩০ সালের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে মিথেন হাইড্রেট থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আহরণের প্রক্রিয়া।