নির্বাচনী ডামাডোলে দেশ। কিন্তু ভেতরে ভেতরে অস্বস্তিতে বিএনপি। দলীয় চেয়ারপারসন কারাগারে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন সাজাপ্রাপ্ত হয়ে দেশের বাইরে। এ সময়ে ঐক্যফ্রন্টের নামে মূলত বিএনপি নেতাকর্মীদের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ঐক্যফ্রন্টের হাল ধরানো হয়েছে ড. কামাল হোসেনকে দিয়ে। ঠিক এই জায়গাটিতেই শুরু থেকে আস্থা-অনাস্থায় বিভক্ত বিএনপির শীর্ষ ও নির্বাহী কমিটির নেতারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির একাধিক নেতা বলেছেন, প্রথম থেকেই খালেদা ও তারেকপন্থিরা ড. কামালের বিষয়টিকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। পরে মন্দের ভালো আর দলের সঙ্গে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা- এসব বিষয় বিবেচনা করে অনেকটা ঢেঁকি গেলার মতো মেনে নিয়ে এখন অপেক্ষায় আছেন এসব নেতারা। এর মধ্যে তাদের বোঝানোও হয়েছে, যেহেতু ড. কামালের একটি গ্রহণযোগ্যতা আছে আন্তর্জাতিক মহলে— এটিকে ব্যবহার করে নির্বাচনের আগেই সরকারকে চাপের মুখে রেখে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা সহজ হবে। তা ছাড়া ঐক্যফ্রন্ট মূলত হবে বিএনপিরই আরেক চেহারা।
ড. কামালের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার মানে হচ্ছে বিএনপির ক্ষমতায় আসা এবং বেগম জিয়ার মুক্তি। ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচিত হলে প্রথম কাজ হবে বেগম জিয়ার মুক্তি, এরপরই দেশে ফেরাবেন তারেক রহমানকে। ছেড়ে দেওয়া কোনো আসন থেকে উপনির্বাচনে জয়ী করে সরকার পরিচালনা হবে আবার জিয়া পরিবার থেকেই। এ বিষয়টি জেলখানায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকেও বোঝানো হয়। যে কারণে ড. কামালকে দিয়ে বলানো হয়েছিল— তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না। হয়েছিলও তা-ই, সরকার সংলাপে রাজি হয়েছিল। ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সঙ্গে সঙ্গে সরকারকে সংলাপের চিঠি এবং সরকারের তড়িৎগতিতে সংলাপে বসে যাওয়া, খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রস্তাব, সংলাপের আগে খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে আসা, এ সবই ছিল পূর্বনির্ধারিত। বিএনপির একটি অংশও এ বিষয়ে অবগত ছিল। তবে খালেদা জিয়া মুক্ত হয়ে এলে সারা দেশে বিএনপির নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হবে, তাই প্রথম থেকেই এ পথে হাঁটতে চায়নি সরকার।
বিএনপির একটি অংশ খালেদা-তারেকমুক্ত বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসার পরিকল্পনায় সরকারের সঙ্গে জড়িত। সে মোতাবেক বিএনপির একটি অংশের তরফ থেকে খালেদা ও তারেকপন্থি নেতাদের একটি তালিকাও তৈরি করে দেওয়া হয়েছে সরকারের কাছে। এসব নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের নেতারা এতটাই দ্বিধান্বিত ছিল যে, সংলাপের পর ড. কামাল ও মির্জা ফখরুলের দু’রকম বক্তব্য হয়ে যায় কি-না।
সূত্রমতে, তাদের জল্পনা-কল্পনা ফাঁস হয়ে যায় ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের কারণে। অযাচিতভাবে ঐক্যফ্রন্টে আসার কারণে সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকায় এবং অতিকথনের ফলে পুরো প্রক্রিয়াটি যেন এলোমেলো হয়ে না যায়, সে কারণে নারীবাদী আন্দোলনের নামে তাকে সরিয়ে রাখা হয়েছে পুরো প্রক্রিয়া থেকে। তাকে যেতে হয়েছে কারাগারে। জামিনযোগ্য মামলায় নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তাকে কারাগারেই থাকতে হবে এমনটাই মনে করছেন সুশীলদের অনেকেই। তার প্রমাণ হিসেবে অনেকেই বলছেন, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের একটি ফোনালাপ মিডিয়ায় ফাঁস করে মূলত তারেক রহমানকে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। তাতে মইনুল হোসেনকে বলতে শোনা গেছে— তারেক রহমানকে সরাতেই মূলত তারা ঐক্যফ্রন্ট করেছেন এবং ড. কামালকে সামনে এনেছেন। এই অডিও ক্লিপটি তারেক রহমানের কাছে পাঠানো হয়েছিল দলের একাংশের তরফ থেকে। কারণ ড. কামাল হোসেনের ঐক্যফ্রন্টে আসার মূল শর্ত ছিল তারেক রহমানকে সম্পূর্ণরূপে নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা। তারেক রহমান সেই শর্তেই রাজি হয়ে কথাও দিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই মির্জা ফখরুলকে টেলিফোন করে তিনি বলেন, মনোনয়নপ্রার্থী সবার সাক্ষাৎকার তিনি গ্রহণ করবেন এবং হয়েছেও তা-ই। মূলত দলের জন্য বিশ্বস্ত কট্টরপন্থ্থি নেতাদের পরামর্শেই তারেক রহমান এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
মূলত বিদেশি কিছু দূতাবাস, দেশীয় কিছু সুশীল ও সংস্কার লালনকারীদের খালেদা-তারেকবিহীন বিএনপির স্বপ্ন দেখা নেতাদের একাংশের প্রচেষ্টার ফসল এই ঐক্যফ্রন্ট। এর মধ্যেই শেষ হয়েছে মনোনয়ন ফরম বিক্রি ও সাক্ষাৎকার গ্রহণের কাজ। লন্ডন থেকে তারেক রহমান যুক্ত ছিলেন পুরো সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়ার সঙ্গে। কিন্তু আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করেই জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে জোট গঠন করেছেন ড. কামাল হোসেন। ঐক্যে জামায়াত ছাড়া সবার জন্য পথ খোলা রয়েছে বলেও জানানো হচ্ছে। নির্বাচনে এ ঐক্যকে ট্রাম্পকার্ড হিসেবে দেখছে বিএনপি। তবে দলটি জামায়াতবিষয়ক শর্তটি কতটুকু আমলে নেয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
যত নাটকই করুক শেষ পর্যন্ত এরা বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজি করাবে। এই সরকারকে বৈধতা দেওয়ার জন্যই এর সঙ্গে যুক্ত বিএনপির একটি অংশ। যে কারণে সংস্কারপন্থিদের আবার দলে ভেড়ানো হচ্ছে। একসময়ের বিএনপির ডাকসাইটে নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা বলেছেন, বিএনপির অভ্যন্তরে ক্যু ঘটানো হয়েছে। একই রকম বক্তব্য দলের জিয়া পরিবারপন্থি একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশের খবরকে বলেছেন, বিএনপির একটি মহল মূলত সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। সরকারকে বৈধতা দিতে যে কোনো প্রক্রিয়াতেই তারা নির্বাচনে যাবে। কিছু নেতার তালিকা করা হয়েছে জিয়া পরিবারের একনিষ্ঠদের নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে রাখতে এবং সরকারের আনুকূল্যে আসা নেতাদের সুবিধা দিতে, যাদের নির্বাচনের মাঠে কোনো গ্রহণযোগ্যতাই নেই। সরকারের তরফ থেকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে তালিকা অনুযায়ীই চলছে মামলা আর গ্রেফতারি কার্যক্রম।
ক্যু প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে নীলনকশা অনুযায়ী বিএনপিতে চলছে এখন ইঁদুর-বিড়াল খেলা। এর অংশ হিসেবেই পল্টনে পুলিশের সঙ্গে গণ্ডগোল, মির্জা আব্বাস ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা এবং জামিন, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলামের মামলায় দুপুরে রায়, রাতে গ্রেফতার। তবে সরকার ও বিএনপির ভেতরের একাংশের পরিকল্পনা সেদিনই পরিষ্কার আঁচ করতে পেরেছে বিএনপির হাই কমান্ড। আর এ কথাটি নিজের অজান্তে প্রথম ফাঁস করে দিয়েছিলেন অযাচিতভাবে ফ্রন্টে এসে যোগ দেওয়া ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। ফাঁস হওয়া টেলিফোন আলাপে শোনা যায়, তিনি বলছেন, ‘অমুক নেতাকে ফ্রন্টে আনা হয়েছে তো তারেক রহমানের নেতৃত্ব ঠেকানোর জন্য।’ থলের বিড়ালটি তখনই বেরিয়ে যায়। বেরিয়ে আসে বিকল্প ভাবনার ধ্বজাধারীদের কার্যক্রমের তথ্য-উপাত্ত। এ ঘটনাটি তারেক রহমানসহ সবাই যে বুঝে গেছেন, তার প্রমাণ মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার মাধ্যমেই তারা বুঝিয়ে দিয়েছেন। ওই নেতা আরো বলেন, ‘আমি বলব, বিএনপির ভেতরের এই ঘটে যাওয়া ক্যু থেকে আমরা কতটা শিক্ষা নিয়েছি, তার ওপরই নির্ভর করবে বিএনপি তথা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ আর আমাদের পথচলা।’
লেখক : বিশেষ প্রতিনিধি, বাংলাদেশের খবর