চলতি রবি মৌসুমে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) বোরো ধানসহ বিভিন্ন ফসলের প্রায় ৪৩ হাজার ৭৭৮ মেট্রিক টন বীজ অবিক্রীত রয়েছে। উচ্চ ফলনশীল জাতের এ বিপুল পরিমাণ বীজ কাজে না লাগায় প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর এই কারণে সরকার পড়তে যাচ্ছে প্রায় দুই হাজার ১৪৭ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির মুখে। শুধু তাই নয় চলতি অর্থবছরে খাদ্য নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ারও আশঙ্কা করছেন অনেকে।
বিএডিসি সূত্র জানিয়েছে, যে বিপুল পরিমাণ বীজ বিক্রি হয়নি তার বাজার দরই প্রায় ১৭০ কোটি ৪৪ লাখ ৩৩ হাজার ১২১ টাকা। এর সঙ্গে ১০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্য উৎপাদন কম হলে ২০ টাকা কেজি দরে ক্ষতি হবে প্রায় এক হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মজুত বীজের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৭ হাজার ৬৬৫ দশমিক ১৯৬ মেট্রিক টন। এই বীজের মধ্যে রয়েছে আউশ, আমন, বোরো, গম, ভুট্টা (খৈ ভুট্টা), ভুট্টা (হাইব্রিড), আলুবীজ, ডালবীজ, তৈলবীজ, শীতকালীন সবজিবীজ, মসলা (পেঁয়াজবীজ), মসলা (পেঁয়াজ বাল্ব), গ্রীষ্মকালীন সবজিবীজ, সরগম, বার্লি ও পাটবীজ। এসব উচ্চ ফলনশীল বীজ বিএডিসির সারা দেশের ২২টি অঞ্চলে ৮ হাজার ৫৩৬ ডিলার এবং ১০০টি বীজ বিক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে কৃষকদের মধ্যে বিক্রি করা হয়ে থাকে। কিন্তু এ বছর চলতি রবি মৌসুমে অবিক্রীত বীজ রয়েছে ৪৩ হাজার ৭৭৮ দশমিক ৮৩৮ মেট্রিক টন।
এর মধ্যে চলতি বছর বোরো ধানের বীজ বিক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬৪ হাজার ১৪৭ দশমিক ৮১২ মেট্রিক টন। তার মধ্যেই অবিক্রীত রয়ে গেছে ২৫ হাজার ৪১১ দশমিক ৭৭৫ মেট্রিক টন। যার মূল্য ১১০ কোটি ৩২ লাখ ৯৮ হাজার ৩২৮ টাকা। এ ছাড়া গম বীজ ১০ হাজার ৩৯৮ দশমিক ৬৮৩ মেটিক টন, ভুট্টাবীজ (খৈ ভুট্টা) ৫ দশমিক শূন্য ২০ মেট্রিক টন, ভুট্টাবীজ (হাইব্রিড) ৬ দশমিক ৩১০ মেট্রিক টন, আলুবীজ ৫ হাজার ৮০ দশমিক ৬৮৩ মেট্রিক টন, ডালবীজ ৪৭০ দশমিক ৮০৫ মেট্রিক টন, তৈলবীজ ৩১ দশমিক ৭৩০ মেট্রিক টন, শীতকালীন সবজিবীজ ১৭ দশমিক ২৬২ মেট্রিক টন, মসলা (পেঁয়াজবীজ) ১ দশমিক ১০৬ মেটিক টন, মসলা (পেঁয়াজ বাল্ব) ৯৩ দশমিক শূন্য ৪০ মেট্রিক টন, গ্রীষ্মকালীন সবজিবীজ ২৪ দশমিক ৯৯৪ মেট্রিক টন এবং সরগম ৪ দশমিক ১৫৬ মেট্রিক টন।
বিপুল পরিমাণ গুণগত মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহার না হওয়ায় খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এই কারণে ৯ লাখ ৮৩ হাজার ৭৩ দশমিক ৭৮৬৪ মেটিক টন ফলন কম হবে।
বিএডিসির বীজ উৎপাদন ও বিপণনের সক্ষমতা থাকার পরও বিপুল পরিমাণ বীজ বিক্রি না হওয়ায় বিএডিসির বীজ ও উদ্যান উইংয়ের সদস্য পরিচালক মো. মাহমুদ হোসেন এবং মহাব্যবস্থাপক (বীজ) মো. ফারুক জাহিদুল হকের অদক্ষতা এবং গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া বীজ বিক্রয়কাজে সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে বিক্রয় মৌসুমের পূর্বে ও মাঝপথে বদলি করায় মাঠপর্যায়ে এর প্রভাব পড়েছে বলে জানিয়েছে সূত্র।
কর্তৃপক্ষের গাফিলতি এবং ভুল সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে বিএডিসির ডিলাররা অভিযোগ করে বলেন, বিএডিসির বীজ উইংয়ের সাবেক সদস্য পরিচালক এবং মহাব্যবস্থাপক (বীজ) দায়ী। তারা সঠিক সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় সরকারি বীজ কৃষকরা ব্যবহার করতে পারেনি।
বিএডিসির সাবেক এক মহাব্যবস্থাপক (বীজ) নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বোরো মৌসুমের শুরুতেই যদি সঠিকভাবে মনিটরিং করা হতো তাহলে এত বীজ অবিক্রীত থাকার কথা নয়। অক্টোবর থেকে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বোরো বীজ রোপণ শুরু হয়। এরপর আর রোপণের সময় থাকে না।
বিএডিসি বীজ ডিলার অ্যাসোসিয়েশন কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের সভাপতি মো. আতাউর রহমান বিএডিসির চেয়ারম্যান বরাবরে বীজের মূল্য কমানোর দাবিতে বোরো মৌসুমের শুরুর দিকে গত ১৮ অক্টোবর একটি লিখিত আবেদন করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, এবার বিএডিসির ধানবীজের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ টাকা কেজি। অথচ খোলা বাজারে এখন খাবার ধান ১৭ টাকা কেজি। গমবীজের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৬ টাকা কেজি। আবেদনে ধানবীজ ৩৫ টাকা কেজি, গমবীজ ৩৫ টাকা কেজি এবং আলুবীজ ২০ ও ২২ টাকা কেজি নির্ধারণের দাবি জানানো হয়েছে। অন্যথায় সরকার এবার কোটি কোটি টাকা লোকসানের ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলেও ওই আবেদনে তিনি উল্লেখ করেন।
মাগুরা শহরের ঢাকা রোড এলাকার বিএডিসির বীজ ডিলার মুরাদুজ্জামান বলেন, বিএডিসি মাগুরায় মোট ৫০ জন ডিলারকে বীজ বিক্রির জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। উচ্চমূল্যের কারণে বেশিরভাগ ডিলারই এ বছর বীজ তোলেনি। এ অবস্থায় কৃষক বাধ্য হবে কম মূল্যে বাইরে থেকে নিম্নমানের বীজ কিনতে হয়েছে, যা ফসল উৎপাদনে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে বিএডিসির বীজ ও উদ্যান উইংয়ের সাবেক সদস্য পরিচালক মো. মাহমুদ হোসেন বলেন, দক্ষতা বা মনিটরিংয়ের কোনো অভাব ছিল না। বরং অন্যান্য বছরের চেয়েও এবার একাধিক মনিটরিং ও একাধিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বীজ অবিক্রীত থাকা নতুন কিছু নয়। গত বছরও বিপুল পরিমাণ আলুবীজ অবিক্রীত থেকে গেছে।
অন্যদিকে এসব অভিযোগের বিষয়ে বিএডিসির মহাব্যবস্থাপক (বীজ) মো. ফারুক জাহিদুল হকের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে জানানো হয়, তার ফোনটি সার্ভিস সেন্টারে রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর খামারবাড়িতে এক সেমিনারে বিএডিসির বিপুল পরিমাণের বীজ অবিক্রীত থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংসদ সদস্য আবদুল মান্নান। তিনি এ ঘটনায় জড়িতদের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।