কিশোর-কিশোরীরা যাতে নিজেরাই নিজেদের বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে পারে এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে ভূমিকা রাখতে পারে, সে লক্ষ্যে কিশোরীদের সচেতন করার চেষ্টা করছে সরকার। দেশের সবকটি ইউনিয়নে একটি করে কিশোর-কিশোরী ক্লাব গঠনের প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার এবং এ ক্লাব গঠনের জন্য ব্যয় বাবদ দুই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রকল্পের অধীনে দেশের প্রায় ৪ হাজার ৫৫০টি ইউনিয়ন এবং ৩৩০টি পৌরসভায় কিশোর-কিশোরী ক্লাব গঠন করা হবে। প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের একটি করে কক্ষ কিশোর-কিশোরীদের জন্য বরাদ্দ থাকবে। কিশোর-কিশোরীদের ক্লাবের মাধ্যমে সংগঠিত করে বাল্যবিয়ে, যৌতুক, নারীর ক্ষমতায়ন প্রভৃতি বিষয়ে সচেতন করতে পারলে দেশ এগিয়ে যাবে। সারা দেশে ৭৯টি কিশোর-কিশোরী ক্লাব বর্তমানে চলমান রয়েছে। এ ক্লাবের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সরকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রত্যেকটি কিশোর-কিশোরী ক্লাবে ৩০ জন সদস্য থাকবে, এর মধ্যে ২০ জন কিশোরী এবং ১০ জন কিশোর। তাদের বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, যৌতুক, প্রজনন স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, ইভটিজিং প্রতিরোধ প্রভৃতি বিষয়ে প্রশিক্ষিত করা হবে। যাতে তারা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে ভূমিকা রাখতে পারে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে প্রায় শতকরা ৫২ দশমিক ৩ ভাগ মেয়ের ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাল্যবিয়ে দেশে এখনো একটি সাধারণ ঘটনা। বেশি সন্তান জন্মদানের এটি একটি বড় কারণ। বাল্যবিয়ে ব্যক্তি, সমাজ এবং একই সঙ্গে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এ অবস্থায় সরকার খুব কঠোরভাবে বাল্যবিয়ে বন্ধে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে ১৮ বছরের নিচে সব ধরনের বাল্যবিয়ে বন্ধের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। ইউনিসেফের সহায়তায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় বাল্যবিয়ে বন্ধে প্রথমবারের মতো জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (এনপিএ) তৈরিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাল্যবিয়ের কারণসমূহ চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এগুলো নির্মূলে কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। জন্ম নিবন্ধন নিশ্চিতকরণ, কিশোরীদের জন্য বিশেষ স্টাইপেন প্রদান, কিশোর-কিশোরীদের বাল্যবিয়ে ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করা, দারিদ্র্য দূর করা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্য পরিস্থিতি কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভরশীল। দেশের মোট জনসংখ্যার ২১ দশমিক ৪ শতাংশই কিশোর-কিশোরী। সংখ্যায় এরা ৩ কোটি ৬৩ লাখ ৮০ হাজার। এ সংখ্যার অর্ধেক কিশোরী। অল্প বয়সে বিয়ে, গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদানের কারণে কিশোরীদের একটা বড় অংশ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) বাংলাদেশে ১০-১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের সংখ্যা, তাদের প্রজনন স্বাস্থ্য পরিস্থিতি, বিবাহিত কিশোরীদের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের ধরন ইত্যাদি জানার জন্য এক গবেষণা চালায়। বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৭ কোটি ধরে গবেষণার হিসাব করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, অল্প বয়সে বিয়ের কারণে নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে বিবাহিত কিশোরীরা। বিবাহিত কিশোরীদের ৫৯ শতাংশ জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী ব্যবহার করে, বয়স্ক নারীদের মধ্যে এই হার ৬২ শতাংশ। বিবাহিত কিশোরীদের মধ্যে পদ্ধতি গ্রহণের অপূর্ণ চাহিদার হার ১৭ শতাংশ। এর অর্থ এরা প্রয়োজনের সময় জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী পায় না। পরিবার-পরিকল্পনা অধিদফতরের সূত্র মতে, ২০১৬-২০৩০ সাল মেয়াদি জাতীয় কৈশোর স্বাস্থ্য কৌশলপত্র তৈরি করা হয়েছে। ১৪টি জেলার মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রে ও ১৮৯টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যকর্নার করা হয়েছে। এসব কর্নারে কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের নানা বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়। অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি শিক্ষা চালু রয়েছে। এ ছাড়া বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে অধিদফতরের নিয়মিত প্রচার কার্যক্রম চালু আছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের স্কুল-কলেজের মেয়েদের মধ্যে প্রজনন স্বাস্থ্য, ঋতুকালীন করণীয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা দেওয়া হচ্ছে। স্কুল-কলেজগুলোতে তাদের জন্য আলাদা স্বাস্থ্যসম্মত ওয়াশরুম, পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি স্কুলে একজন শিক্ষিকাকে এ সংক্রান্ত দায়িত্ব দেওয়া হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজন মতো স্যানিটারি হাইজিন সংগ্রহ করতে পারে। স্যানিটেশন সংক্রান্ত কারণে মেয়ে শিক্ষার্থীরা যাতে ড্রপ আউট না হয়, সেটা সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে।
কিশোরীদের পরিবার, বিদ্যালয়সহ সব জায়গা থেকেই উদ্বুদ্ধ করতে হবে যেন তারা শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারে, ঝরে না পড়ে। আজকের কিশোরী আগামী দিনের মা। তাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। লেখাপড়া শিখে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করলে তারা আর বাল্যবিয়ের শিকার হবে না। এখন শুধু প্রয়োজন বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করে তোলা।
পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে
সচেতনতামূলক যোগাযোগ
কার্যক্রম নিবন্ধ