রবিঠাকুরের ‘বিদায় অভিশাপ’ কবিতার প্রতিফলন হয়েছে এবার বাজেটে। দেবযানী কচকে অভিশাপ দিয়ে বলেছিল ‘যে বিদ্যা তোমার/সম্পূর্ণ হবে না বশ, তুমি শুধু তার/ভারবাহী হয়ে রবে, করিবে না ভোগ/শিখাইবে, পারিবে না করিতে প্রয়োগ।’ গত দশ বছরের বাজেটের দিকে তাকালে যে ধারাবাহিকতা দেখা যায় নতুন অর্থমন্ত্রীর নতুন বাজেটে একমাত্র উপস্থাপনায় কিছুটা ভিন্নতা ছাড়া নতুনত্ব তেমন কিছু নেই যদিও বারবার তিনি বলে আসছিলেন যে, এবারকার বাজেটে চমক রয়েছে! চমক যেটি আছে সেটি সাধারণের জন্য কিছু নয়। দুর্নীতিবাজ ও ঋণখেলাপিরা হয়তো ভেবেছিল এবার তাদের খবর আছে, কিন্তু বাজেট ঘোষণার পর দেখা গেল তাদের সুবিধা আরো বেড়ে গেছে, তাদের অবৈধ অর্থ-সম্পদকে আগের মতোই বৈধতা দেওয়া হয়েছে। দেশের আর্থিক খাত চরম সংকটে। নগদ টাকার সংকট বেশির ভাগ ব্যাংকে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে সুদ পরিশোধ ব্যয় লাগামহীন অবস্থায় চলে গেছে। রাজস্ব আদায়ে চরম ঘাটতি। সব মিলিয়ে সামষ্টিক অর্থনীতিতে নতুন করে যে চাপ দেখা দিয়েছে তার স্বীকৃতি যেমন বাজেট নেই, তেমনি নেই প্রতি বছরের জোরালো কোনো পরিকল্পনা।
শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে গুরুত্ব দিয়ে একটি দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতের দিকে ধাবিত হওয়ার কথা তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতা প্রদান করেন। শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ব্যয় বাড়ানোসহ জাপানকে অনুকরণের বিষয় তুলে ধরেছেন অর্থমন্ত্রী। উচচ শিক্ষিত তরুণদের উল্লেখযোগ্য অংশ বেকার অথচ তাদের কর্মসংস্থানের জন্য বাজেটে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করা হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হলেও আয় বৈষম্য বেড়েছে। অন্যদিকে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশে সীমিত রাখার লক্ষ্যমাত্রা হাতে নেওয়া হয়েছে। আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১১.৬৮শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ৫৩ হাজার ৫ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ১১.৫৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে টাকার অঙ্কে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা বাড়লেও শতাংশে প্রায় একই রয়েছে।
রাজহাঁস থেকে পালক উঠাও যতটা সম্ভব ততটা, তবে সাবধান রাজহাঁসটি যেন কোনোভাবেই ব্যথা না পায়। ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের অর্থমন্ত্রী জিন ব্যাপটিস্ট কলবার্টের এই উক্তি উচ্চারণ করেছেন অর্থমন্ত্রী। কর রাজস্ব আহরণ আমাদের কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারব যখন অমরা কর রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় সব ধরনের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি রোধ করতে পারব। সেটি কি সম্ভব আসলেই? দেশে চার কোটি মানুষ মধ্যম আয়ের অন্তর্ভুক্ত। অথচ আয়কর দিচ্ছেন ২০-২২ লাখ লোক। এ সংখ্যা দ্রততম সময়ের মধ্যে এক কোটিতে উন্নীত করার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। বহুল আলোচিত ২০১২ সালের মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আইনটি চার স্তরে বাস্তবায়নের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এতে পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়বে, ভ্যাট বাড়া মানে সাধারণ মানুষের ওপর অনাকাঙ্ক্ষিত চাপ বেড়ে যাওয়া। দশ টাকার ছোট একটি পানির বোতল কিনে আমরা যখন দুই টাকা ভ্যাট দেই সেটি একজন সাধারণ কনজুমারের ওপর কতটা অর্থনৈতিক চাপ দেয় সেই হিসাব আমাদের অর্থনীতিতে রাখা হয় না, তারপরও আমরা বলি জনবান্ধব বাজেট, সাধারণ মানুষের কল্যাণের বাজেট! অথচ ফ্ল্যাট ও জমি কিনে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে ধনীদের। ধনীরা অবৈধভাবে উপার্জিত কোটি কোটি টাকা দিয়ে জমি ও ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ নেবে। তার মানে কী? অসততাকে আরো উৎসাহিত করা হয়েছে।
জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে সরকার প্রায়ই ক্রেডিট নিয়ে থাকে; কিন্তু এর কারণ হচ্ছে বড় বড় প্রকল্পের উপস্থিতি। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে যে এসব প্রকল্প চিরকাল থাকবে না, তখন প্রবৃদ্ধির কী হবে? আমাদের আরো মনে রাখতে হবে যে, বেসরকারি খাতই হচ্ছে অর্থনীতির প্রাণ। কাজেই এই খাতে প্রকৃত বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যেটি আশানুরূপ হচ্ছে না। বাজেটের উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে রাজস্ব আদায় যেখানে গত বছর ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সেটি এবার ১৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। রাজস্ব আয় প্রত্যাশার চেয়ে কিছুট কম হবে এটি জেনে অর্থমন্ত্রী চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়েছেন ২২ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা। বাজেট সংশোধন করা হয়েছে ব্যয়ের ক্ষেত্রেও। রাজস্ব ব্যয় কমানো হয়েছে ২২ হাজার ৩২ কোটি টাকা আর উন্নয়ন বাজেট কমেছে ৬ হাজার কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি অর্থায়নের উৎস ব্যবহারের দিক থেকেও ছিল ব্যর্থতা। যেমন লক্ষ্য ছিল ঘাটতি পূরণে বৈদেশিক সাহায্য সূত্রে পাওয়া যাবে ৫০ হাজার ১১৬ কোটি টাকা, কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে ৪৩ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। আবার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টকা নেওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত পাওয়া যাবে ৩০ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে সরকার সবচেয়ে ব্যয়বহুল উৎস সঞ্চয়পত্র বিক্রি করবে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। অথচ লক্ষ্য ছিল ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের বাজেট হচ্ছে ৪ লাখ ৪২ হাজার ৫৪১ কোটি টাকার। এর মধ্যে আয় করতে পারছে ৩ লাখ ২০ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা, ফলে সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে ১ লাখ ২৫ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছেন ৩ লাখ ৮১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। ফলে ঘাটতি থাকছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। যত সমস্যা এই ঘাটতি অর্থায়নেই। অর্থমন্ত্রীর প্রত্যাশা তিনি ৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক সাহায্য পাবেন। অন্যদেক অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক থেকে নেওয়া হবে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। এমনিতে চরম অর্থিক সংকটে পড়ে আছে ব্যাংক খাত। নগদ অর্থ নেই তাদের কাছে। ঋণ পাচ্ছে না বেসরকারি খাত। অথচ সেখান থেকেই ঘাটতি মেটানোর আশা করছেন অর্থমন্ত্রী। বিষয়টি অর্থনীতির অবস্থাকে তো আরো নাজুক করে ফেলবে।
বিশাল এই বাজেটের বড় অংশই ব্যয় হবে অনুৎপাদনশীল খাতে। বেতন ভাতা খাতে ব্যয় হবে রাজস্ব বাজেটের ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ, পেনশন দিতে যাবে আরো ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে বরাদ্দের ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ। বাজেট ১৪ শতাংশের বেশি বরাদ্দ দিয়েছে সামাজিক নিরাপত্তায়। সুবিধাবঞ্চিত, হতদরিদ্র, বিধবা, অসচ্ছল মানুষ, প্রতিবন্ধী, মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রায় সব ধরনের ভাতার পরিমাণ ও উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আশায় নতুন করে ১৩ লাখ মানুষকে যুক্ত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এতে সুবিধাভোগীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৮৯ লাখ, গতবার ছিল ৭৬ লাখ। সামাজিক সুরক্ষা, তরুণ সমাজের জন্য স্টার্ট আপ তহবিল, প্রবাসী বীমা, সর্বজনীন পেনশন চালু করার আশ্বাস দিয়ে নতুন অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত বাজেটকে মানবিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কতটা মানবিক হবে তা বাস্তবায়নকালেই বোঝা যাবে। প্রতি বছরই জনগণকে এ ধরনের অনেক আশার বাণী শোনানো হয় পরে দেখা যায় তারাই হয় বলির পাঁঠা। এবারো এর ব্যতিক্রম তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না।
লেখক : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক