মুক্তমত

বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি এবং কিছু কথা

  • প্রকাশিত ১৪ নভেম্বর, ২০২০

আরমান শেখ

 

 

বিশ্বের সর্বাধিক শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নতুন প্রার্থীর বিজয় বিশ্বনেতৃত্বে সৃষ্টি করেছে একাধারে আশার আলো, অস্বস্তি এবং দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। মার্কিন মুলুকের নতুন কর্ণধারের আচরণ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনায় বিশ্ব মিডিয়াগুলো এখন সরগরম। এর অন্যতম কারণ হলো বর্তমান বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি সংকট এবং রাজনৈতিক টানাপোড়েন।

বিশ্বরাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাঠ তথা মধ্যপ্রাচ্যের উদীয়মান শক্তি ইরান এবং তুরস্কের প্রতি বাইডেন কী ধরনের ভূমিকা রাখবেন তা এখন অনেকেরই চিন্তার বিষয়। এতদিনের সকল জল্পনা-কল্পনার পর সম্প্রতি সিরিয়াবিষয়ক মার্কিন দূত জেমস জেফরি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তুর্কিবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘পিকেকে’-কে সিরিয়া থেকে সরিয়ে নেবে তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অজুহাত দেখিয়ে গেরিলা গোষ্ঠীটির সমর্থন বন্ধ করার কারণস্বরূপ তিনি বলেন, এই গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দেওয়ার কারণে তুরস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে, যা পুনরুদ্ধার করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।

বাইডেনের ক্ষমতায় আসার পরপরই এমন সিদ্ধান্ত নিশ্চিত মার্কিনিদের নতুন তুরস্কনীতির ইঙ্গিতই বটে। এর অন্যতম উদ্দেশ্য হিসেবে ধরা যায় সিরিয়ায় তুরস্কের সহায়তা নিয়ে মার্কিনিদের নতুনভাবে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি এবং রাশিয়াকে চাপে ফেলা। আর এই উদ্দেশ্য পাকাপোক্ত করতে মধ্যপ্রাচ্যের অপর শক্তি ইরানকেও শান্ত রাখতে পরমাণু চুক্তি নবায়নের চিন্তা করছেন বাইডেন। ইতোমধ্যেই মার্কিন পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষানীতি বিষয়ক বিশ্লেষক ড্যানিয়েল প্লেটকাসহ অনেকেই বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি ইরানঘেঁষা এবং সৌদিবিমুখ হতে পারে বলে মতামত দিয়েছেন। সম্প্রতি দেখা গেছে, সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাষ্ট্র হলেও প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা পর বাইডেনকে অভিনন্দন জানিয়েছে।

তবে ইরানঘেঁষা নীতি গ্রহণে যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করতে ইসরাইলের অভিবাসনমন্ত্রী হানেগোভি তার বক্তব্যে বলেছেন, বাইডেনের ইরানঘেঁষা নীতি ইরান-ইসরাইলকে সহিংতার দিকে ঠেলে দেবে। কিন্তু ইসরাইলি ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ডিফেন্স কমিটির চেয়ারম্যান জোভেভি বলেন, ‘ওবামার সময় বাইডেনকে দেখেছি, তিনি ইসরাইলের একজন পরীক্ষিত বন্ধু। যদি পরমাণু চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন করা হয় তাহলে তা আগের থেকে অনেক বেশি কার্যকর হবে।’ এর প্রেক্ষিতে ধারণা করা যায়, পশ্চিমতীরের বসতি স্থাপন নিয়ে বাইডেনের আপত্তি থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলি শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে মার্কিন নীতি অব্যাহত রাখবে তার সরকার, যা সাম্প্রতিক সময়ে আমিরাতসহ অন্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ইসরাইলি চুক্তিতে বাইডেনের সম্মতি প্রদানের মাধ্যমে বোঝা গেছে। অপরদিকে ইয়েমেনে আগ্রাসন পরিচালনায় সৌদি জোটে মার্কিন সমর্থন হ্রাস করার মতো নতুন কর্মসূচি আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাছাড়া ইরানের সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য আনলে, নির্ভরযোগ্যতা বৃদ্ধি করতে ইয়েমেনে ইরানি সমর্থনপুষ্ট হুথিদের বিরুদ্ধে সৌদি আগ্রাসনে বাইডেনের সহায়তা হ্রাস পাওয়াটাই যুক্তিযুক্ত।

মধ্যপ্রাচ্যে বাইডেনের ইরান এবং তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের হেতু হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে, রাশিয়াকে চাপ দেওয়া এবং সিরিয়ায় নতুন অবস্থান সৃষ্টি করে মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দিকে ঝুঁকবেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, যা এখন অনেকটা রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। লিবিয়া এবং চলমান আজারবাইন যুদ্ধে মার্কিনিদের দর্শকের ভূমিকা এবং রাশিয়ার সক্রিয়তা আঞ্চলিক রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব সৃষ্টি  করেছে, একথা বলা চলে। তাছাড়া আজারবাইজান-আর্মেনিয়া যুদ্ধেও মধ্যস্থতাকারী বা অন্য যে কোনো ভূমিকায় যুক্তরাষ্ট্রকে প্রবেশের সুযোগ দিচ্ছে না রাশিয়া এবং তুরস্ক কেউ-ই। সম্প্রতি তুরস্কের প্রেসিডেন্টের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে জানা গেছে, গত ৮ নভেম্বর রাতে এরদোয়ান এবং পুতিনের সরাসরি ফোনালাপ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়ন বিষয়ক আলোচনাসহ আজারবাইজান যুদ্ধের ব্যাপ্তি এবং নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রাশিয়াকে তুরস্ক আশ্বস্ত করেছে। যদিও গতকাল আজারিবাহিনী কর্তৃক ভুলবশত রাশিয়ার মিগ-২৪ বিমান ভূপাতিত করার ঘটনার প্রেক্ষিতে রাশিয়া ‘পিস কিপিং মিশন’ নামে চুক্তি অনুযায়ী সংঘাত নিরসনে সীমান্তে সেনা মোতায়েন করবে বলে জানিয়েছে। তবে এই মিশনের উদ্দেশ্য হিসেবে ধারণা করা যায়, যুদ্ধের ভয়াবহতা হ্রাস এবং মাঠ পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টির মাধ্যমে ককেশাস অঞ্চলে নিরপেক্ষভাবে নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখা।

উপর্যুক্ত ঘটনাবলিসহ সিরিয়া, লিবিয়া ও আজারবাইজানে তুরস্ক-রাশিয়ার কৌশলী ভূমিকার মাধ্যমে নিজেদের সম্পর্ক রক্ষাকরণ থেকে বোঝা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কোনো নেতা তথা যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশ কেউ-ই চায় না।

তবে বিশ্বরাজনীতির প্রাণকেন্দ্র মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্প আমলের ভরাডুবি থেকে পুনরুত্থান ঘটাতে বাইডেন নিতে যাচ্ছেন নতুন কর্মপরিকল্পনা। মধ্যপ্রাচ্যের ‘ইসলামিক সেন্টিমেন্ট’কে কাজে লাগিয়ে রাশিয়ার লাগাম টানতে বদ্ধপরিকর তিনি। গতকাল নতুন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ট্রাম্পের কথিত ‘ডিল অব সেঞ্চুরি’ থেকে বের হয়ে আসার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেন, তার সরকার কোনোভাবেই ট্রাম্পের একপেশে নীতি সমর্থন করবে না। ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আবারো শান্তি আলোচনা শুরু করবে বাইডেন সরকার। বন্ধ করে দেয়া ফিলিস্তিনি ত্রাণ কার্যক্রমও পুনরায় শুরু করবে তার সরকার।

একইভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনকে কোণঠাসা করতে বাইডেন এককভাবে ভারতের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে পাকিস্তানকেও সঙ্গে পেতে তার অর্জিত পাকিস্তানের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ‘হেলাল-ই-পাকিস্তান’-কে কাজে লাগাতে পারেন। ট্রাম্পের পাকিস্তানবিমুখ নীতি থেকে সরে আসার পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রতিও সম্প্রতি শুরু হওয়া মার্কিন কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করবেন বাইডেন।

নতুন মার্কিন কর্ণধার কতটা ঠান্ডামাথার দাবাড়ু তা ওবামা আমলে বিশ্বনেতারা দেখেছেন বলেই হয়তো এখনো চীন এবং রাশিয়া তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো শুভেচ্ছাবার্তা পাঠায়নি (এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত)। ট্রাম্প এবং বাইডেনের কীর্তি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বাইডেন তুলনামূলক অনেক বেশি যুদ্ধপ্রবণ। ট্রাম্প হুমকি-ধমকি এবং অবরোধে বিশ্বাসী হলেও বাইডেন অনেকটা কাজের ওপর বিশ্বাসী বলেই ধারণা করা হয়। সেক্ষেত্রে বলা যায়, প্রথমদিকে বাইডেন নিজের নীতি অনুযায়ী সার্বিক কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্বে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করার পরে প্রয়োজন অনুযায়ী ইরাক-লিবিয়ার মতো অপর রক্তক্ষয়ী সিদ্ধান্ত নিতেও দ্বিধা করবেন না।

তবে আপাতদৃষ্টিতে প্যারিস চুক্তিসহ বিশ্ব সংস্থায় বাইডেনের ফিরে আসার মতো শান্তিমূলক সিদ্ধান্তগুলো গোটা পৃথিবীতে স্বস্তির পূর্বাভাসই দিচ্ছে। আশা করছি, বাইডেন তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে যোগ্য নেতৃত্বের আসনে নিয়ে যাবেন এবং পৃথিবী থেকে অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও যুদ্ধ-সংঘাত হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads