বাংলাদেশ আজ আর নবীন নয় 

ড. মুহাম্মদ সামাদ

ছবি : সংগৃহীত

ফিচার

বাংলাদেশ আজ আর নবীন নয় 

  • সালেহীন বাবু
  • প্রকাশিত ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

ড. মুহাম্মদ সামাদের জন্ম তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার জামালপুরে ১৯৫৬ সালে। সরিষাবাড়ী রাণী দিনমণি মডেল হাই স্কুল ও সরিষাবাড়ী কলেজ থেকে ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে প্রথম বিভাগে যথাক্রমে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকর্ম বিষয়ে ১৯৭৮ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে অনার্স এবং ১৯৭৯ সালে প্রথম শ্রেণিতে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন। ড. মুহাম্মদ সামাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইনোনাস্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে পর পর দুইবার পাঠদান করে প্রভূত সম্মান অর্জন করেছেন। ২০০৯ সালে সমাজকর্ম শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ওয়াশিংটনস্থ সিএসডব্লিউই পরিচালিত ‘ক্যাথেরিন ক্যান্ডাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যাল ওয়ার্ক এডুকেশন’-এর ফেলো হিসেবে বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্মের উচ্চশিক্ষার তুলনামূলক অবস্থার ওপর গবেষণা করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে অধ্যাপক ও পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেসের (ইউআইটিএস) উপাচার্য ছিলেন। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ড. মুহাম্মদ সামাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সালেহীন বাবু 

বাংলাদেশ আজ ৬৭তম মাতৃভাষা দিবসের দোরগোড়ায়। আর কদিন পরেই মাতৃভাষা দিবস। তারপর স্বাধীনতা দিবস। আপনার অনুভূতি কী? 

এই বাংলাদেশকে আজ আর নবীন বলা যায় না। একটি জাতিকে ধ্বংস করতে হলে সে জাতির মেধা ও মননের চর্চা যারা করেন, যেমন বুদ্ধিজীবী, সমাজবিজ্ঞানী, কবি, সাংবাদিক, চিকিৎসা বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা, তাদের নিশ্চিহ্ন করতে হয়। আমাদের দেশে চিকিৎসা বিজ্ঞানী আলীম চৌধুরী, ইতিহাসবিদ সৈয়দ গিয়াসউদ্দীন আহমেদ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক), আনোয়ার পাশা (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক), মুনীর চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, সাংবাদিক সেলিনা বেগমের মতো মেধাবী মানুষগুলো যারা আমাদের পূজনীয় ও অনুকরণীয়, যারা আমাদের সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, পূজনীয় এসব ব্যক্তির মেধা-মনন নিশ্চিহ্ন করার জন্য তাদের বেছে বেছে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে, দেশ যেন আর দাঁড়াতে না পারে। কিন্তু সেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার বিচার হয়েছে, এর জন্য আমার অনুভূতি অনেক আনন্দের। আনন্দ-বিষাদে ভরপুর আমাদের জীবন। পুরো জাতিই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার, জেলহত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলো বঙ্গবন্ধুকন্যার হাত ধরে। কাজেই সেদিক থেকে বাংলাদেশ কলঙ্কমুক্ত হলো। বাংলাদেশ একটা উন্নত মানবিক রাষ্ট্র গঠনের পথে এগিয়ে চলেছে।  

 

আপনি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের কোনো বিশেষ স্মৃতি কি আছে যা আপনাকে তাড়িয়ে বেড়ায়? 

আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি সরিষাবাড়ী রাণী দিনমণি মডেল হাই স্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্র ছিলাম। আমার স্কুলে ক্লাস টেনে পড়তেন কালাম ভাই। আমরা নাইনে উঠলাম। তিনি এসএসসি পরীক্ষা দেবেন। সে সময় পাক বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে এবং কালাম ভাইকে ধরে নিয়ে আসে। তার ঊরু থেকে একটা পা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তারপর তাকে গুলি করে হত্যা করে। তার চোখে-মুখে সেই গুলি লাগে। সারা মুখ রক্তে ভরে যায়। কালাম ভাইয়ের বাবা তার ছেলেকে দেখতে যান। পা-কাটা ছেলের রক্তে চটচটে মুখে হাত বুলিয়ে বাবা আদর করতে থাকেন। তখন রাজাকাররা তাকে লাথি দেয়। রাজাকাররা সে সময় উদ্ধত হয়ে বলছিল, শুয়োর কা বাচ্চা, তোমারা বেটা হ্যায়? কালাম ভাইয়ের বাবা ছেলের মুখে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছেন, না, না। কারণ ছেলের কাছে যাওয়ার আগে আমার গ্রামের চাচারা বলেছিল- আপনি ছেলের মুখ দেখতে যান। কিন্তু আপনি ওদের সামনে বলবেন না যে, আপনি কালামের বাবা। বললে আপনাকেও মেরে ফেলবে। এ রকম বলে তাকে সেখানে পাঠানো হলো। তারপর ওখানে পাক হানাদার বাহিনীর সৈন্যরা, রাজাকাররা যতবার তাকে লাথি দিচ্ছিল, বলছিল শুয়োর কা বাচ্চা, তোমারা বেটা হ্যায়? তখন কালাম ভাইয়ের বাবা বার বার না না বলছিলেন। তার চোখের পানি ঝরঝর করে ছেলের মুখে পড়ছিল। আমরা পাশে দাঁড়িয়ে নির্বাক হয়ে দেখেছি। তাছাড়া গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। দূরের গ্রামে ধোঁয়া উঠছে। নারী-পুরুষদের গরুর দড়ি দিয়ে বেঁধে সামনে রাজাকার, পেছনে পাক হানাদার বাহিনী লাইন ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ঘরের গরু-ছাগলও নিয়ে যেতে বাদ রাখেনি। এগুলো আমাদের বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে নিয়ে যেত, আমরা দেখতাম। আমাদের নদীতে রাতে অনেক মানুষ মেরে ফেলে দিত। রাতেই সেই লাশ ভেসে যেত। এমনও দেখতাম, একসঙ্গে চারজনকে হাত-পা বেঁধে গুলি করে মেরেছে। বুকে গুলির কারণে গর্ত হয়ে যেত। রক্তে ভেসে যেত সে জায়গা। ডিসেম্বর মাসে মিত্র বাহিনী যখন একত্রে বিমান দিয়ে আক্রমণ করে, তা দেখতাম। রেলের একটা মালগাড়ির ওপর মিত্র বাহিনীর বিমান হামলায় অনেক রাজাকার মারা যায়। আমরা রেডিও শুনতাম। পাটক্ষেতের মধ্যে খড় বিছিয়ে উঁচু বিছানা করে সেখানে রেডিও নিয়ে শুনতাম। ‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠানটি মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। সংবাদ শুনতাম। শুনে উজ্জীবিত হতাম। রাজাকাররা, পাক বাহিনী যদি টের পেত, তাহলে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলত। আমরা নিজের বাড়িতে থাকতাম না। নদী পার হয়ে অন্য গাঁয়ে থাকতাম। এ রকম অনেক স্মৃতি আছে। 

 

অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনে আমরা কতটুকু অগ্রগ্রামী? 

আগের অখণ্ড বাংলা আয়তনে অনেক বড় ছিল। সে সময় থেকেই ধর্মীয় সংস্কৃতি সব সময় সহনশীল ছিল। এখানে তিনবার ধর্মান্তর হয়েছে। হিন্দু থেকে বৌদ্ধ, বৌদ্ধ থেকে মুসলমান হয়েছে লোকেরা। এদের সহজ ও মরমী জীবন। এদের সুফিবাদী চিন্তা, শ্রীচৈতন্যের চিন্তা, লালনের চিন্তা। গাজীর গানে আছে ‘নানা বরন গাভীরে ভাই একই বরন দুধ/জগৎ ভরমিয়া চাহিলাম একই মায়ের পুত’। এ চেতনা বাঙালির অন্তরে। এখানে যার যার ধর্ম সে পালন করে। কিন্তু ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে এই চেতনাকে ধ্বংস করার জন্য বিএনপি-জামায়াত উঠে-পড়ে লেগেছিল। এমনকি সামরিক শাসনে যারা ছিলেন, জিয়া-এরশাদ- এরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক করার জন্য নানা ধরনের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিলেন। তারপরও বঙ্গবন্ধুকন্যা ক্ষমতায় আসার পর ’৭২-এর সংবিধান অনেকটাই ফিরে এসেছে এবং সেই সংবিধানের ভিত্তিতে ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’- এই স্লোগানসহ বিষয়গুলো প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। অন্যান্য দেশে লক্ষ করলে দেখা যায়, বর্ণবিদ্বেষ বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ অনেক দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। বাংলাদেশের মতো এত ঘনবসতির এই দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিদ্যমান। আমরা বাসস্ট্যান্ডে কাউকে যদি কেউ হিন্দু নামে ডাকে বা বৌদ্ধ নামে ডাকে, তাহলে আমরা ফিরেও তাকাই না। আমরা জানি, এরা আমাদেরই ভাই-বোন, আমাদেরই স্বজন। চেহারা এক, পোশাক-আশাক, জীবনধারা সব এক। আসলে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনে সবারই দায়িত্ব আছে। সাংবাদিকদের দায়িত্ব আছে, বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব আছে, রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব আছে। বিশেষ করে রাজনীতিবিদদের দায়িত্বটাই প্রধান। রাজনীতিবিদরা ’৭৫-এর পরে অসাম্প্রদায়িক বিষয়টিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। সুতরাং রাজনীতিবিদদের কাছে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছে আমাদের দাবি বা আকাঙ্ক্ষা- তিনি এই চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। এই চেতনা আরো সম্প্রসারিত হবে। যে মূল্যবোধের ভিত্তিতে সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিলেন, সাড়ে ৪ লাখ মা-বোন সম্ভ্রম দিলেন, সেই শহীদ, সেই জীবন ও প্রাণের বিনিময়ে, সম্ভ্রমের বিনিময়ে, ’৭১-এর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিনিময়ে আমরা যে চেতনার ভিত্তিতে দেশ স্বাধীন করেছি, তার মূল কথাই ছিল একটা অসাম্প্রদায়িক চেতনা। বাংলাদেশে এই চেতনা আরো প্রসারিত হোক, দীর্ঘজীবী হোক। আমরা মিলেমিশে যে যার স্থান থেকে ভালোভাবে জীবনযাপন করি। আমরা আমাদের গান গাই। সংস্কৃতিচর্চা করি। যার যার ধর্ম পালন করি অবাধভাবে। এটাই আমাদের আকাঙ্ক্ষা।  

 

বইমেলায় নতুন কোনো বই প্রকাশিত হয়েছে? 

এই বইমেলায় আমার নতুন দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে জার্নিম্যান বুকস থেকে। একটি গবেষণাগ্রন্থ- সোশ্যাল সার্ভিস অ্যাক্টিভিটিজ অব রিলিজিয়াস ইনস্টিটিউশনস ইন বাংলাদেশ (ঝড়পরধষ ঝবৎারপব অপঃরারঃরবং ড়ভ জবষরমরড়ঁং ওহংঃরঃঁঃরড়হং রহ ইধহমষধফবংয) এবং একটি কাব্যগ্রন্থ- আমি তোমাদের কবি। এ ছাড়া মাওলা ব্রাদার্স থেকে ‘আমার প্রেমের কবিতা’র দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে এবারের বইমেলায়। বইমেলার নতুন বই যেন নবান্নের প্রাণ ছড়িয়ে দেয়। আমরা সারা বছর প্রতীক্ষায় থাকি। এটা রেওয়াজ হয়ে গেছে। বইপ্রেমিকরা অর্থ সঞ্চয় করে রাখে। মেলায় ঘুরে ঘুরে বই দেখে, পছন্দ করে, কেনে। প্রিয় লেখকের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করে। তরুণ কবি-লেখকদের নতুন বই প্রকাশও খুব আনন্দের। তারা তো আনন্দে-বিস্ময়ে কাঁপতে থাকে। 

 

আপনার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো-  

আমার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে- আমি তোমাদের কবি; আমার দু’চোখ জলে ভরে যায়; আজ শরতের আকাশে পূর্ণিমা; চলো, তুমুল বৃষ্টিতে ভিজি; পোড়াবে চন্দন কাঠ; আমি নই ইন্দ্রজিৎ মেঘের আড়ালে; একজন রাজনৈতিক নেতার মেনিফেস্টো; প্রেমের কবিতা; কবিতাসংগ্রহ ইত্যাদি।  

 

প্রাণের বইমেলায়- 

বইমেলায় আসতে আমার সব সময়ই ভালো লাগে। বইমেলা মানেই তো নতুন বইয়ের ঘ্রাণ। প্রাণের স্পন্দন। সেই সঙ্গে তারুণ্যের মেলা। তাই মেলা আমাকে ভীষণভাবে টানে। মেলায় এলে অন্যরকম মুগ্ধ হই। এর কোলাহল আমাকে আনন্দ দেয়। আমার কাছে মেলা মানেই সম্ভাবনা। মেলা মানেই বাঙালি সংস্কৃতির স্ফুরণ। সারা বছর অপেক্ষায় থাকি এই বইমেলার জন্য। আমাদের সময়ে বইমেলা ছিল বাংলা একাডেমির এক চিলতে সবুজ মাঠ। আমি, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, জাফরসহ সব বন্ধুরা মিলে প্রতিদিন বটতলায় আড্ডা দিতাম। তখন তেমন মানুষজন ছিল না। ধীরে ধীরে যখন মেলা বড় হয়ে উঠল, তখন কবি নির্মলেন্দু গুণ, শামসুর রাহমানসহ বড় বড় লেখকদের কাছ থেকে অবাক বিস্ময়ে দেখতাম। তাদের দেখে মুগ্ধ আর আপ্লুত হতাম। 

১৯৮৩ সালে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সে সময় আমরা বন্ধুরা মিলে ওই এক চিলতে মাঠের এক কোণে টেবিল-চেয়ার নিয়ে বই বিক্রি করতে বসতাম। কেবল কি বই বিক্রি করতাম! জমিয়ে আড্ডা দিতাম। মেলায় সকালে আসতাম, মেলা শেষ করে রাতে যেতাম। এ রকম অবস্থা ছিল। আশির দশক জুড়ে মেলাটা ছিল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। সে সময় মেলায় কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকর্মী, সংস্কৃতিকর্মীরা একত্রিত হয়ে সভা-সমাবেশও করতেন। সে এক মজার দিন ছিল। এখন অবশ্য আগের মতো অন্তরঙ্গ জায়গাও পাওয়া যায় না। 

আমাদের সময়ে মানুষজনের আনাগোনা কম ছিল। কিন্তু আমরা একে অন্যের সঙ্গে অন্তরঙ্গ ছিলাম। ওই সময়টায় একটা গ্রামীণ আবহ ছিল। এখন কোলাহল বেড়েছে তুমুল, স্টল বেড়েছে কয়েক গুণ, সেই সঙ্গে পরিসর বেড়েছে, মানুষও বেড়েছে শতগুণ। কিন্তু সেই প্রাণের স্পন্দন, সেই গ্রামীণ আবহ আর খুঁজে পাই না। তবু বইমেলা তো বইমেলাই; এখানে প্রাণের কোলাহল না থাকলে তো চলবে না। এ কোলাহল তো অন্য কোলাহলের চেয়ে ভিন্ন। বড় কথা হচ্ছে, এই বইমেলার সঙ্গে বাঙালির আবেগ জড়িত রয়েছে। এখন প্রচুর মানুষ বই না কিনলেও ঘুরতে আসে। দিনের যেমন পার্থক্য হয়েছে, তেমনি সবকিছুতে পার্থক্য এসেছে। এখন মেলায় তারুণ্যের জয়ধ্বনি শুনতে পাই। আমরা তো এটাই চাই। 

 

আপনি জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি- 

এরশাদের সামরিক দুঃশাসনের হাত থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের রাজনৈতিক আন্দোলন যখন স্তিমিত হয়ে পড়ে, তখন ১৯৮৭ সালে ‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্যে কবিতা’- এই স্লোগান কণ্ঠে নিয়ে কবিতা উৎসবের আয়োজন করে আমরা আন্দোলনে নতুন গতির সঞ্চার করি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সব রাজনৈতিক নেতার অনুপ্রেরণার উৎস হয় কবিতার উৎসবস্থল। সবাই কবিতা শুনতে আসতেন। আমাদের সভাপতি ছিলেন শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, রফিক আজাদ, বেলাল চৌধুরী, রবিউল হুসাইন প্রমুখ। কবি সুফিয়া কামাল বারোটি উৎসব উদ্বোধন করে আমাদের গৌরবান্বিত করেছেন। আমি চার বছর ধরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ এবং আবহমান সংস্কৃতিকে বহন করে নিয়ে যেতে চাই। আমাদের উৎসবে দেশের ও বিদেশের কবিরা আসেন। এটি কবি ও কবিতাপ্রেমিকদের বিশ্বের বৃহত্তম মিলনমেলা। 

 

স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে তরুণদের প্রতি প্রত্যাশা কেমন? 

বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৬০ ভাগেরই বেশি কর্মক্ষম তরুণ। আর অন্যান্য দেশে ৬০ ভাগের বেশি বয়স্ক এবং তাদের নতুন প্রজন্মের জনসংখ্যা বাড়ছে না। বাংলাদেশের তরুণরা যেন সত্যের চর্চা করে। তারা ইতিহাস জানুক, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হোক। তারা বঙ্গবন্ধুকে জানুক, মুক্তিযুদ্ধকে জানুক, ভাষা দিবসকে জানুক। এসব জানার মধ্য দিয়ে তারা নতুন করে উজ্জীবিত হবে। আজ সারা বিশ্বে আমাদের তরুণরা ভালো কাজ করছে। এই যে স্যাটেলাইট চলে গেছে আকাশে, আলাদা আলাদা তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, মেডিকেল কলেজ হচ্ছে- এগুলো তরুণদের জন্যই তো হচ্ছে। এরা ভালো লেখাপড়া করুক, নিজেদের ইতিহাস জানুক, ঐতিহ্য জানুক। অসাম্প্রদায়িক চেতনা তাদের ভেতরে উদ্দীপিত হোক। এভাবে তারা নিজের দেশকে ভালোবাসবে। নিজের দেশের মানুষকে, প্রতিবেশীকে ভালোবাসবে, সবাই যেন মিলেমিশে থাকতে পারে। এই তরুণদের জাগ্রত করার জন্য আমাদের মিডিয়া, রাজনৈতিক দলসহ শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী- সবার দায়িত্ব আছে। 

তরুণদের উচিত লেখাপড়া করা। সঠিক ইতিহাস জানা। শুধু টেলিভিশন দেখলে হবে না। রিয়েলিটি আর ফিকশনের মধ্যে অনেক পার্থক্য। আমরা মুক্তিযুদ্ধ চোখে দেখেছি। এরা নাটক পড়ে, নাটক দেখে, টেলিভিশন দেখে। টেলিভিশন, নাটক দেখে যে অনুভূতি তৈরি হবে আর আমরা নিজ চোখে যা দেখেছি, তার মধ্যে অনুধাবনের পার্থক্য আছে। তাই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে হবে, পড়তে হবে। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে তাদের কথা শুনতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের দুঃখ-কষ্ট-বেদনা অনুধাবন করতে হবে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ হোক, গবেষণা হোক। কৃষকের সন্তানরা না খেয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, জীবন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে মানুষ। এগুলো যদি মিডিয়াতে বেশি বেশি প্রচার করা যায়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রসারিত হবে। ফলে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিল তাদের প্রতি ঘৃণা আরো বাড়বে। তরুণরা আরো উদ্দীপ্ত ও শানিত হবে। এভাবেই তরুণদের বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads