প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের হাতে বই তুলে দেওয়া একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। তাই তো নতুন বছরের জানুয়ারি মাসের পহেলা তারিখে সরকার বই উৎসবের ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা হলো সর্বজনীন। অর্থাৎ বিনা খরচে সব শিশুর জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সেজন্য আগে প্রতি বছরের শুরুতে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রত্যেক ক্লাসের ছাত্রদের বিনামূল্যে নতুন একসেট বই বিতরণ করা হতো। কিন্তু এখন আরো সম্প্রসারিত করে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত করা হয়ে থাকে।
আমরা জানি, প্রাথমিক পর্যায়ে স্কুলগুলোতে অবকাঠামোগত সমস্যা, শিক্ষক স্বল্পতা ও যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব, প্রকৃত মনিটরিং, ক্লাসরুমে সব শিক্ষকদের সমানভাবে মনোযোগ না থাকা। সর্বোপরি শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য ও প্রাইভেট পড়ানোর প্রবণতার কারণে হাতে গোনা স্কুলছাড়া বাকিগুলোতে মানসম্পন্ন লেখাপড়া হচ্ছে না। আর এই সুযোগে শহরাঞ্চলে বেসরকারিভাবে বিকল্প কিন্ডার গার্টেন স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এমনকি এখন গ্রাম পর্যায়েও পর্যায়ে হাজার হাজার কিন্ডার গার্টেন স্কুল দেখা যায়। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানেই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বই পড়ানো বাধ্যতামূলক। আর সেজন্যই সরকারি-বেসরকারি সব স্কুলগুলোতে একই দিনে পাঠ্যবই বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়।
এবার ২০১৯ সালের বই উৎসব সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে। পহেলা জানুয়ারি বই উৎসব পালন করা হবে। এবার দুই দিনব্যাপী অথাৎ মঙ্গলবার ও বুধবার এই উৎসব চলবে। দুদিনের ব্যবস্থার কারণ হলো যদি কোনো শিক্ষার্থী প্রথম দিনে বই নিতে না পারে, তাহলে তাদের আবার ২ জানুয়ারিতে বই প্রদান করা হবে। এমনকি পয়েলা জানুয়ারি কোনো কারণে বন্ধের দিন হলেও বিগত বছরের দেখেছি বন্ধের দিনেও বই উৎসব পালিত হয়েছে। বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রতিবছর পহেলা জানুুয়ারি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হয়। একটি উৎসবের আমেজে পরিণত হয়েছে। নতুন বছরে নতুন ক্লাসে উঠে নতুন বই হাতে পাওয়ার আনন্দ কতটুকু তা কোমলমতি ছেলেমেয়েরাই বলতে পারবে ভালো।
২০০৩-০৪ সালের কথা, জানুয়ারি মাসে কখনো স্কুল বই আসত। আবার কখনো আসত না। দুই তিন মাস লাগত পুরো বই সেট পেতে। সেই সময়ে চার-পাঁচ বছর পরপর বই নতুন করে সংশোধিত সংস্করণ ছাপানো হতো, তাও আবার কেবল বাংলা বা ইংরেজি বই। পুরাতন বই বেশ কয়েক বছর ব্যবহার করা যেত। মাধ্যমিক স্কুলে তখন এভাবে বিনামূল্যে নতুন বই বিতরণের নিয়ম ছিল না। প্রতিবছরই নতুন ক্লাসের জন্য বই কিনতে হতো। বই বছরের পর বছর সময় মতো শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছেন প্রকাশকরা। আবার বইয়ের মান নিয়েও প্রশ্ন ছিল। অস্পষ্ট ছাপা, নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করা হতো। কিন্তু বর্তমানে পহেলা জানুয়ারিতে ঝকঝক রঙিন নতুন বই শিক্ষার্থীদের হাতে দেওয়া হচ্ছে। তাতে শিক্ষার্থীদের বই পাঠের আনন্দ বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে। প্রথমদিকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দিয়ে শুরু হলেও এখন সব স্কুল ও মাদরাসায় তা বিতরণ করা হচ্ছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানা গেছে, ২০১৯ শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, ইবতেদায়ি, মাধ্যমিক, দাখিল, এসএসসি, এসএসসি ভোকেশনাল, দাখিল ভোকেশনাল সব প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে মোট চার কোটি ২৬ লাখ ১৯ হাজার ৮৬৫ জন শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যের বই বিতরণ করা হবে। এ বছর মোট বইয়ের সংখ্যা ৩৫ কোটি ২১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৮২।
এবারের পেক্ষাপট একটু ভিন্ন। কারণ একাদশ সংসদ নিবাচন ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে। কোন দল বিজয়ী হয়েছে তা ইতোমধ্যে সবাই জেনে গেছেন। শিক্ষামন্ত্রী বারবার দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছেন যে, কোনো সংশয় ছাড়াই ১ জানুয়ারি ২০১৬ তারিখের আগেই সারাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব বই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এমনকি এবার বই ছাপানো সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আর বইয়ের ছাপার মান আগের চেয়ে অনেক ভালো। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১ জানুয়ারি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আজিমপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর আগে দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রধান হাতিয়ার হিসেবে শিক্ষাকে অভিহিত করেছেন। শিক্ষা বিস্তারের জন্য বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণসহ শিক্ষা খাতে বাজেটের এক উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ। জাতি সত্যিকার অর্থেই লাভজনক ও দারিদ্র্যমুক্তির প্রধান হাতিয়ার তা প্রমাণিত হয়েছে। সুশিক্ষিত জাতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিনামূল্যে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবই বিতরণ ও নারীদের অবৈতনিক শিক্ষার যে পদক্ষেপ সরকার নিয়েছে তা বিশ্ব সমাজেরও প্রশংসা অর্জন করেছে। শিশুদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী খুবই সংবেদনশীল। জাতীয় শিশু দিবস পালনের এক অনুষ্ঠানে শিশুদের বইয়ের বোঝা না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে। তা ছাড়া সরকারি স্কুলে এলাকাভিত্তিক মেধাক্রম ও কোটা বিবেচনায় ভর্তির পরামর্শ দিয়েছেন।
সরকারি বিনামূল্যের বই ও বইযের গাইড এখনো কালোবাজারে পাওয়া যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই এটা মনে রাখতে হবে, বই প্রকাশ ও বিতরণকে ঘিরে যে চক্র গড়ে উঠেছিল তারা এখনো সক্রিয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের অনমনীয় মনোভাবই প্রত্যাশিত। একই সাথে মনে রাখা দরকার, বই উৎসবকে তাৎপর্যবহ করতে হলে শিক্ষার মানের দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। পাঠ্যবইয়ের ভেতরে প্রকৃত জ্ঞানের আনন্দ খুঁজে পায় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা এমন ব্যবস্থা করতে হবে। বই উৎসব তখনই সার্থক হবে যখন মানসম্মত শিক্ষার আলো পৌঁছে যাবে দেশের প্রতিটি ঘরে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষা হবে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত।
২০১০ সাল থেকে উৎসবের মাধ্যমে পাঠ্যবই বিতরণ করে আসছে সরকার। শিক্ষার্থীদের হাতে নির্দিষ্ট সময়ে নতুন বই তুলে দেয়া সরকারের একটি চ্যালেঞ্জ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বলা যায়, নববর্ষে শিক্ষার্থীদের জন্য এটি একটি বাড়তি আনন্দের দিন। দেশের প্রতিটি জনপদে চলবে এ উৎসব। নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই প্রতিটি শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই পৌঁছানো নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে বই উৎসব সফল হবে-এ প্রত্যাশা আমাদের।