পেঁয়াজ যে একটা ‘মহা আতঙ্ক’ তা ভুলতে শুরু করেছিল অনেকেই। কিন্তু সে স্বস্তি বেশিদিন কপালে সইল না। ফের লাগাম ছিঁড়েছে পেঁয়াজের। হুট করে এ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৮০ টাকা পর্যন্ত। আর এ দর আরো বাড়তে পারে বলে সাফ জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে পেঁয়াজের এ দরবৃদ্ধির কারণ হিসেবে আবারো অভিযোগ উঠছে ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির আনুকূল্যের ইঙ্গিত। কারণ গত বৃহস্পতিবারে আগামী পবিত্র রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি। সে সময় ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিতও দিয়েছেন। তার পরও তিনি সে বিষয়ে পরিষ্কার কোনো সতর্কতা উচ্চারণ করেননি।
বাজারে ওইদিন থেকেই নতুন করে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা শুরু হয়। প্রথম দিনে দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ২০ টাকা ও গতকাল বেড়েছে ৬০ টাকা পর্যন্ত। সবমিলে দুদিনের ব্যবধানে ভালো মানের প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮০ টাকায়।
এর প্রভাবে চীন ও মিয়ানমার থেকে আমদানি করা বড় পেঁয়াজের দামও বেড়েছে। যে পেঁয়াজ দুদিন আগে ৪০ টাকায় নেমেছিল, তা আবার ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে উঠেছে। একইভাবে বেড়েছে পাতাসহ দেশি মুড়িকাটা পেঁয়াজের দামও। গত সপ্তাহে যে পেঁয়াজ ৬০ টাকার নিচে ছিল, এখন তা ১০০ থেকে ১২০ টাকায়।
এমন পরিস্থিতিতে আবারো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন সাধারণ মানুষ। গতকাল উত্তর বাড্ডা বাজারে রাজিব হোসেন বলেন, পেঁয়াজ নিয়ে চিন্তা ছেড়ে দিয়েছিলাম। কারণ দাম ক্রমাগত কমছিল। কিন্তু হুট করে এই অবস্থা প্রমাণ করে যে পণ্যটি নিয়ে শিগগিরই দীর্ঘ স্বস্তি নেই। মাঝে ফের লাগাম ছিড়েছে পেঁয়াজের মাঝেই কাঁদাবে।
এদিকে ওই বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, শুক্রবার সকালে পাইকারিতে প্রতি কেজি ভালো মানের দেশি পেঁয়াজ ১৬৬ টাকা পর্যন্ত ওঠে। মানে কিছুটা কমতি অথবা আকারে ছোটগুলো ১৫২ টাকা কেজি। এরপর পরিবহন ভাড়া দিয়ে সেসব পেঁয়াজ ১৬০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরায়।
একই অবস্থা রামপুরা বাজারেও। সেখানে বিক্রেতা সিদ্দিক মিয়া বলেন, প্রতিদিন সকালে কারওয়ান বাজার থেকে পেঁয়াজ আনি। বুধবার প্রতি কেজি পেঁয়াজ এনেছি ৯৩ টাকা দরে। বিক্রি করেছি ১০০ টাকায়। বৃহস্পতিবার সেটা কিনতে হয় ১১৪ টাকায়, বিক্রি করতে হয় ১২০ টাকা। আর আজ (গতকাল শুক্রবার) ওই পেঁয়াজই কিনতে হয়েছে ১৫৩ টাকায়। আড়াই শ টাকা পরিবহন খরচ হিসেবে বিক্রি করছি ১৬০ টাকা।
এদিকে জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী লিয়াকত মোল্লা বলেন, হঠাৎই সরবরাহ কমে গেছে। সেই কারণেই দাম বাড়তি। তবে সরবরাহ কেন কম তার কোনো সঠিক কারণ জানা নেই।
তবে এ দরবৃদ্ধি নিয়ে পরিষ্কার জবাব দিয়েছেন রাজধানীর সবচেয়ে বড় কৃষিপণ্যের বাজার শ্যামবাজারের বড় আমদানিকারকদের একজন মো. মাজেদ। তিনি বলেন, গতকাল বাণিজ্যমন্ত্রীকেও পরিষ্কার বলে দিয়েছি, পেঁয়াজের দাম বাড়বে। কারণ দেশি মুড়িকাটা পেঁয়াজ শেষ। চীন থেকেও পেঁয়াজ আসছে না। সরকার গা-ছাড়া দিয়েছে। এখন নতুন পেঁয়াজ (ফেব্রুয়ারির প্রধান মৌসুমের পেঁয়াজ) আসা পর্যন্ত সমস্যা হবে। দাম বাড়বে।
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবারে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে পেঁয়াজের দাম কেমন করে রাতারাতি দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল, সেই ব্যাখ্যা ব্যবসায়ীদের কাছে চেয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, আসন্ন রোজার মাসে বাজার দর যেন যৌক্তিক পর্যায়ে থাকে। নিজে ব্যবসায়ী বলে ‘ব্যবসায়ীদের প্রতি আনুকূল্য দেখানোর’ অভিযোগও তাকে শুনতে হয়েছে। সব মিলিয়ে তিনি এখন বসবাস করছেন ‘আগুনের মধ্যে’। তবে ওই বৈঠকে চলতি সময়ে পেঁয়াজের দাম বাড়তে পারে ব্যবসায়ীদের এমন ইঙ্গিতে নিশ্চুপ ছিলেন তিনি।
গত বছর সেপ্টেম্বরে ভারত সরকার হঠাৎ করেই পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিলে প্রতিদিনের রান্নায় বহুল ব্যবহূত এই সামগ্রীর দাম বাংলাদেশের বাজারে আড়াই শ টাকায় পৌঁছায়, যার নজির অতীতে আর নেই। এরপর পেঁয়াজ উড়োজাহাজে উড়ে আসে, জাহাজে ভেসে আসে। তবে কমেনি দাম। শেষ ডিসেম্বরের শুরুতে দেশি পেঁয়াজ উঠতে শুরু করে। এরপর থেকে কমছিল পেঁয়াজের ঝাঁঝ।
তবে ওই সমই পেঁয়াজ-কাণ্ডে বাণিজ্যমন্ত্রীর ব্যর্থতার প্রশ্ন তুলেছে অনেকেই। মন্ত্রী নিজেও সমস্যা সমাধানে সেকেন্ডের মধ্যে পদত্যাগ করার কথা বলেন। তবে শর্ত থাকে যে ‘তাতে যদি পেঁয়াজের দাম কমে’। এছাড়া বারবার পেঁয়াজের দাম নিয়ে তার উক্তি ও পরপরই দাম বৃদ্ধি ছিল আলোচিত ঘটনা।
যদিও সরকারের কেউ কেউ পেঁয়াজের কারসাজি নিয়ে বিস্তর অভিযোগ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ মজুত করেছেন। যদিও এখনো সেই মজুত বের হয়নি। বাজারে পুরনো দেশি পেঁয়াজও নেই। আর এখন নতুন পেঁয়াজ নেই। এমন পরিস্থিতি চলতি বছরের উৎপাদনেও ফেলছে বড় প্রভাব। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ভারত পেঁয়াজ না দিলে এ বছর ভুগতে হবে সাধারণ মানুষকে।
এমন পরিস্থিতি বৃহস্পতিবার ব্যবসায়ীদের কাছে মন্ত্রীর ভাষ্য ছিল এমন- ‘রোজার মাসে যেন লজিক্যাল হই, রমজানে সহনীয় লাভ করবেন। আজ বাজার (দর) কী আছে এটা এক ঘণ্টার মধ্যে বের করা যায়। পরের স্টেপগুলোর দাম সবার সাথে আলোচনা করে আমরা বেধে দিতে চাই। রিটেইলে ১০ টাকা লাভে ছাড়তে বলেছেন, রাজি হয়ে গেছি, ২০ টাকা বেড়ে গেলে ভোক্তা (ভ্রাম্যমাণ আদালত) না পাঠিয়ে কী করব? বুঝতে পারছেন কথাটা ভাই?’
টিপু মুনশি বলেন, ‘আমাদের পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে। আমাদের কোনো পথ নেই। ভারত যদি ওপেন করে দেয়, আমরা ওয়ে-আউট করব যে আপনাদের কী পরিমাণ লোকসান হচ্ছে। একটাই দোহাই আপনাদের কাছে, রাতারাতি বড়লোক হওয়া যাবে না, রাতারাতি ভাগ্য পরিবর্তন করা যাবে না। রমজান মাসটাকে স্পেশাল কনসিডার করবেন, এটাই আমাদের আবেদন। পেঁয়াজ আমদানি করবই, পেঁয়াজের মাইর আমরা খাব না।’