ফিচার

ফুলকন্যা

  • প্রকাশিত ৩০ নভেম্বর, ২০১৯

সেরাজুম মনিরা

 

শীতের এই বিকালে ছুটির দিনে ঘুরতে বের হয়েছেন। অনেক কষ্টে বের করা এক চিলতে সময় যেন জোর করেই কেটে যাচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত জ্যামে। অতিষ্ঠ হয়ে যখন ক্লান্ত, ঠিক সেই মুহূর্তে আপনার গাড়ির জানালায় কেউ একজন এসে ফিরে গেল। তার এক মুহূর্ত পর অপর এক ফুলওয়ালি বাচ্চা মেয়েটি জানালার কাচে টোকা দিয়ে বলে উঠল, ‘ছার একটা মালা নিবেন, ম্যাডামরে দিয়েন। গেন্দা ফুলির মালা আছে। বকুল ফুলির মালাও আছে, নেন না ছার।’

ফুলের মতো শিশুদের হাতে ফুল। শখ করে নয়, এ ফুল বিক্রির জন্য রাজপথে দাঁড়িয়েছে তারা। রাজধানীর সড়কে ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি থামলেই যাত্রীর সামনে আবদার, ‘একটা ফুল নিন।’ জীবন-বাস্তবতায় এসব শিশুকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই নামতে হয়েছে উপার্জনে। কারো হাতে গোলাপ, কারো হাতে বেলি ফুলের মালা। শাহবাগের ফুল বাজার থেকে চেয়ে কিংবা কুড়িয়ে আনা ফুলই এসব শিশু বিক্রির জন্য বেছে নেয়। কেউ ফুল নেয়, কেউ বা ফিরেও তাকায় না। আবার কেউ কেউ আছেন, ফুলের মতো শিশুর হাতে তুলে দেন অতিরিক্ত টাকা। এভাবেই এসব শিশু উপার্জন করে বাবা-মার হাতে তুলে দিচ্ছে অর্থ; যা সংসার চালাতে কাজে লাগছে।

ঢাকা শহরের বিভিন্ন সিগন্যাল ও পার্কে বিশেষ করে বিজয় সরণি, ফার্মগেট, পান্থপথ সিগন্যাল, খামারবাড়ি, সংসদ ভবনের সামনে, বসুন্ধরা শপিং মলের সামনে, শাহবাগ, গুলিস্তান, টিএসসি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ধানমন্ডি ৩২, রমনা পার্ক, চন্দ্রিমা উদ্যান, বোটানিক্যাল গার্ডেনসহ বিভিন্ন স্থানে হাতে নিয়ে ফুল বিক্রি করতে দেখা যায় অনেক শিশুকে। এর মধ্যে রয়েছে বকুল ফুল, বিভিন্ন রঙের গোলাপ, রজনীগন্ধা, কাঁঠালচাঁপাসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফুল। এসব ক্ষেত্রে অধিকাংশ ফুল বিক্রেতাই হয়ে থাকেন পথশিশু এবং উদ্বাস্তু শিশু। যাদের অনেকের বাবা আছে তো মা নেই, মা আছে তো বাবা নেই।

আবার অনেকের বাবা-মা কোনোটাই নেই। অনেকে তাদের বাবা-মায়ের খোঁজ পর্যন্ত জানেন না। কেউ তাদের ছোট ভাই-বোন অথবা অসুস্থ বাবা-মায়ের ওষুধের টাকা জোগাতে ফুল বিক্রি করে। তবে ইদানীং ফুল বিক্রিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে কিছু প্রতিবন্ধী শিশুও। তারা ভিক্ষা না করে অভিনব পদ্ধতিতে ফুল বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। এমনকি বিদেশি নাগরিকদের আকৃষ্ট করতে এবং তাদের কাছে ফুল বিক্রির জন্য আজকাল এই ফুল বিক্রেতা পথশিশুরা টুকটাক ইংরেজি ভাষাও শিখছে। আর তাদের এই বিদেশি বা ইংরেজি ভাষা শিখতে সাহায্য করছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বড় আপু ও ভাইয়ারা। তবে এসব শিশু দুই হাত পেতে ভিক্ষা নিতে একদমই নারাজ।

রাইসা। বয়স ১২। হাতে থাকা গোলাপের ঝুড়িটা তার চেহারার কাছে বড়ই ম্লান লেগেছিল। দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে চন্দ্রিমা উদ্যানে মায়ের সঙ্গে ১০ মিনিটের কর্মবিরতিতে গাছের ছায়ায় বসেছিল রাইসা।

কাছে যেতেই মিষ্টি একটি হাসি দিয়ে জানতে চাইল, ‘ফুল নেবেন।’ না সূচক মাথা নেড়ে ফুল বিক্রির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে রাইসা জানায়, ছয় বছর বয়স থেকে ফুল বিক্রি করে। বিজয় সরণি সিগন্যাল এবং চন্দ্রিমা উদ্যানে নিয়মিত ফুল বিক্রি করে। তার কোনো ভাই-বোন নেই। সে যখন খুব ছোট, তখন তার বাবা সুমি ও তার মাকে ফেলে দ্বিতীয় বিয়ে করে অন্যত্র চলে যায়। মা নাজমা বেগমকে নিয়ে আগারগাঁও বিএনপি বস্তিতে থাকে। মা অসুস্থ থাকায় মেয়ের ফুল বিক্রির টাকায় সংসার চলে তাদের। প্রত্যেক দিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকার ফুল বিক্রি হয়। সে আগে প্রাইভেট একটি স্কুলে পড়ালেখা করেছে। পূর্বের বস্তিবাড়ি ভেঙে দেওয়ায় নতুন জায়গায় গিয়ে আর ভর্তি হতে পারেনি।

তৈয়বা। বয়স ৯। ৫ বোন ১ ভাইয়ের মধ্যে সে সবার ছোট। বাবা-মায়ের সঙ্গে রেডিও সেন্টার এলাকায় থাকে। বাবা ভ্যান চালায়। মা বাসায় থাকেন। হাসি আর খুশি দুই বোন খামারবাড়ি ও ফার্মগেটে ফুল বিক্রি করে। দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করলেও আর্থিক সংকটে আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। হাসি বলে, স্কুলে যেতে মন চায়। কিন্তু স্কুলে পড়তে তো টাকা লাগে। আমরা ভাত খামু নাকি স্কুলের টাকা দিমু।

নাজমুলের বয়স মাত্র ৭ বছর। ভাঙা ভাঙা দু-একটি ইংরেজি বলতে পারে। পড়ালেখা করতে পারেনি; তাতে কী হয়েছে? লেকের পাড়ে ঘুরতে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের আপু-ভাইয়াদের কাছ থেকে টুকটাক ইংরেজি শিখে নিয়েছে। কারণ লেকের পাশে অনেক সময় বিদেশি পর্যটকরা ঘুরতে আসেন। তাদেরকে যখন ইংরেজিতে ফুল নেবেন স্যার অথবা ম্যাম বলা হয় তখন তারা মুগ্ধ হয়ে হেসে দেয় এবং ফুল কেনার আগ্রহ প্রকাশ করে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আয় রোজগারের কৌশলে একদম পিছিয়ে নেই নাজমুল। ৩ বছর বয়স থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর লেকে ফুল বিক্রি করে নাজমুল। ৮ ভাই-বোনের মধ্যে সে ৬ষ্ঠ। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ৬০ ফিট এলাকার মাথায় ভাঙা ব্রিজের কাছে থাকে। ফুল বেচে নাজমুল যে টাকা পায়, তার কিছু অংশ ছোট এক ভাইয়ের পড়ালেখায় ব্যয় করে। নাজমুল জানায়, আমি আর আমার মামাতো বোন মিলে ফুল বিক্রি করি। প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার ফুল বিক্রি হয়। কোনো দিন আবার ১ হাজার টাকার ফুলও বিক্রি হয়।

লাবিবা। চার ভাই-বোনের মধ্যে সে সবার বড়। বয়স ১২। বাসা আগারগাঁও বস্তিতে। মা আছেন। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেছেন। চার বছর বয়স থেকে শাহবাগ সিগন্যালে ফুল বিক্রি শুরু। প্রত্যেক দিন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার ফুল বিক্রি হয়। বৃষ্টি জানায়, ফুল বিক্রি করার সময় রাস্তায় যদি কেউ খারাপ ব্যবহার করে, তাহলে আমি শুনেও না শোনার ভান করে পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে যাই।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads