আফসানা রিজোয়ানা সুলতানা
বর্তমান বিশ্বের সব থেকে বিরোধপূর্ণ অঞ্চল ফিলিস্তিন। ৭০ বছর ধরে ফিলিস্তিনিরা নিজেদের ভূমিতে নিগ্রহের শিকার হয়ে আসছে। নিজেদের অধিকারটুকু আদায়ের লক্ষ্যে তাদের প্রতিনিয়ত লড়ে যেতে হচ্ছে ইসরাইলিদের সাথে। ১৯৪৭ সালে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত এ অঞ্চলে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই আছে। তারই ধারাবাহিকতায় ফিলিস্তিনে গত ৯ তারিখ থেকে আবার উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এবার সংঘর্ষের শুরু হয় মূলত ফিলিস্তিনিদের দামেস্ক গেটে পবিত্র রাত লাইলাতুল কদর উপলক্ষে নামাজ আদায়ে ইসরাইলি বাহিনীর বাধা দেওয়ার কারণে। এ ছাড়া বেশ কিছুদিন ধরেই এই অঞ্চলে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। পূর্ব জেরুজালেমের আরব অধ্যুষিত এলাকা শেখ জারাহ থেকে বেশ কিছু ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের পরিকল্পনা করছিল ইসরাইল, যা স্থানীয় ফিলিস্তিনদের ক্ষুব্ধ করে তোলে।
ফিলিস্তিন সংকটকে বুঝতে হলে আমাদের একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। ভৌগোলিক দিক থেকে ফিলিস্তিন মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থানে অবস্থিত। এর দু’পাশে রয়েছে ভূমধ্যসাগর ও জর্ডান নদী। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভূমধ্যসাগর ও জর্ডান নদীর ভূমিকা অপরিসীম। আবার ধর্মীয় কারণেও স্থানটি মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের নিকট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফিলিস্তিন ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে এবং অটোমান সাম্রাজ্য ছিল ব্রিটিশ বিরোধী জোটে। তখন ফিলিস্তিনিদের আকাঙ্ক্ষা ছিল অটোমানদের থেকে স্বাধীনতা আর ব্রিটিশদের দরকার ছিল ফিলিস্তিনিদের সাহায্য। এমন একটি সমীকরণের মুখে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোর ফিলিস্তিনিদের আশ্বাস দেন, যুদ্ধে ব্রিটিশ জোট জয়ী হলে ফিলিস্তিনিরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পাবে। অন্যদিকে ব্রিটিশদের তখন বোমা তৈরির উপকরণ ফুরিয়ে আসছিল। ঠিক ওই সময়ে ইহুদি ড. হেইস বাইজম্যান বোমা তৈরির উপকরণ কৃত্রিম ফসফরাস তৈরি করে ব্রিটিশদের সহযোগিতা করেন, বিনিময়ে স্বজাতিদের জন্য চেয়ে নেন একটি স্থায়ী ঠিকানা। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯১৭ সালে ব্রিটেন বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এবং ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। ঐ বছরই ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ জে বেলফোর ব্রিটিশ জায়নিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি লর্ড রথচাইল্ডকে ইহুদিদের জন্য একটি আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার কথা জানিয়ে চিঠি দেন। ইতিহাসে এটি বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত। বেলফোর ঘোষণার সাথে সাথে ফিলিস্তিনিদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
১৯২১ সালে ইহুদিরা ফিলিস্তিনিদের তাড়ানোর জন্য গড়ে তোলে অনেক গোপন সংগঠন। এর মধ্যে কুখ্যাত কিছু সংগঠন হলো হাগানাহ, ইরগুন ও স্ট্যার্ন গ্যাং। হত্যা, ধর্ষণ, ধ্বংসযজ্ঞ এমন কোনো অপরাধ ছিল না যা তারা করেনি। ইসরাইল রাষ্ট্র গঠন হওয়ার পর এই প্রশিক্ষিত বাহিনীগুলোই ইসরাইলের সামরিক বাহিনী গঠন করে। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে বসবাস শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনী প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করে। তখন ইউরোপ থেকে বিপুল পরিমাণে ইহুদি ফিলিস্তিনে আসতে শুরু করে। ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘ ফিলিস্তিন অধ্যুষিত আরব এলাকা বিভিক্ত করে একটি প্রস্তাব অনুমোদন করে। সেখানে ফিলিস্তিনের মোট ভূমির ৫৬.৫% নিয়ে ইহুদি অধ্যুষিত ইসরাইল রাষ্ট্র এবং ৪৩.৫% ভূমি নিয়ে মুসলিম অধ্যুষিত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। মোট জনগণের মাত্র এক-চতুর্থাংশ ইহুদি হওয়া সত্ত্বেও ইসরাইল মোট ভূমির অর্ধেকেরও বেশি পায়। ১৯৪৮ সালের ১২ মে ঠিক রাত ১২টায় ইহুদিরা ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণা করে। এর ১০ মিনিটের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ব্রিটেনও ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়।
তখন থেকেই ইসরাইল-ফিলিস্তিন বিরোধের শুরু। এরপর আরবদের সঙ্গে ইসরাইলিদের হয়ে গেছে চারটি যুদ্ধ। ১৯৪৮ সালে ১৪ মে ইসরাইলের সাথে সিরিয়া, মিসর, জর্ডান, লেবানন এবং ইরানের যুদ্ধ শুরু হয়। প্রায় ১০ মাস ধরে চলেছিল সেই যুদ্ধ। প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি ইসরাইলের অংশ হওয়া অঞ্চল থেকে পালিয়ে যায় পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে। ১৯৬৭ সালে মিশর, জর্ডান ও সিরিয়া আবার ইসরাইলের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ছয় দিনব্যাপী সেই যুদ্ধে জয়ী হয় ইসরাইল। দখল করে নেয় গাজা উপত্যকা, মিসরের সিনাই মরুভূমি, সিরিয়ার গোলান মালভূমি, জর্ডানের পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম। পরে ইসরাইল এবং আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আরো অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, অনেক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে; কিন্তু সেখানে কোনো স্থায়ী শান্তি ফিরে আসেনি। প্রতিদিন দখলদারি ইসরাইলিদের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ এক ঘোষণার মাধ্যমে তিন ধর্মের মানুষের কাছেই অতি পবিত্র বলে বিবেচিত জেরুজালেম নগরীকে আন্তর্জাতিক জোন হিসেবে রাখার প্রস্তাব করে। কিন্তু সে প্রস্তাব অমান্য করে ইসরাইল ১৯৮০ সালে সমগ্র জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে। আমেরিকান প্রেসিডেন্টের এ পদক্ষেপে বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে। ইউরোপের অনেক রাষ্ট্রনেতাও ট্রাম্পের এমন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। গত বছর ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর উপস্থিতিতে ফিলিস্তিন ও ইসরাইলকে নিয়ে একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। আশ্চর্যজনকভাবে সেখানে ইসরাইলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকলেও ফিলিস্তিনের কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। ট্রাম্প এ পরিকল্পনাকে ‘শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চুক্তি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো ফিলিস্তিনদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনো প্রতিফলনই ঘটেনি ট্রাম্পের তথাকথিত এই শান্তিচুক্তিতে। ট্রাম্পের শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন হলে ফিলিস্তিন একটি খণ্ড রাষ্ট্রে পরিণত হবে, যার চারদিকে থাকবে ইসরাইল রাষ্ট্র। ইতোমধ্যে (২৫ মার্চ, ২০১৯) গোলান মালভূমিকে ইসরাইলি ভূখণ্ডের স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর এখন এই শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পশ্চিম তীর এবং জর্ডান ভ্যালিকে ইসরাইলীকরণ করার প্রস্তাব রাখা হলো। ইসরাইলের রাষ্ট্রপ্রধান নেতানিয়াহুও জর্ডান উপত্যকা ও অধিকৃত ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ইসরাইলের সাথে একীভূত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা পূর্ব জেরুজালেম, গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীর নিয়ে তাদের রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। উল্লেখ্য, ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলের কাছে ঐ অঞ্চলগুলো হারিয়েছিল।
বলাবাহুল্য ট্রাম্পের শান্তিচুক্তি অনেকাংশে ইনন পরিকল্পনার সাথে মিলে যায়। ওডেড ইনন (Oded Yinon) একজন কট্টর ইহুদি স্ট্রাটেজিস্ট। পেশাগত দিক থেকে তিনি একজন শিক্ষক ও গবেষক। ইনন তার লেখা একটি বইতে (A Strategy for Israel in the Nineteen Eighties) লেবাননকে ভেঙে পাঁচটি রাষ্ট্র এবং সিরিয়াকে ভেঙে একাধিক রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি একদিকে চেয়েছেন মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে পরিণত হোক, আর অন্যদিকে চেয়েছেন ইসরাইলের সীমানা আরো প্রসারিত হোক। ট্রাম্পের ‘শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চুক্তি’তে আমরা তেমনিই কিছুর ইঙ্গিত পাই। ইসরাইলের ‘হারেৎস’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল ডানপন্থিদের পরিকল্পনা হচ্ছে জর্ডান উপত্যকা দখল করে নেওয়া। ট্রাম্পের শান্তিচুক্তির ধারাবাহিকতায় ইসরাইলি বাহিনীর শেখ জারাহ থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের পরিকল্পনা সাম্প্রতিক সংঘর্ষের অন্যতম কারণ। তাই বলা যায়, একতরফা এই চুক্তি ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারবে না। একটি স্থিতিশীল ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে সব থেকে জরুরি হলো আরব বিশ্বের দেশগুলোর ঐক্য।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আরব রাষ্ট্রগুলো এ সমস্যা সমাধানে কখনো একমত হতে পারেনি। আরব বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক অনেক জটিল এবং নানা কারণে বিভিন্ন সময় প্রভাবিত হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক এই ঘটনা প্রবাহ ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকটকে কোন দিকে প্রবাহিত করে সেটিই এখন দেখার বিষয়।
লেখক : শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়