পরিণতি না জেনে প্রতিদিন আমরা বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক দ্রব্য আবর্জনা হিসেবে যেখানে সেখানে ফেলে দিচ্ছি। পানি, কোমলপানীয়, জুস, চিপস এসব খেয়ে উচ্ছিষ্ট হিসেবে প্লাস্টিক বোতলটি অথবা চিপস, চানাচুরের প্যাকেটটি ফেলে দিই। এসব পণ্যের মোড়ক বা বোতল ব্যবহারের পর আবর্জনা হিসেবে ফেলে দেওয়া হলে এগুলোর দূষণ সৃষ্টি করে পরিবেশের।
আমাদের পরিবেশ বিষয়ে অসচেতনতার অন্যতম উদাহরণটি হলো- আমরা সচেতনভাবে খালি হাতে বাজারে গিয়ে ৫ থেকে ১০টি পলিথিন ব্যাগ নিয়ে ঘরে ফিরি। অন্যদিকে আমরা ধারণাও করতে পারি না যে, সাবান, মুখের ক্রিম, টুথপেস্ট, ডিটারজেন্ট এবং অন্যান্য প্রসাধনী দ্রব্যাদির মাধ্যমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্লাস্টিক পরিবেশের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাস্টিকের কণাগুলো এতই ক্ষুদ্র যে, মাছ খাদ্য হিসেবে সেগুলো খেয়ে বড় হচ্ছে আর আমরা ওই মাছগুলো খাচ্ছি, যা ক্যানসার রোগের অন্যতম কারণ। পলিথিন এমন একটি উপাদানে তৈরি, যা থেকে বিষ নির্গত হয় এবং খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মিশে যায়।
পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার প্লাস্টিক কাঁচামাল আমদানি করে। আর এ থেকে প্রতিদিন প্রায় ২৪ হাজার টন বর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ বা প্রায় এক হাজার ৭০০ টনই প্লাস্টিক।
পরিসংখ্যান বলছে, শুধু ঢাকা শহরেই প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহূত হচ্ছে। ডাস্টবিনে ফেলা পলিথিন বৃষ্টির পানির সঙ্গে ড্রেনে ঢোকার ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতার জন্য ৮০ শতাংশ দায়ী এই পলিথিন ব্যাগ।
সমীক্ষায় জানা গেছে, প্রকৃতিতে প্লাস্টিক মিশে যেতে ১০০ থেকে ৫০০ বছর লেগে যায়। মাইক্রো অর্গানিজম বা অণুজীবরা এগুলো নষ্ট করতে পারে না। আবহাওয়ার কারণে ছোট ছোট টুকরা হয়ে বাতাসে বা পানিতে ভাসতে থাকে এসব ব্যাগ, যা পরিবেশ ও প্রাণিজগতের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে।
প্লাস্টিক বর্জ্য দূষণের মাত্রা ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। কারণ এসব বোতল, মোড়ক বা প্যাকেট, ব্যাগ কখনো মাটিতে মিশে না। আর যত্রতত্র ফেলে দেওয়ার ফলে এটি তৈরি করে জলাবদ্ধতা।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরে একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে চারটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। সে হিসেবে শুধু ঢাকাতেই প্রতিদিন দুই কোটির বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। এগুলো দিয়ে ড্রেন, নালা-নর্দমা, খাল, ডোবা ইত্যাদি ভরাট হয়ে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার প্রকোপ বাড়ছে। প্লাস্টিকের ব্যাগ, বোতল, আসবাবপত্র, দাঁতের ব্রাশ ইত্যাদি পানিতে পড়ে একটা আস্তরণের সৃষ্টি করে। এগুলোর জন্য জলজ প্রাণীগুলোর করুণ পরিণতি হয়। প্লাস্টিকের টুকরাগুলো খাবার জিনিস মনে করে তারা খেয়ে ফেলে। এসব জিনিস প্রাণীরা হজম করতে পারে না আবার মলের সঙ্গেও বের হয় না। আবার অনেক সময় গলায় আটকে শ্বাসরোধ হয়ে মারা যায়। গবেষকরা অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে প্রতি দুটির মধ্যে একটি সামুদ্রিক পাখির দেহে প্লাস্টিকের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন- এই প্রবণতা বৃদ্ধি পেলে ২০৫০ সালের মধ্যে ৯৫ শতাংশ প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে মাছ, শামুক, তিমি, ডলফিন, কুমির এসব প্রাণী ঝুঁকির সম্মুখীন।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম জার্নালে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সমুদ্রদূষণের ভয়াবহতা দিন দিন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রে মাছের চেয়ে বেশি থাকবে প্লাস্টিক। সংস্থাটি বলছে, গত ৫০ বছরে প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ ৫০ শতাংশ বেড়েছে যা আগামী ২০ বছরে এর পরিমাণ দ্বিগুণ হতে পারে। প্রত্যেক বছর প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ বাড়ছে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। সংস্থাটি আরো জানায়, প্রতি মিনিটে মানুষ যত পরিমাণ প্লাস্টিক জমা করছে তা একটা গারবেজ ট্রাকের সমান।
জানা গেছে, বর্তমানে মাছ ও প্লাস্টিকের অনুপাত ১ঃ৫। ২০৩০ সালে এ অনুপাত হবে ১ঃ৩। এক সমীক্ষায় বলা হয়, বাংলাদেশে ১৯৯০ সালে ১৫ হাজার মেট্রিক টন প্লাস্টিক ব্যবহূত হয়, যা ২০১০ সালে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ ২০ বছরে ব্যবহার বেড়েছে ৫০ গুণ।
বর্তমানে ছোট, মাঝারি ও বড় ৫ হাজার শিল্পকারখানায় ১২ লাখ মেট্রিক টনের বেশি প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। সে হিসাবে প্লাস্টিক পণ্যের জনপ্রতি ব্যবহার বছরে ৭ দশমিক ৫ কেজি। ব্যাপারটি অবশ্যই ভাবনীয়। আবার বাংলাদেশে ব্যবহূত প্লাস্টিকের মাত্র ৫০ শতাংশ রিসাইকেল করা হয়।
ভয়ানক খবরটি হচ্ছে, গত ২৮ বছরে বাংলাদেশে প্লাস্টিক দ্রব্যাদির ব্যবহার ৮০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)। ১৯৯০ সালের দিকে বাংলাদেশে ১৫ হাজার মেট্রিক টন প্লাস্টিকের ব্যবহার হলেও ২০১৮ সালে ব্যবহূত হচ্ছে ১২ লাখ মেট্রিক টন।
আশ্চর্যজনক ব্যাপারটি হচ্ছে- বাংলাদেশে প্লাস্টিকের ব্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে আইন থাকলেও অন্যান্য প্লাস্টিক পণ্যের ক্ষেত্রে তা নেই। এ কারণে দেশে প্লাস্টিকের বস্তা ও পলিথিনের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। পরিবেশ সচেতনরা বাজেয়াপ্ত প্লাস্টিকের বোতল ও অন্যান্য জিনিস ফেলে না দিয়ে কী করে এসব ব্যবহার করে সৃজনশীল উপকরণ তৈরি করা যায় তারই চেষ্টা চালায় ইকোব্রিকস নামক একটি পরিবেশ সচেতনতাবাদী প্রতিষ্ঠান। তারা মানুষকে প্লাস্টিক বোতলের মধ্যে নরম প্লাস্টিক বর্জ্য ভরে ব্লক তৈরির জন্য উৎসাহিত করছে। এসব ব্লক দিয়ে ভবন, দেয়াল ও আসবাবপত্র তৈরি করা যায়। ইকোব্রিকস-এর মতে, প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধে খরচবিহীন পন্থা এটি, ফলে এ মুহূূর্ত থেকে মানুষ তা গ্রহণ করতে পারে।
ইকোব্রিকস ওয়েবসাইটের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ গাইডটি বর্তমানে ফিলিপাইনের আট হাজার স্কুলের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফিলিপাইনে গড়ে উঠেছে আরো অনেক খেলার মাঠ, বাগান ও ভবন যা ইকোব্রিক বা পরিবেশবান্ধব উপায়ে প্লাস্টিক ব্লক দিয়ে তৈরি। কেবল ফিলিপাইন নয়, পরিবেশের প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধে যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকাও এরই মধ্যে ইকোব্রিক ব্যবহার শুরু করেছে।
এ বিষয়ে ড্রেনেজ সিস্টেমে প্লাস্টিক এবং অন্যান্য দূষিত পদার্থ থেকে নদী ও সাগরকে বাঁচাতে অস্ট্রেলিয়া একটি বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে। ড্রেনের মুখে জাল লাগিয়ে পানির সঙ্গে ভেসে আসা সব প্লাস্টিক বর্জ্যকে আটকে অপসারণ করা হচ্ছে। এর ফলে এসব প্লাস্টিক নদী বা সাগরে যেতে পারছে না। এরা এই কাজটি নিয়মিতভাবে তদারকির জন্য একটি বিভাগকে দায়িত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশেও এমন উদ্যোগ অনুসরণীয় হতে পারে।
পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে জ্বালানি
পটুয়াখালীর যুবক মোহাম্মদ হালিম পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে জ্বালানি গ্যাস, তেল ও পিচ্ছিলকারক পদার্থ উৎপাদনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন পটুয়াখালীর যুবক মোহাম্মদ হালিম। স্থানীয়ভাবে তৈরি এ যন্ত্রের মাধ্যমে মারাত্মক পরিবেশদূষণ রোধ করা সম্ভব বলছেন হালিম। ১১ বছর জার্মানিতে ছিলেন তিনি। ওয়ার্কশপে কাজের সময় এমন প্রযুক্তির কথা চিন্তা করেন তিনি। দেশে ফিরেই তৈরি করেন একটি যন্ত্র। এর মাধ্যমে পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে তৈরি করছেন জ্বালানি গ্যাস, তেল ও বিভিন্ন পিচ্ছিলকারক দ্রব্য। বর্জ্যকে মূল্যবান সম্পদে রূপান্তরের এ কৌশল দেখে অভিভূত এলাকাবাসী। দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারি উদ্যোগে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার এ প্রযুক্তি গ্রহণ করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখার কথা বলছেন স্থানীয়রা।
পুরনো পলিথিন পুড়িয়ে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও ছাপাকাজে ব্যবহারের কালি উৎপাদন করেছেন জামালপুরের তৌহিদুল
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত ‘ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড ২০১৭’তে তার নিজের ওই উদ্ভাবন নিয়ে এসে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ বিশেষ করে উদ্যোক্তাদের নজর কেড়েছেন। পুরনো পলিথিন পুড়িয়ে জ্বালানি তেল উৎপাদন করেছেন তিনি। শুধু তেলই না, মিথেন গ্যাস ও ছাপাকাজে ব্যবহারের জন্য কালিও বানিয়েছেন তিনি পলিথিন থেকেই। ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক থেকেও একইভাবে জ্বালানি তেল তৈরি করেছেন তৌহিদুল।
২০১১ সালে তিনি সফলভাবে প্রথম তেল উৎপাদন করেছিলেন। নিজ অধ্যবসায় এবং মেধা দিয়ে নব উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশব্যাপী আলোড়ন তুলেছেন তিনি। ফেলে দেওয়া পলিথিন থেকে তিনি বানিয়েছেন জ্বালানি তেল!
তৌহিদুল ইসলামের বয়স ২৫। জামালপুর কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং পলিটেকনিক থেকে ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং করেছেন তৌহিদুল। তার ভাষ্যমতে, ১০০ কেজি পলিথিন থেকে ৭০ কেজি জ্বালানি তেল, ১০ কেজি মিথেন গ্যাস ও ২০ কেজি ছাপাকাজের কালি তৈরি করা যায়। এভাবে উৎপাদিত ১ কেজি জ্বালানি তেলের খরচ পড়ে মাত্র ১৭ টাকা। তার উদ্ভাবিত যন্ত্র জ্বালানি তেল পরিশোধনও করতে পারে। পলিথিন পুড়িয়ে প্রথম যে তেলটা আসে সেটা হয় কালচে রঙের। পরিশোধিত করার পর তা দেখতে হয়ে যায় হলুদ রঙের!