আমদানি-রফতানি

প্রায় ৫ লাখ টন আমদানির অনুমতি

  • মোহসিন কবির
  • প্রকাশিত ১২ জানুয়ারি, ২০২১

ভোক্তাদের পাশাপাশি গেল কয়েক মাস ধরে চালের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে সরকার। চালের দামের লাগাম টানতে খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চালের দাম নির্ধারণ করে দিলেও সামান্যতম প্রভাব পড়েনি বাজারে। বরং এরপরও দফায় দফায় বেড়েছে সব শ্রেণির মানুষের ক্ষুধা নিবারণের অত্যাবশ্যকীয় এই নিত্যপণ্যটির দাম।

বিভিন্ন সূত্র বলছে, এক বছরে (জানুয়ারি, ২০২০ থেকে) প্রায় সব ধরনের চালের দাম পাইকারি পর্যায়ে কেজিতে ৮-৯ টাকা এবং খুচরা পর্যায়ে ১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে এতে নাভিশ্বাস উঠেছে নিম্নআয়ের মানুষের জীবনে। আমনের ভরা মৌসুমেও বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ছাড়িয়েছে ৫০ টাকারও বেশি। আর সরু (মিনিকেট) চাল বিক্রি হচ্ছে ৬২ টাকা থেকে ৬৫ টাকায়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ ১০ জানুয়ারির তথ্য অনুযায়ী, সরকারি গুদামগুলোতে মোট ৭ দশমিক ২০ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে। এর মধ্যে ৫ দশমিক ৩১ লাখ টন চাল এবং গম ১ দশমিক ৮৯ লাখ টন। চালের মজুতের এই পরিমাণ গত বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেক।

এসব কারণে বাধ্য হয়ে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিদায়ী বছরের ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে আমদানির সুযোগ উন্মুক্ত করা হয়। গত ২৭ ডিসেম্বর চালের আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করার ঘোষণা দেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।

এরপর গত ৬ এবং ১০ জানুয়ারি খাদ্য মন্ত্রণালয় বেসরকারি পর্যায়ে ১৮৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৪ লাখ ৮৭ হাজার টন সিদ্ধ চাল আমদানির অনুমতি প্রদান করেছে। ৬ জানুয়ারি, ৪৯টি প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ ৭৪ হাজার ৫০০ টন এবং ১০ জানুয়ারি ১৩৬টি প্রতিষ্ঠানকে বাকি ৩ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টন চাল ৭ দিনের মধ্যে এলসি খোলার শর্তে অনুমতি দেওয়া হয়। এ সংক্রান্ত তথ্য (পোর্ট অব এন্ট্রিসহ) খাদ্য মন্ত্রণালয়কে তাৎক্ষণিকভাবে ইমেইলে জানাতে হবে। এছাড়া আমদানির শর্ত অনুযায়ী যেসব প্রতিষ্ঠান ১ হাজার থেকে ৫ হাজার টন চাল আমদানি করবে তাদের এলসি খোলার ১০ দিনের মধ্যে আমদানির ৫০ শতাংশ এবং ২০ দিনের মধ্যে পুরো চাল বাজারজাত করতে হবে। আর ৫ হাজারের ওপর থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টন আমদানিকারকদের এলসি খোলার ১৫ দিনের মধ্যে ৫০ শতাংশ এবং ৩০ দিনের মধ্যে সব চাল বাজারজাত করার বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। তবে বরাদ্দের অতিরিক্ত আইপি বা ইমপোর্ট পারমিট জারি করা যাবে না বলে নির্দেশনা জারি করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এর বাইরে সরকারি পর্যায়ে রেশনিং, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ও অন্যান্য প্রয়োজনে আমদানি করা হচ্ছে আরো চার লাখ টন চাল।

এদিকে চাল আমদানির সিদ্ধান্তে গত ২-৩ দিনে পাইকারি বিভিন্ন আড়তে কেজিতে ২ টাকা কমেছে প্রায় সব ধরনের চালের দাম। তবে মিল এবং আড়তের প্রভাব এখনো পড়েনি খুচরা দোকানগুলোতে। রাজধানীর বাদামতলী ও বাবুবাজার চাল আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. নিজাম উদ্দীন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ভারত থেকে চাল আমদানির খবরে বর্তমানে কেজিতে ২ টাকা চালের দাম কমেছে। তিনি বলেন, আমদানি করা চাল বাজারে আসলে আরো কমে আসবে চালের দাম। তবে ভারত থেকে আমদানি করা চালের দাম কি রকম হবে তার ওপরই নির্ভর করবে চালের বাজারদর কতটুকু নামবে। এছাড়া গত ৬ জানুয়ারি সরকার ৪৯টি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় পৌনে দুই লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়ার পর কুষ্টিয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন চালের মিলে বিক্রি কমে গেছে বলে জানিয়েছেন মিল মালিকরা। তারা জানান, আমদানির খবরে চালের দাম কমে যাওয়ার ভয়ে অনেকেই চাল কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের মেসার্স জিন্নাহ অটো রাইস মিলের মো. জিয়াউর রহমান টেলিফোনে বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘গত এক সপ্তাহে তাদের মিল থেকে মাত্র ২-৩ ট্রাক চাল বিক্রি হয়েছে। যেখানে প্রতিদিন কয়েক ট্রাক চাল বিক্রি করেন তারা।’ কারণ হিসেবে তিনি জানান, চালের এলসি খোলার কারণে আড়তদাররা মিলারদের কাছ থেকে চাল কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। আর এ কারণে চালের দামও কিছুটা কমেছে। বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করেন বাদামতলী ও বাবুবাজার চাল আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. নিজাম উদ্দীনও। তিনি বলেন, মিলারদের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে চাল কেনার পর যদি ভারত থেকে আসা চালের কারণে দাম কমে যায় তাহলে লোকসানের মুখে পড়তে হবে। এ ভয়ে অনেকেই মিলারদের কাছ থেকে চাল কিনছেন না। নিজেদের স্টকে থাকা চাল বর্তমানে বাজারে বিক্রি করছেন তারা।

তবে মিল ও পাইকারি বাজারের প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি খুচরা দোকানগুলোতে। রাজধানীর কয়েকটি খুচরা দোকানদারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে এ তথ্য। রাজধানীর বাড্ডা এলাকার খুচরা চাল বিক্রেতা মোস্তফা জানান, বর্তমানে তাদের দোকানে যেসব চাল রয়েছে সেগুলো বেশি দামে কেনা। এসব চাল বিক্রি কমদামে বিক্রি করলে লোকসান গুনতে হবে তাদের। আগের চাল বিক্রি হয়ে গেলে শিগগিরই খুচরা পর্যায়ে চালের দাম কমে আসবে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।  

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদন বলছে, গেল বছরের (২০২০) ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে সপ্তাহে চিকন চালের (মিনিকেট, নাজিরশাইল) দাম ২ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেড়ে প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৬৬ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি মানের পাইজাম ও লতাশাইলের দাম ১ দশমিক ৮০ শতাংশ বেড়ে প্রতি কেজি ৫৩ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গেল বছর সরকারের খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মিলার এবং পাইকারি বিক্রেতাদের সাথে বৈঠকের পর ২৯ সেপ্টেম্বর চালের পাইকারি মূল্য নির্ধারণ করে দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। সেই সময় প্রতি কেজি সরু মিনিকেট চাল ৫১ টাকা ৫০ পয়সা এবং মাঝারি মানের চাল প্রতি কেজি ৪৫ টাকা দর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। কিন্তু সরকারের সেই নির্দেশনা মানেনি কেউ। উল্টো এরপরও কয়েক দফা চালের দাম বেড়েছে। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এবং কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক দাম বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন সময় মিলারদের কারসাজিকে দায়ী করেছেন। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘বাংলাদেশের মিলার, আড়তদার, জোতদারদের যারা চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে তারা দাম বাড়ায়। এবারো তারা সেই কাজ করছে। এই মৌসুমের সময় এখনো তারা ধান কিনছে। ধানের দাম ও চালের দাম দুটিই তারা বাড়িয়ে দিয়েছে।’ কৃষিমন্ত্রী জানিয়েছেন, চলতি বছর দুই দফা বন্যার কারণে আউশ ও আমন ফলনের কিছু ক্ষতি হয়েছে। তবে উৎপাদনের যে পরিসংখ্যান সরকারের হাতে আছে, তাতে চালের এত ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। সরকারের সাথে সুর মিলিয়ে পাইকারি বিক্রেতারাও দায় চাপিয়েছেন চালকল মালিকদের ওপর। অন্যদিকে সরকারের বক্তব্যকে ডাহা মিথ্যা বলে দাবি করে মিলারদের অভিযোগ, প্রকৃত কারণ খুঁজে বের না করে অযথা মিলারদের দায়ী করছে সরকার। তাদের দাবি, পেছনের কারণ বের করতে ব্যর্থ হওয়ায় চালের দাম বাড়ছে। চালকল মালিকরা চালের দাম বৃদ্ধির পেছনে প্রথমত ধানের উৎপাদন কম হওয়া দ্বিতীয়ত ধানের চড়া মূল্য, তৃতীয়ত মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য এবং চতুর্থত চালের ট্রাকে চাঁদাবাজি। মিলাররা বলছেন, এসব সমস্যার সুরাহা হলে চালের দাম কমে আসবে। কুষ্টিয়ার মেসার্স রশিদ এগ্রোফুডের অর্থ ব্যবস্থাপক আবুল খায়ের ভূঁইয়া হারুন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘বর্তমানে ধানের সংকটের কারণে মিলগুলো বন্ধ রয়েছে। সরকার মিলারদের অযথা দায়ী করছে। কিন্তু সমস্যার মূলে তারা যাচ্ছেন না।’ আবুল খায়ের বলেন, ‘এক মণ মিনিকেট ধানের দাম বর্তমানে সাড়ে ১৪শ টাকা, যা ২/৩ দিন আগেও ছিল ১৫০০ টাকা। এক মণ ধানে যাবতীয় খরচ বাদ দিয়ে মাত্র ২২-২৩ কেজি চাল পাওয়া যায়। সে হিসেবে প্রতি কেজি মিনিকেট চালে খরচ পড়ে ৬২-৬৩ টাকা। এ কারণে আমাদের প্রতি বস্তায় ২০০-৩০০ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।’ তিনি চালের দাম বৃদ্ধির জন্য ধান এবং চালের ব্যাপারী তথা মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজিকে দায়ী করেন। ‘ব্যাপারীরা মাঠ থেকে ধান ক্রয় করে কৃষকদের কাছ থেকে। তাদের কাছ থেকে আমরা কিনে নিই। আমাদের কাছ থেকে যে দামে চাল কিনে নেয় খুচরা পর্যায়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে দামের হেরফের হয়ে যায় অনেক। কিন্তু এ জায়গাটাতে সরকার না দেখে মিলারদের শুধু দায়ী করছে,’ বলেন আবুল খায়ের।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads