সামাজিক বনায়ন প্রাকৃতিক ভারসাম্যের প্রতি মানুষের চূড়ান্ত এক অবহেলার রূপ লক্ষ করা যায়। সেজন্যই হয়তো সমগ্র পরিবেশ আজ সংকটের সম্মুখীন। একথা সত্য যে মানবসভ্যতার অগ্রগতি হেতু পরিমিত বৃক্ষছেদনের প্রয়োজন আছে, তবে সেই স্থানে নতুন বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তাও সমস্ত বিতর্কের ঊর্ধ্বে। বিশ্বজুড়ে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের মহামারী চলমান। মানুষ শঙ্কায় রয়েছে জীবন ও জীবিকা নিয়ে। বিশ্বনেতারাও হিমশিম খাচ্ছেন রাষ্ট্রযন্ত্রের অর্থনীতি সামাল দিতে। কেমন হবে ভবিষ্যতের পৃথিবী, তা-ই নিয়ে গবেষক ও বুদ্ধিজীবীরা চিন্তিত। আবার অনেক মানবিক কর্মকাণ্ডেরও প্রকাশ ঘটেছে করোনাকালে। বৃক্ষরোপণ ও সংরক্ষণের এই মহাযজ্ঞে যদি আমরা সফল হই তাহলে হয়তো আবার কোনো দিন জীবাণুমুক্ত স্নিগ্ধ বাতাসে আমাদের কোন এক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শ্বাস নিতে পারবে। হয়তো আমরা সত্যিই এ পৃথিবীর জীবকুলকে এক অমোঘ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারব। আবারো এ পৃথিবীর প্রাণী ও উদ্ভিদকূল প্রকৃতির নিয়মে পারস্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে পরম শান্তিতে নিজেদের জীবন অতিবাহিত করতে পারবে। তাই আজ পরিবেশের এই সংকট কালে দূর ভবিষ্যতের সোনালি স্বপ্নকে চোখে রেখে সমগ্র মানবজাতির অঙ্গীকার হোক পরিবেশ রক্ষা। মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহে প্রকৃতি ও পরিবেশের গুরুত্ব অপরিসীম। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের জন্য প্রকৃতি ও পরিবেশে প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে। বিকৃত হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। গাছ আমাদের একমাত্র অকৃত্রিম বন্ধু। গাছপালা বাদ দিয়ে পৃথিবীতে অন্য কোনো জীবের অস্তিত্ব কল্পনাই করা যায় না। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রত্যেকটি জীব প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। আর বাস্তুতন্ত্রের অমোঘ নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি প্রাণীই উদ্ভিদের সাথে জৈবিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে জীবন নির্বাহ করে থাকে। বৃক্ষ মানুষ তথা প্রাণীমাত্রেরই খাদ্যের একমাত্র উৎস। বৃক্ষ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে। বৃক্ষ পরিবেশ দূষণ প্রক্রিয়াকে প্রতিরোধ করে এবং তার অনিষ্টকর প্রভাব থেকে জীবজগৎকে রক্ষা করে। বৃক্ষের বিভিন্নমুখী অবদানকে বাদ দিয়ে মানবসভ্যতার ক্রমবিবর্তন বা উত্তরণের কথা কল্পনাই করা যায় না। বৃক্ষ খাদ্যের উৎস, শক্তির উৎস। বৃক্ষ মানুষের খাদ্য সরবরাহ করে। বস্ত্রের জন্যে প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরি করে বাসস্থান তৈরির অন্যতম উপকরণ বৃক্ষ। রোগ নিবারণকারী এবং স্বাস্থ্য গঠন ও রক্ষাকারী মূল উপাদান আসে বৃক্ষ থেকে। জীবনের জন্যে অন্যতম উপাদান অক্সিজেন তৈরি এবং সরবরাহ করে বৃক্ষ। কাজেই মানবজীবনে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। দূষণের মারণ রোগে আক্রান্ত আমাদের বিশ্বপ্রকৃতি। এই কঠিন অসুখের এক অন্যতম ঔষধ বৃক্ষরোপণ। মানুষের চাহিদার কারণে দিন দিন ব্যাপক হারে বাড়ছে অরণ্য উচ্ছেদ। যার কারণে প্রকৃতি ভারসাম্য হারাচ্ছে। সুস্থ জীবনযাপনের জন্য দূষণমুক্ত সুস্থ পরিবেশ একান্ত প্রয়োজন। দূষণমুক্ত সুস্থ পরিবেশ গঠনে বৃক্ষরোপণ ও বন সংরক্ষণের ভূমিকা অন্যতম উল্লেখযোগ্য। করোনা কালের কিছুদিন আগেই সুইডিশ কন্যা গোটা থুনবার্গের মাধ্যমে পরিবেশ আন্দোলন বেগ পেয়েছিল অনেকদিন পর। শুরু হয়েছিল শিশুদের নিয়ে ফ্রাইডে ফর ফিউচার নামক পৃথিবীব্যাপী পরিবেশ সচেতনতামূলক কর্মসূচি। এই সচেতনতা প্রোগ্রাম বিশ্বব্যাপী মিডিয়া সংবেদন পেয়েছিল।
জাতিসংঘসহ পরিবেশভিত্তিক সংগঠনসমূহও নড়েচড়ে বসেছিল। করোনার কারণে এখন পৃথিবী নিজেই থেমে গেছে। এর আগেই আমাজন আর অস্ট্রেলিয়ায় দাবানলে পুড়ে ছারখার বৃক্ষ আর প্রাণিকুল। পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত আমাজন যখন জ্বলছিল, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট তখন ‘বাঁশি বাজাচ্ছিলেন’। এই নিয়ে মিডিয়া কম জলঘোলা করলো না। আর এ সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জলবায়ু চুক্তি ত্যাগের ঘোষণা দিলেন। এতো গেল বৈশ্বিক নাটকীয়তা। আমরা সকলেই অবগত যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় এগিয়ে বাংলাদেশ। সমুদ্রপৃষ্ঠ বাড়ছে যার ফলে এদেশের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাবে পঞ্চাশ বছরে। পৃথিবীর অনেক সমুদ্রোপকূলবর্তী দেশই এরকম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর এই বিষয়টিই পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার অন্যতম বিষয়। আরেকটি বিষয়, আমাদের দেশে যখনই সড়ক উন্নয়ন বা বড় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে তখনই কর্মযজ্ঞকে কেন্দ্র করে প্রচুর বৃক্ষনিধন করা হয়েছে। এখনো বিভিন্ন ছোট বড় প্রকল্পের কারণে বন উজারকরণ চলছে যা গণমাধ্যমে এসেছে। যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হল নির্মাণ এবং ঢাবিতে মেট্রো স্টেশনের কারণে প্রচুর শতবর্ষী বৃক্ষনিধন হয়েছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে
সমালোচনা চললেও গঠনমূলকভাবে কিছু হচ্ছে না। এখানে রাজনীতি থাকতে পারে। তবে সাধারণ মানুষ কেউই উন্নয়ন বিরোধী নয়, মূলত সরকারকেই পদক্ষেপ নিতে হবে পরিবেশ রক্ষা করে টেকসই প্রকল্প হাতে নেওয়ার জন্য। প্রকল্প শেষে অথবা মাঝামাঝি সময়ে ব্যাপক বনায়ন প্রকল্পও রাখা উচিত। এতে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার সুযোগ থাকে। সামাজিক বানয়ন হলো স্থানীয় দরিদ্র জনগণকে উপকারভোগী হিসেবে সম্পৃক্ত করে পরিচালিত বনায়ন কার্যক্রম যার প্রত্যক্ষ সুফলভোগীও উপকারভোগী হয়ে থাকেন। বনায়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা, বনজ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা, লভ্যাংশ বণ্টন ও পুনঃবনায়ন সব কাজেই তারা ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে। ভূমিহীন, দরিদ্র, বিধবা ও দুর্দশাগ্রস্ত গ্রামীণ জনগণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করাই সামাজিক বনায়নের প্রধান লক্ষ্য। সামাজিক বনায়নের মূল উদ্দেশ্য হলো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে তাদের স্বনির্ভর হতে সহায়তা করা এবং তাদের খাদ্য, পশুখাদ্য, জ্বালানি, আসবাবপত্র ও মূলধনের চাহিদা পূরণ করা। নার্সারি সৃজন, প্রান্তিক ও পতিত ভূমিতে বৃক্ষরোপণ করে বনজসম্পদ সৃষ্টি, মরুময়তারোধ, ক্ষয়িষ্ণু বনাঞ্চল রক্ষা ও উৎপাদন বৃদ্ধি, পরিবেশ উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ, নারীর ক্ষমতায়ন ও নেতৃত্ব সৃষ্টি এবং সর্বোপরি কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য নিরসনে সামাজিক বনায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
করোনাকালে মানুষের জীবনযাত্রা থমকে গেছে, বহু কলকারখানা বন্ধ ছিল, যানবাহন চলাচল কমে গিয়েছিল। যার ফলে প্রকৃতি আবার প্রাণ ফিরে পেতে শুরু করল। পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকতে ডলফিনের খেলা দৃশ্যমান হলো, স্বচ্ছ আকাশে নক্ষত্রের দেখা মিলল, ঢাকার বায়ুমান একলাফে উন্নতির দিকে গেল। বর্জ্য কমে যাওয়ায় বুড়িগঙ্গার পানির গন্ধ কমে গেল। লাল কাঁকড়া আর প্রবালের ঝাঁকে ভরে গেল সেন্টমার্টিন। সারা পৃথিবীতেই প্রাকৃতি প্রাণ ফিরে পেল। প্রাণীকুল মানুষ আর যান্ত্রিক সভ্যতার ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা পেতে শুরু করল। আধুনিক যন্ত্র পরিচালিত জীবনের কলুষিত পরিবেশ মানুষকে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয় আরণ্যক সভ্যতার উদার প্রশান্ত জীবনের কথা। কিন্তু এই আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক নগরজীবন ত্যাগ করে অরণ্যের যুগে ফিরে যাওয়ার চিন্তা মানুষের পক্ষে নিতান্তই এক আকাশ কুসুম কল্পনা। আর বৃক্ষ রোপণের জন্য দেশীয় প্রজাতি উদ্ভিদ নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। এতে করে প্রকৃতি ফিরে পায় তার সব ধরনের সুস্থতা। তখনই প্রকৃতিতে ফিরে আসে পাখিরা। গাছে গাছে ফিরে আসে পিঁপড়ের দল। কিংবা ফিরে আসে দেশীয় প্রজাতির গাছকে আশ্রয় করে থাকা নানান প্রকারের জীববৈচিত্র্য। এর মাধ্যমে ধরিত্রী হয় সুফলা-শস্যশ্যামলা।
বনায়নের ক্ষেত্রে অবশ্যই দেশীয় প্রজাতি বৃক্ষ নির্বাচন করতে হবে। শুধু বৃক্ষরোপণ করতেই হবে না, রোপিত গাছগুলোকে পরিচর্যাও করতে হবে। তাহলে বৃক্ষরোপণের সফলতা অনেকাংশে চলে আসবে। পাশাপাশি একথাও সত্য যে পরিমিত অরণ্য ব্যতীত প্রাণীকুলের অস্তিত্ব রক্ষাও কোনোভাবে সম্ভব নয়। সভ্যতার অগ্রগতির বীজাণু যখন সেই সভ্যতারই গলা টিপে ধরতে চাইছে, তখন একমাত্র মানুষের অকৃত্রিম বন্ধুই পারে বিশ্ব সংসারকে এই চূড়ান্ত সংকটের হাত থেকে রক্ষা করতে। সেজন্য নিজের স্বার্থেই, মানবকুলকে আজ শামিল হতে হবে পৃথিবীর ফুসফুসকে পুনরায় সুস্থ করে তোলার উদ্যোগে।
লেখক :কামরুজ্জামান তোতা
সাংবাদিক ও কলাম লেখক