প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে হার্ডলাইনে যাচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের অর্ধশত সদস্যকে গ্রেফতার করে তাদের নেটওয়ার্ক গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্রেফতার হওয়া এই চক্রের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে থলের বিড়াল। ভবিষ্যতে এই চক্রের সদস্যরা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জনতা ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান (৩৬)। তিনি এই ব্যাংকসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও পরীক্ষায় জালিয়াতির মাধ্যমে তিন বছরে ১০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। এ হিসাব পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের। সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে দেশের ব্যাংক, বীমা সরকারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি মাদরাসার পরীক্ষাসহ সব পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে সর্বত্র সমালোচনার ঝড় ওঠে। ফলে সরকার রীতিমত বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় প্রশ্নপত্র ফাঁসচক্রের সদস্যদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার জন্য একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা, র্যাব, ঢাকা মহানগর পুলিশ, ডিবি এবং সিআইডি পুলিশকে একযোগে মাঠে নামায়। চলে একের পর এক অভিযান।
সূত্রমতে, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেফতার করে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে চক্রটি ফেসবুক পেজ খুলে ক্লায়েন্ট গ্রুপ তৈরি করে বিভিন্ন অঙ্কের টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন সরবরাহ করার কথা স্বীকার করে।
ওই সময় ডিবি পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার আবদুল বাতেন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তদন্তে আমরা ছয়টি ধাপ অতিক্রম করেছি। আর দুটি ধাপ বাকি রয়েছে। এ দুটি অতিক্রম করলে প্রশ্ন ফাঁসের অন্তরালে কারা তা নিশ্চিত হওয়া যাবে। গ্রেফতারকৃত আসামিদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে ডিবি এদের নেটওয়ার্কে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। এরপর একই বছরের অক্টোবর মাসে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রস্তুতিকালে চার প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের সদস্যকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা হলো আবুল বাশার (২৮), আইনুল ইসলাম (২৬), ইয়াকুব হোসেন তৌফিক (২৩) ও আলমাছ মোহাম্মদ রাইসুল গণি (২৬)। এদের ১০ দিনের পুলিশ রিমান্ডে এনে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য পায় পুলিশ। এরপর ২০১৭ সালের ৮ ডিসেম্বর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের ঘটনায় আরো ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ পরীক্ষাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করার কথা স্বীকার করে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ চক্রের কয়েকজন সদস্য ডিভাইসসহ পরীক্ষার্থী হিসেবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়া মাত্র ইলেকট্রনিকস ডিভাইসের মাধ্যমে প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে তা কেন্দ্রের বাইরে অবস্থানরত ওই চক্রের অন্যান্য সদস্যদের কাছে পাঠায়। বাইরে অবস্থানরত সদস্যরা দ্রুত প্রশ্নপত্র সমাধান করে পুনরায় তা তাদের চুক্তি অনুযায়ী পরীক্ষার্থীদের কাছে সরবরাহ করে।
অন্যদিকে র্যাব ও সিআইডি পুলিশ একের পর প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসচক্রের মূল হোতাসহ অর্ধশত সদস্যকে র্যাব ও সিআইডি গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। সিআইডি তদন্তে জানতে পারে চক্রের মূল হোতা জনতা ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান। অনুসন্ধানে তারা আরো জানতে পারে-হাফিজুরের অধীনে কমপক্ষে ১০টি পৃথকচক্র প্রশ্নপত্র ফাঁসে কাজ করে। গ্রেফতারকৃত প্রশ্নপত্র ফাঁসচক্রের সদস্যদের কাছ থেকে সিআইডি পুলিশ মূলহোতা সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ওই সময় এক সংবাদ সন্মেলনে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেন, হাফিজুরের প্রায় ১০ কোটি টাকার সম্পদ পাওয়া গেছে, যা তিনি প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে অর্জন করেছেন।
এরপর ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হাফিজুর বলেন, বিমানবাহিনীর চাকরি ছেড়ে ২০১৪ সালে তিনি জনতা ব্যাংকে যোগ দেন। ওই বছরের শেষ দিকে মোস্তফা কামাল নামে এক প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ২০১৫ সালে মোস্তফার সঙ্গে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম জালিয়াতি করেন হাফিজুর। ২০১৬ সালে গুদাম রক্ষক পদে চারজনের কাছ থেকে সাড়ে ১৫ লাখ টাকায় নিয়োগ পাইয়ে দেন। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। একের পর বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান তিনি। ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসেও যুক্ত হন তিনি।
হাফিজুরের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে, বাবা স্কুলশিক্ষক। পৈতৃক সম্পত্তি তেমন নেই। তবে গত তিন বছরে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে তার পৌনে সাত কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। জালিয়াতি করে নিজের ছোট ভাই আবদুর রমজানকেও গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছেন। এই চক্রটি বিসিএস পরীক্ষায়ও একই কাজ করেছে বলে গ্রেফতার হওয়া আসামিরা জবানবন্দি দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে সিআইডি পুলিশের জ্যেষ্ঠ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসচক্রের মূলোৎপাটন অনেকটা হয়ে গেছে। মূল হোতাসহ চক্রের প্রায় সব সদস্যকে ইতোমধ্যে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। ভবিষ্যতে ওরা আর সুবিধা করতে পারবে না। সরকারকেও আর এ নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হবে না।