আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের প্রচার শুরু হয়েছে গত সোমবার থেকেই। তাদের গণসংযোগ ইতোমধ্যে উত্তাপও ছড়াতে শুরু করেছে ভোটের মাঠে। তবে গণসংযোগে গিয়ে প্রার্থীরা ভোটারদের প্রতিশ্রুতি যতটুকু দিচ্ছেন তার চেয়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগই করছেন বেশি। ফলে অনেক এলাকায় ঘটছে হামলা-পাল্টাহামলার ঘটনা। ভোটের উৎসব রূপ নিচ্ছে আতঙ্কে। এই অবস্থায় আয়োজক সংস্থা নির্বাচন কমিশন (ইসি) বিব্রত বোধ করছে। আর বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন প্রার্থীদের অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের এই সংস্কৃতি নির্বাচনকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
প্রচারণার তৃতীয় দিনে একদিকে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন ও কবর জিয়ারত করে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচার শুরু করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে দলটিও নেমেছে আনুষ্ঠানিক প্রচারে। অপরদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে সিলেটের হযরত শাহজালাল (রহ.) ও হযরত শাহপরাণের (রহ.) মাজার জিয়ারতের মধ্য দিয়ে ধানের শীষের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হয়েছে। তবে নিজ নিজ এলাকায় থাকা প্রার্থীদের প্রচারণা চলেছে আগের দুই দিনের মতোই। বেশিরভাগ প্রার্থীই করেছেন গণসংযোগ, পথসভা কিংবা কর্মিসভা। সেই সময়েই তারা ভোট চাইতে গিয়ে নিজেদের প্রতিশ্রুতি যেমন দিয়েছেন তার চাইতে বেশি করেছেন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ। অনেক প্রার্থী অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে দিন পার করেছেন ঢাকার দলীয় কার্যালয়ে বসে।
বুধবার নোয়াখালী-৫ আসনের ধানের শীষের প্রার্থী ও বিএনপি নেতা মওদুদ আহমেদ নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নিজের নির্বাচনী এলাকায় প্রচারে বাধা পাওয়ার অভিযোগ তুলে ধরেন। একই সঙ্গে ওই আসনে তার প্রতিদ্বন্দ্ব্বী প্রার্থী ওবায়দুল কাদের মন্ত্রী হিসেবে সরকারি সুবিধা নিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সমস্ত প্রটোকল নিয়ে নির্বাচনী এলাকায় যান প্রচারণা চালানোর জন্য। সরকারি সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে ক্ষমতা এবং প্রভাব দেখিয়ে তিনি সর্বত্র ঘুরে বেড়ান।
এদিকে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মওদুদ আহমদকে নিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, গত পাঁচ বছরে পৌনে চার বছর মওদুদ সাহেব এলাকায় যাননি। উনি কিন্তু জমাতে পারছেন না। কবিরহাটে পথসভা করতে গিয়ে পারেননি। তার এতই জনসমর্থন যে তিনি তার সভাস্থল থেকে তিন কিলোমিটার দূরে গিয়ে বসে থাকলেন। কাদের বলেন, বিএনপির ভাঙ্গা হাট কোথাও জমছে না। অথচ উনারা বলছেন, গণজোয়ার। আমি বলছি গণভাটা। বিএনপির এখন গণভাটা চলছে।
গতকাল দুপুরে রাজশাহী মহানগরীর ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে নৌকার প্রচারে গিয়ে রাজশাহী-২ (সদর) আসনের প্রার্থী ফজলে হোসেন বাদশা বলেছেন, বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশে যত উন্নয়ন হয়েছে তা আর কখনো হয়নি। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় এলে সে উন্নয়ন থমকে যাবে।
ওই আসনে বাদশার প্রতিদ্বন্দ্বী ধানের শীষের প্রার্থী মিজানুর রহমান মিনু অভিযোগ করেছেন, নির্বাচন বানচাল করতে সরকারি দল গভীর ষড়যন্ত্র করছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে দেশব্যাপী বিএনপি, ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা প্রদান করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও নির্বাচনী অফিস ও গাড়ি ভাঙচুর করা হচ্ছে। তবে সরকারি দল যতই অত্যাচার ও নির্যাতন করুক বিএনপি নির্বাচন থেকে সরবে না।
এদিকে চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর) আসনে বিএনপির প্রার্থী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর গণসংযোগে হামলায় এক মহিলাসহ ছয়জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় বিএনপির এক কর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ কারণে বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, ঘটনাস্থলে পুলিশ থাকলেও উল্টো বিএনপির এক কর্মীকে গ্রেফতার করেছে।
এ বিষয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কোনো মন্তব্য না পাওয়া গেলেও পুলিশ সেই অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে, ‘ইস্যু সৃষ্টির’ জন্য এ ধরনের অভিযোগ তোলা হচ্ছে।
পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও উপকূলীয় জেলা ঝালকাঠি-১ (রাজাপুর-কাঁঠালিয়া) আসনের ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী ব্যারিস্টার মুহাম্মদ শাহজাহান ওমর বীর উত্তম। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাপী আমরা নির্বাচন করছি পুলিশের বিরুদ্ধে। মনে হয় পুলিশরা রাজনৈতিক পার্টি, পুলিশ এদেশের প্রধানমন্ত্রী হবে, মন্ত্রী হবে, এমপি হবে। পুলিশের বিরুদ্ধে নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকেই।
উপকূলীয় আরেক জেলা ভোলা-১ (সদর) আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, বিএনপি একটি নিষ্ঠুর দল। ২০০১ সালে বিএনপি সারা দেশে সীমাহীন অত্যাচার করেছে। তারা একবার ক্ষমতায় গেলে এক লাখ মানুষ হত্যা করবে।
এদিকে বুধবার নিজ নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণা চালাতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আওয়ামী লীগকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, এরা ভোট চুরি করার চেষ্টা করবে। তাই কেন্দ্র পাহারা দিয়ে ধানের শীষে ভোট দিয়ে এ সরকারকে বদলাতে হবে। তারা নানা রকম উসকানি দিচ্ছে নির্বাচন একতরফা করতে। তারা নিজেদের অনুগত নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে কাজে লাগাতে তৎপর রয়েছে।
এদিকে সিরাজগঞ্জের তাড়াশে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জনসভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মাদ নাসিম বলেছেন, ১৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিএনপি-জামায়াত জোট দেশে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিল, হরতাল অবরোধের নামে পেট্রোলবোমা মেরে মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছিল, দেশের সাধারণ মানুষ এ কথা আজো ভোলেনি। তাই দেশের জনগণ ৩০ ডিসেম্বর ধান কেটে নৌকায় তুলে দিয়ে সমুচিত জবাব দেবে।
জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু নিজ এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে বলেছেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির নামে কার্যত বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট অপরাধীদের পক্ষে ছাড় চাচ্ছে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও পত্রপত্রিকায় খবর এসেছিল নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য তারেক রহমান লন্ডন থেকে হত্যার নীল নকশা করছে। তারেক রহমান মানুষ হত্যা করে নির্বাচন বানচাল করতে চায়। তারই আলামত হিসেবে গতকাল দেশের দুই জায়গায় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের দুই কর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বিএনপি সন্ত্রাসী ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করতে চায়।
প্রার্থীদের এই অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগের প্রবণতা নির্বাচনের মাঠকে উত্তপ্ত করতে পারে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আবদুর রাজ্জাক খান। তিনি বলেন, নির্বাচনে নিজ দলের পক্ষে ভোট চাওয়ার চাইতে প্রার্থীরা এবার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে ব্যস্ত। এতে ভোটে উৎসবের পরিবেশ সৃষ্টির বদলে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হবে। সাধারণ ভোটাররা ভোট নিয়ে আগ্রহ হারাতে পারে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন এ বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, প্রার্থীর বাড়াবাড়ি ও অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের কারণে ভোট বেচাকেনার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। যা গ্রহণযোগ্য ভোটকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।
তার মতে, এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে ইসিকে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন একটি অ্যাকশন ওরিয়েন্টেড প্রতিষ্ঠান। ইসি হামলা-পাল্টা হামলা বন্ধে যেকোনো সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করতে পারে।
তবে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্যেও কেউ কেউ ভোটারদের দিয়েছেন প্রতিশ্রুতি। গতকাল নিজ নির্বাচনী এলাকায় গ্যাসের সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট চেয়েছেন ঢাকা-১০ আসনে মহাজোটের প্রার্থী ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।
খুলনা-২ আসনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সমর্থিত বিএনপি মনোনীত প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেছেন, দুই কোটি তরুণ ভোটার আগামী নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর জয় পরাজয় নির্ধারণ করবে। তরুণ ভোটারদের কথা মাথায় রেখে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তাদের কর্মসংস্থান এবং কাজের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত বেকার ভাতা প্রদানের অঙ্গীকার করেছে। তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।