লাল মাটির বুকে সারি সারি শাল-গজারি বৃক্ষ। বনের বাঁকে বাঁকে মেঠোপথ। ফাঁকে ফাঁকে গ্রাম আর গ্রাম। নিচু উঁচু চালা আর বাইদ বেষ্টিত বেশিরভাগ গ্রাম। এমনই একটি গ্রাম বেরিবাইদ। বেরিবাইদ গ্রামে বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের জন্য রয়েছে একটি বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের নাম পরেশ হাগিদক অটিস্টিক প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়ের একদিকে শালবন আর দু’দিকে রাবার বাগান। ফাঁকে ফাঁকে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী গারোদের বসবাস। মুসলিম, বর্মণদের পাশাপাশি গারো সম্প্রদায়ের লোকদের বসবাস বেশি। এসব জাতি গোষ্ঠীর শিশুদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও ছিল না অটিস্টিক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য কোনো শিক্ষালয়। প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় না থাকায় এ লালমাটির প্রতিবন্ধী শিশুরা পায়নি কোনো শিক্ষার আলো। প্রতিবন্ধী শিশুদের কথা চিন্তা করে গেৎচুয়া গ্রামের অধিবাসী মধুপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মিসেস জস্টিনা নকরেক চিন্তা করলেন তাদের জন্য কিছু করতে হবে। এ কথা ভেবে এক দশক আগে তার বাবার নামে নিজের জমির ওপর প্রতিষ্ঠা করলেন পরেশ হাগিদক অটিস্টিক প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টি এখন টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ জেলার সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে।
সরেজমিনে মধুপুর উপজেলা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে বেরিবাইদ ইউনিয়নে গিয়ে জানা যায়, বিদ্যালয়টির শিক্ষার আলো ছড়ানো ও প্রতিষ্ঠার কথা। স্থানীয় এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ গ্রামে রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়। নবগঠিত এ ইউনিয়নে নেই কোনো প্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষালয়। এই গ্রামের আদিবাসী উপজেলা আওয়ামী লীগের নেত্রী ও মধুপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান জস্টিনা নকরেক পিছিয়ে পড়া প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার জন্য একটি বিদ্যালয় স্থাপনের চিন্তা করেন। পরে সবার সঙ্গে পরামর্শ করে নিজেদের জমিতে তার বাবার নামে পরেশ হাগিদক অটিস্টিক প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বিদ্যালয়ের নামে বেরিবাইদ গ্রামে পাকা সড়কের পাশ থেকে সাব কবলা করে ২৫ শতাংশ জমি রেজিস্ট্রি করে দেন। বিদ্যালয়ের ঘর ও আসবাবপত্র চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চ তৈরি করেন। আর চলছে পাঠদান।
উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের উৎসাহী শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা নিয়োগ নিয়ে দীর্ঘদিন বিনাবেতনে পাঠদান করে যাচ্ছেন। প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের নিয়ে সমাবেশ করেন। গান-বাজনা, সাংস্কৃতিক পর্বের মধ্যে দিয়ে শিক্ষার্থীদের আনন্দের সঙ্গে পাঠদান করে যাচ্ছেন। বিরামহীন পাঠদানের ফলে আশপাশের কয়েক গ্রামের প্রায় ১৬০ শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে ভর্তি হয়ে পাঠগ্রহণ করছে। বিদ্যালয়ের নিজস্ব অর্থায়নে দুটি ভ্যানগাড়ি রাখা হয়েছে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে আনা-নেওয়া করার জন্য। ফলে দূরের যারা শিক্ষার্থী তাদের অভিভাবকের দুশ্চিন্তা লাঘব হয়েছে অনেকাংশেই। দূরের শিক্ষার্থীদের হেঁটে যেতে হয় না। ভ্যানচালকরা নিজ দায়িত্বে প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের আনা-নেওয়া করে থাকেন। শিক্ষকরা এই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের মা-বাবার মমতা দিয়ে পাঠদান করিয়ে থাকে। শিক্ষকদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর আন্তরিক ব্যবহারের কারণে এবং প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য একমাত্র স্কুল হওয়ায় আশপাশের গ্রামগুলো থেকে শিক্ষার্থীরা আসছে এই স্কুলে। ফলে দিন দিন বাড়ছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। শিক্ষার্থীদের যথাযথ পরিচর্যা এবং বিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিদ্যালয়ের প্রয়োজনমাফিক জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে স্কুলের সব কার্যক্রম চলছে নির্বিঘ্নে। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জস্টিনা নকরেক নিয়মিত বিদ্যালয়ের সব কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষভাবে দেখাশোনা করে থাকেন।
বিদ্যালয়ের একপাশে পাকা সড়ক, সামনে বাইদ তিন দিকে সবুজ আর সবুজ। মনোরম পরিবেশে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বিদ্যালয়।
এলাকাবাসী জানান, এ ইউনিয়নে কোনো প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় নেই। আদিবাসী নেত্রী ও শিক্ষানুরাগী জস্টিনা নকরেক সবাইকে নিয়ে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য এ বিদ্যালয় স্থাপন করায় এলাকায় প্রতিবন্ধী শিশুরা শিক্ষার আলো পাচ্ছে। মনের তৃপ্তি পাচ্ছে অভিভাবকরা। বেরিবাইদ গ্রামটিও আলোকিত হচ্ছে।
অভিভাবক আনোয়ারা বেগম জানান, এলাকায় কোনো প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় ছিল না। এ বিদ্যালয় হওয়ায় আমাদের প্রতিবন্ধী শিশুরা শিক্ষা পাচ্ছে। শিশুদের আনা-নেওয়ার জন্য ভ্যান থাকায় আমাদের তেমন কষ্ট করতে হয় না।
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা মুক্তা ইয়াসমিন জানান, আমরা শিক্ষকরা মায়ের মমতা দিয়ে শিশুদের মধ্যে পাঠদান করে থাকি। অন্যান্য বিদ্যালয়ের চেয়ে আমাদের প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের পাঠদানে কষ্ট হলেও স্বাদ ভিন্ন, তৃপ্তি বেশি। তিনি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের মধ্যে পাঠদান করতে পেরে খুশি।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আ. জলিল জানান, ২০১০ সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমি আছি। বর্তমানে স্কুলটিতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১৬০ জন। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত পাঠদান করা হয়। শিশুদের শিক্ষাকে আনন্দময় করে তোলার জন্য নানা ধরনের খেলাধুলা, গান-বাজনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে আনন্দের সঙ্গে পাঠদান করেন বলে জানান। তিনি জানান, ২৫ স্টাফ বিনাবেতনে দীর্ঘদিন যাবৎ পাঠদান করতে হিমশিম খাচ্ছেন। বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত করণের দাবি তার।
বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালনা কমিটির সভাপতি জস্টিনা নকরেক জানান, সমাজের পিছিয়ে পড়া বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করার জন্য নিজেদের ২৫ শতাংশ জমি লিখে দিয়ে বাবার নামে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। ভবিষ্যতে যাতে বাবার স্মৃতি থাকে এবং এলাকার প্রতিবন্ধী শিশুরা শিক্ষার আলো পায়, সেজন্য অনেক কষ্টে অবকাঠামো করে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য কন্যা সায়মা ওয়াজেদ যেহেতু অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে কাজ করেন সেজন্য আমি উৎসাহিত হয়ে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছি। তিনি বিদ্যালয়টি জাতীয়করণের দাবি জানান।
বেরিবাইদ ইউপি চেয়ারম্যান জুলহাস উদ্দিন জানান, আমার ইউনিয়নে একটি মাত্র অটিস্টিক প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়। ভালোভাবে পাঠদান চলছে। বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ হলে এলাকার শিশুরা পাবে শিক্ষার আলো। দূর হবে অন্ধকার। কর্মসংস্থান হবে প্রায় ২৫ জন স্টাফের।