মাত্র কয়েক বছর আগেও দেশের সর্বস্তরের মানুষ পরিচিত ছিল না এই শব্দের বাস্তবতার সাথে। শুধু বইয়ের পাতায় কিংবা প্রকাশিত বহু পুরনো রুপালি পর্দার ছায়াছবিতেই দেখা মেলে এই কল্পকাহিনীর। মহামারী অর্থাৎ বইয়ের ভাষায় ওলাবিবি বা কালাজ্বর পুরো গ্রামে তাণ্ডব চালিয়ে ক্ষান্ত না হয়ে চলে গ্রামের পর গ্রাম ত্রাসে, সেই পরিস্থিতি দেখেও মানতে নারাজ আমাদের মন। কিন্তু আজ এত শত বছর পর স্বপ্নের সেই আধুনিক যুগ, যেখানে আর স্বপ্ন দেখতে হয় না পাখির পাখায় চেপে উড়ে যাবে অবুঝ মন। যে যুগে দাঁড়িয়ে নিমেষে উড়োজাহাজে চেপে উড়াল দেয় মানুষ এক দেশ থেকে আরেক স্বপ্নের দেশে। যেখানে রূপকথার দৈত্য-দানবেরা হয়েছে অ্যানিমেশনের মজাদার গেমস, যা কি-না গল্পের পাতায় পড়ার জন্য আর অপেক্ষা করতে হয় না। সেই ম্যাজিক্যাল মুহূর্তে দাঁড়িয়ে অদৃশ্য এক দানব বা এক ক্ষুদ্র অশুভ শক্তি নিমেষে স্তব্ধ করেছে পুরো পৃথিবীকে। এমন অবস্থায় আমরা গৃহবন্দি। বন্ধ রয়েছে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয় গত বছর থেকে আজ অব্দি। চলছে না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পাঠদান। প্রায় অচল শিক্ষাব্যবস্থার একটি বড় অংশ। মূলত মানসিক বিপর্যয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। যারা কিনা করোনার ঠিক পূর্বমুহূর্তে স্বপ্ন দেখেছিলেন উচ্চশিক্ষার পাঠ চুকিয়ে অতিশীঘ্রই হাল ধরতে যাচ্ছেন পরিবার তথা দেশের। আজ করোনাকালীন সময়ে সে আশা গুড়ে বালি।
দুর্ভোগ ও দুর্ভাবনার কোনো শেষ নেই। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, খুলবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর সম্পন্ন হবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ বর্ষের পরীক্ষা। এদিকে তো চাকরির বয়স যায় যায়। তাকে তো আর ধরে রাখার সাধ্য কারো নেই। ঠিক এমন মুহূর্তে ঘরে বসেও করা সম্ভব নিজেকে পরিপূর্ণ জীবিকার জন্য লড়াইয়ের কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ। খুঁজে বের করা সম্ভব নিজের মাঝের দুর্বলতা বা অপারগতাকে। এই যেমন আমাদের দেশের সদ্য পাস করা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জীবনের প্রথম প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সফল হতে ব্যর্থ হোন, ফলে বসতে হয় পরপর কয়েক বছর একই পরীক্ষায়। ব্যয় করতে হয় আবেদনের জন্য টাকা যা কি-না হিমশিম খাইয়ে দেয়। সঙ্গে দিনের পর দিন বাড়ছে তাদের মানসিক যন্ত্রণা, হতাশা, বাড়ছে দেশের বেকারত্বের হারও।
এর কারণ কী, কে দায়ী এবং কেন, কোথায় এর প্রতিকার? এর প্রথম ও অদ্বিতীয় কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বেশিরভাগই সময় ও মানসিকতা তৈরি করে উঠতে পারেন না প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার বাইরে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার। জীবনের কমপক্ষে ৪ থেকে ৫টি বছর একইভাবে কেটে যায়। এরপর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর শুরু হয়, এসব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ। ফল প্রকাশের মাঝের ৬-৭ মাস যে সময় পাওয়া যায় তাতে নিজেকে তৈরি করা খুব কঠিন অগ্নিপরীক্ষা। বেশিরভাগই জ্বলে যায় এই অগ্নি দহনে। সত্যিকার অর্থে সময়ের সঠিক ব্যবহার করলে করোনাকালীন সময়ও হয়ে উঠতে পারে আমাদের সবার জীবনের স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো সময়, যা পরিবর্তন করে দিতে পারে আমাদের মাঝের দুর্বলতাকে। সব শিক্ষার্থীর মাঝে কোনো না কোনো বিষয়ে দুর্বলতা থাকেই, যেমন— ইংরেজি, গণিত, সাহিত্য, ভাষা ও ব্যাকরণ, আর সাধারণ জ্ঞানের ক্ষেত্রে তো নেই কোনো নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম। এই করোনাকালীন সব প্রতিকূলতার মাঝেও নিজেকে প্রস্তুত করা সম্ভব সব কঠিনতর বিষয়ে। গণিতের সূত্র মাথায় ঘষে নেওয়া কিংবা ইংরেজি ঠোঁটের ডগায় আয়ত্ত করে নেওয়া, সঙ্গে পরখ করা বাংলা ব্যাকরণ আর নিজের মতো করে সাধারণ জ্ঞান অন্বেষণ।
এই যে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পরীক্ষা শেষ করে ব্যর্থতার বোঝা মাথায় নিয়েই যখন শুরু করা হয় সফলতার পথ খোঁজা, সে তো সময়কে প্রতিনিয়ত একই পরিমাণে কাজে লাগিয়ে আগেই সম্ভব সফলতার দোরগোড়ায় পৌঁছানো। করোনা পরবর্তীতে শেষ বর্ষের পরীক্ষার পালা চুকিয়ে জীবনের প্রথম অংশগ্রহণ করা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাই হতে পারে জীবনের সেরা পরীক্ষা। চোখের পলকেই পাওয়া সম্ভব আলাদীনের চেরাগ। এভাবেই ঘুচিয়ে নেওয়া সম্ভব বেকারত্বের অভিশাপ। ঝড় আসার আগেই প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়, নিশ্চয়ই ঝড়ের পরে নয়। ঠিক তেমনি সবাই পারে সময়ের চাকায় ভাগ্য ফেরাতে সঠিক দিকনির্দেশনায়। এ দেশের গ্রাম ও শহরের অধিকাংশ মানুষই এখন ইন্টারনেট সেবার আওতাভুক্ত। সোশ্যাল মিডিয়ায় কম বেশি সবাই আসক্ত। এই আসক্ততাই হয়ে উঠতে পারে বন্দিদশার প্রস্তুতি শুরুর মাধ্যম। এছাড়া বইপত্র তো আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী আছেই, যার মাধ্যমে সহজে শিখে নেওয়া যায় সব বিষয়ের ট্রিকস। এবং সবচেয়ে আশীর্বাদের বিষয় হলো, ঢাকার বাইরে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে সেসবের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ প্রতিবছর হয় ঢাকামুখী বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে সুপরিকল্পিত পড়াশোনা এবং দেশের স্বনামধন্য কোচিং সেন্টারের স্বনামধন্য শিক্ষকের সান্নিধ্য পেতে। কিন্তু ২০২০-২১ সালে এই দুঃসময়ে এসব শিক্ষকেরাই প্রতিনিয়ত অনলাইনভিত্তিক পাঠদান করছেন যা কিনা সব শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ স্থান থেকে সুযোগ করে দিচ্ছে শিক্ষকদের কাছে শেখার। ফলে তা সময়, পরিশ্রম এবং অর্থের ব্যয় থেকে রক্ষা করছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের। হ্যাঁ, করোনাকালীন সময়ের রয়েছে খারাপ দিক যা অনস্বীকার্য। তবে খারাপ দিক পরিহার করে ভালো দিক অন্বেষণে ব্রতী হলে যেকোনো পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা এগিয়ে যাওয়ার পাঠটা সম্পন্ন করতে পারবে- এই বিশ্বাস রাখি।
মুসফিদা রাহমান ফিদা
লেখক : শিক্ষার্থী, কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, আসানশোল