পড়াশোনা করেছেন ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে, কিন্তু পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন ফটোগ্রাফি। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন স্বনামধন্য ফটোগ্রাফার হিসেবে। নিজের কাজের জন্য সুনাম কুড়িয়েছেন দেশে ও বিদেশে। ফটোগ্রাফির প্রতি ভালোবাসা তাকে পৌঁছে দিয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থেকে অর্জন করেছেন ৬০টি পুরস্কার। প্রতিষ্ঠা করেছেন দেশের নামকরা ওয়েডিং ফটোগ্রাফি প্রতিষ্ঠান ড্রিম ওয়েভার। ক্যামেরার পেছনের এই মানুষটির নাম যোবায়ের হোসেন শুভ। তাকে নিয়ে লিখেছেন নাদিম মজিদ
যোবায়ের হোসেন শুভ ফটোগ্রাফি শুরু করেছিলেন ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে (আইআইটি) ভর্তি হওয়ার পর। ভর্তি হয়ে দেখেন ক্যাম্পাসের অনেকে ক্যামেরা ব্যবহার করছেন। দারুণ দারুণ ছবি তুলে ফেসবুকে শেয়ার দিচ্ছেন। মনে মনে ভাবলেন তার নিজেরও একটি ক্যামেরা থাকলে ভালো হতো। কিন্তু ভালো ক্যামেরা কিনতে হলে বেশ টাকার প্রয়োজন। তাই গাজীপুর থেকে উত্তরায় এসে তিনটি করে টিউশনি করেন। আসা-যাওয়া, পড়ানো, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পড়াশোনা, সবমিলিয়ে বেশ পরিশ্রমের কাজ। তবুও বছরখানেক পরিশ্রমের মাধ্যমে ২০১১ সালের মাঝামাঝি কিনে ফেলেন ক্যামেরা। এরপর ফটোগ্রাফির খুঁটিনাটি বোঝার সুবিধার্থে ভর্তি হন আইইউটি ফটোগ্রাফিক সোসাইটিতে। তাদের সঙ্গে ফটোওয়াকে গিয়ে ছবি তুলে রপ্ত করেন ফটোগ্রাফির প্রাথমিক পাঠ। কিছুদিন ছবি তুলেই বুঝতে পারেন এখনো ক্যামেরার অনেক কাজ শেখা বাকি। সেই সঙ্গে ভালো ছবির জন্য দরকার প্রাইম লেন্স ও ফ্ল্যাশ। এক বন্ধু পরামর্শ দিলেন, ‘তোর তো দামি ক্যামেরা। বিভিন্ন বিয়েতে ছবি তুললে বেশ কিছু টাকা পাবি। একদিন কষ্ট করলে এক-দুই হাজার টাকা বাঁচাতে পারবি। সে টাকায় ক্যামেরার আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কিনতে পারবি।’ বন্ধুর পরামর্শ মনে ধরল। কয়েকটি ইভেন্টে ছবি তোলেন। কিছু টাকাও পান। কয়েকটি ইভেন্টের পর মনে হলো ফ্রিল্যান্স কাজ করার চেয়ে নিজেদের একটি প্রতিষ্ঠানের নামে কাজ করা ভালো।
২০১২ সালে আইইউটি ফটোগ্রাফিক সোসাইটির তিন জুনিয়র সদস্য নাফিস ফুয়াদ, মো. ইমরান শাহেদ এবং মাজহারুল ইসলাম রাফিকে নিয়ে শুরু করেন ড্রিম উইভারের কাজ। আগে শখের বসে ছবি তুললেও এখন তাদের বেশ প্রফেশনাল কাজ করতে হচ্ছে। এতে পরিশ্রম করতে হচ্ছে প্রচুর। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কঠিন পড়াশোনা এবং ফটোগ্রাফি- দুটো একসঙ্গে পরিচালনা করাও রীতিমতো চ্যালেঞ্জিং ছিল। তারপরও পড়াশোনা ও ছবি তোলা একসঙ্গেই চালিয়ে গেছেন। ছবি তোলায় বৈচিত্র্য এবং গল্প আনার জন্য পরিশ্রম করতে থাকেন। ছবি ভালো তোলায় সুনাম বাড়তে থাকে। এভাবে তিন বছর চলার পর যোবায়েরের মনে হয় তাদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করা উচিত।
২০১৫ সাল। বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের ওয়েডিং ফটোগ্রাফি নতুন। ওয়েডিং ফটোগ্রাফি নিয়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশিদের পুরস্কার জেতা দূরের কথা, অংশ নিতেও দেখা যায় না। সে সময় সাহস করে ওয়েডিং অ্যান্ড পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফারস এশিয়ার (ডব্লিউপিপিএ) প্রতিযোগিতায় ছবি পাঠিয়েছিলেন যোবায়ের হোসেন শুভ। চূড়ান্ত পর্বের জন্য ছবি মনোনীত হওয়ায় প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য মালয়েশিয়া যান। বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক প্রতিযোগী উপস্থিত হয়েছিলেন সেখানে। তাদের সঙ্গে কথা বলে তিনি বুঝতে পারেন, বাংলাদেশের প্রতিযোগী যোবায়ের হোসেন শুভর প্রতি তাদের আগ্রহ নেই। কারণ বাংলাদেশি ওয়েডিং ফটোগ্রাফারদের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পাওয়ার রেকর্ড পাওয়া যায় না। তবে বিকালে পুরস্কার বিতরণীর সময় অবস্থা কিছুটা পাল্টাল। দুটি ক্যাটাগরিতে দ্বিতীয় স্থান এবং একটিতে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন ড্রিম ওয়েভারের প্রতিষ্ঠাতা যোবায়ের হোসেন শুভ।
পুরস্কার নিয়ে ফুরফুরে মেজাজে দেশে ফিরলেও সে অভিজ্ঞতার কথা ভুলে যাননি যোবায়ের। সে সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে যোবায়ের হোসেন শুভ বলেন, ‘সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম, ওয়েডিং ফটোগ্রাফির আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাগুলোতে বাংলাদেশিরা অংশ নেয় না বলেই প্রথমে বিদেশিরা আমাকে গুরুত্ব দিতে চায়নি। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, নিজের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কাজ করব এবং বেশি বেশি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেব।’
নিজের ফটোগ্রাফির দক্ষতা বাড়ানোর জন্য ভর্তি হন ওপেন ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ায় এক বছর মেয়াদি প্রফেশনাল ফটোগ্রাফি কোর্সে। এরপরও সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত আলোকচিত্রী ম্যাথিউ ট্যানকের কাছ থেকে লাইটিং এবং গ্রিসের আলোকচিত্রী নিক পেকরিডিস থেকে এডিটিং শেখেন।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতা থেকে তার ঝুলিতে জমা হতে লাগল নানা পুরস্কার। সবচেয়ে বড় অর্জন হলো এক বছর পরে মালয়েশিয়ায়। প্রতিযোগিতার আয়োজক ওয়েডিং অ্যান্ড পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফারস এশিয়া (ডব্লিউপিপিএ)। এক প্রতিযোগিতাতেই জেতেন সাতটি পুরস্কার। তিন ক্যাটাগরিতে প্রথম, দুই ক্যাটাগরিতে দ্বিতীয়, এক ক্যাটাগরিতে তৃতীয় এবং টপ থ্রি ফটোগ্রাফারস, এশিয়ার পুরস্কার। এ পর্যন্ত যোবায়ের নিজের ঝুলিতে পুরেছেন ৬০টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার। পুরস্কার পাওয়া প্রতিযোগিতাগুলোর আয়োজক হিসেবে আছে মাস্টার ফটোগ্রাফার অ্যাসোসিয়েশন (এমপিএ), ওয়েডিং অ্যান্ড পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফারস এশিয়া (ডব্লিউপিপিএ), এশিয়া ওয়েডিং ফটোগ্রাফারস অ্যাসোসিয়েশন (এশিয়া ডব্লিউপিএ), প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারস এশিয়া কমিউনিটি (পিপিএসি)। প্রকৌশলে পড়া ছাত্রদের ড্রিম উইভার এখন বাংলাদেশের ওয়েডিং ফটোগ্রাফিতে উদাহরণ। পড়াশোনা শেষ করে প্রকৌশলী হলেও তারা ফটোগ্রাফিকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পুরস্কার নিয়ে আসছেন। বিশ্বকে দেখিয়ে দিচ্ছেন, ওয়েডিং ফটোগ্রাফিতে বাংলাদেশের জয়যাত্রা।

প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ লক্ষ্য সম্পর্কে এর চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার, প্রধান ফটোগ্রাফার যোবায়ের হোসেন জানান, ‘বাংলাদেশের ওয়েডিং ফটোগ্রাফিকে আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিতে কাজ করছি। সিঙ্গাপুরে আমাদের শাখা চালু হয়েছে। আরো কয়েকটি দেশে শাখা প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে।’