জাতীয়

পোশাকশিল্প অস্থিরতায় দায়ী তিন কারণ

  • ''
  • প্রকাশিত ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক:

গত কয়েক দিন ধরে শ্রমিক অসন্তোষ ঘিরে পোশাকশিল্পে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ নিয়ে সরকার, মালিক ও শ্রমিকপক্ষ দফায় দফায় বৈঠক হলেও স্বস্তি ফিরছে না শিল্পাঞ্চলে। চলমান অস্থিরতায় এই খাতে দিনে ক্ষতি ৪০০ কোটি টাকা। দিন যত গড়াচ্ছে, ক্ষতির পরিমাণ তত বেড়েই চলছে। আছে নতুন ক্রয়াদেশ ও নির্ধারিত সময়ে পণ্য রপ্তানি নিয়েও শঙ্কা।
এ অবস্থায় চলমান অস্থিরতা না কাটলে আজ থেকে পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধের হুমকি দিয়েছেন রপ্তানিমুখী এই শিল্পের মালিকরা।

চলমান শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে গতকাল রাজধানীতে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) কার্যালয়ে মতবিনিময় সভা হয়। কারখানা মালিক ও সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন অন্তর্বর্তী সরকারের তিন উপদেষ্টা।

তারা হলেন-শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম।

মতবিনিময় সভায় অন্তর্বর্তী সরকারের শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, আগামীকাল (আজ) রোববার দেশের সব তৈরি পোশাকশিল্প কারখানা খোলা থাকবে। কোনো কারখানায় অস্থিরতা তৈরি হলে বিশেষ ব্যবস্থা নেবে সরকার। দেশের অর্থনীতিকে বিপদে ফেলতে কেউ যদি কারখানা বন্ধ রাখার অপচেষ্টা করেন, সেটাও মনে রাখা হবে।

এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, সরকার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়ায় আগামীকাল (আজ) সব পোশাক কারখানা খোলা থাকবে। তবে কোনো কারখানায় অস্থিরতা তৈরি হলে পরশু (সোমবার) থেকে সেই কারখানা শ্রম আইনের ১৩/১ ধারা (কাজ নেই, বেতন নেই) অনুযায়ী অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।

তৈরি পোশাক খাতে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে সরকার কমিটি করেছে জানিয়ে উপদেষ্টা আদিলুর রহমান বলেন, এই কমিটির মাধ্যমে সবার সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সমস্যার সমাধান করা হবে। সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করার যে সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তা ফিরিয়ে আনতে হবে।

সভায় শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হওয়ায় অনেকের মতো শ্রমিকরাও নিজেদের কথা বলছেন। শ্রমিকদের অভিযোগ সমাধানে শ্রমসংক্রান্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা সব অভিযোগ ও দাবি নিয়ে কাজ শুরু করেছে। তবে শ্রমিকের আন্দোলনে একদমই যে ষড়যন্ত্র নেই, এমনও নয়।

তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে শ্রমিকদের জন্য কোনো প্রক্রিয়ায় রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা যায়, সে বিষয়ে কাজ শুরু করেছে সরকার। এ ছাড়া গত বছরের শেষ দিকে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনের সময় যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শ্রম আইনের মধ্য থেকে ট্রেড ইউনিয়ন করার যতটা সুযোগ আছে, তা নিশ্চিত করবে সরকার। তবে এসব প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে যারা অস্থিরতা করবে, তাদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হবে না।

বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘ব্যাংক থেকে অর্থছাড়ের জটিলতার কারণে কিছু কারখানা সঠিক সময়ে বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে পারেনি। কাল ও পরশুর মধ্যে সব বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হবে।’

গেল পাঁচ বছরে উৎপাদন খরচ বাড়লেও চলতি বছর তৈরি পোশাকের দাম কমেছে বলেও জানান তিনি। বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘চলতি বছর তৈরি পোশাকের দাম ৫ থেকে ৭ শতাংশ কমেছে। গেল ৫ বছরে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৫০ শতাংশ।’

বাংলাদেশ ব্যাংক সহায়তা না করলে আগামী মাসে ৭৫ হাজার শ্রমিকের বেতন দেওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা জানিয়েছেন হামিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে ক্রয়াদেশ সরে যাচ্ছে। অনেক কারখানা বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন মালিকরা। এই মাসে কোনোভাবে বেতন দিতে পেরেছি। কিন্তু সামনের মাসে ৭৫ হাজার শ্রমিকের বেতন দিতে পারব কি না, তা জানি না।’

সেনাবাহিনী পাশে না থাকলে সব পোশাক কারখানায় লুট হতো উল্লেখ করে হামিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে কারখানায় ভাঙচুর না হলে, অগ্নিসংযোগ হবে নাÑ এমন নিশ্চয়তা পেলে কারখানা চালাব, না হলে আর চালাব না।’

এ কে আজাদ বলেন, ‘বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী ২৭০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এভাবে চললে ডিসেম্বর পর্যন্ত আরও অনেক কারখানা বন্ধ হবে।’

পোশাক শিল্পের চলমান এই অস্থিরতার জন্য তিনটি কারণ দায়ী বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। গতকাল বিজিএমইএর মতবিনিময় সভায় এ কথা বলেন সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মো. মঈন খান।

তিনি বলেন, শ্রমিকদের দাবিগুলো যৌক্তিক, তবে সমাধান না হলে শিল্পের অস্থিরতা নিরসন সম্ভব নয়। পোশাক শিল্পকে রক্ষায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করবে সেনাবাহিনী।

সেনাবাহিনীর মতে, পোশাক শিল্পে চলমান এ অস্থিরতার জন্য মূলত তিনটি কারণ দায়ী। এগুলো হলো- ১. বহিরাগতদের আক্রমণ। তবে এখন আর এটা হচ্ছে না। ২. শ্রমিকদের যৌক্তিক ও অযৌক্তিক দাবির সমন্বয়ে অস্থিরতা ধরে রাখা হচ্ছে। ৩. ঝুট ব্যবসার আধিপত্য।
শিল্প পুলিশ জানিয়েছে, বর্তমান সরকারকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ঠেলে দিতেই একটি চক্র শিল্প কারখানায় অস্থিরতা তৈরি করছে। এখন বেক্সিমকো গ্রুপের শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে উপদেষ্টাদের বিশেষভাবে নজর দেওয়া জরুরি।

এদিকে গেল কয়েক দিনের অচলাবস্থা কাটিয়ে খুলতে শুরু করেছে সাভার-আশুলিয়া ও গাজীপুর শিল্পাঞ্চলের পোশাক কারখানাগুলো। শ্রমিকরা কাজে যোগ দেওয়ায় ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে উৎপাদন কার্যক্রম।

গতকাল ঢাকার সাভার ও আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে অধিকাংশ কারখানা খুলেছে। তবে শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে কয়েক দিন ধরে বন্ধ থাকা কারখানাগুলোর মধ্যে ৪৯টি কারখানা বন্ধ রেখেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে শ্রম আইনে বন্ধ কারখানার সংখ্যা ৩৬টি। বাকিগুলো উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় বন্ধ রেখেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এদিন সকাল থেকেই সড়কে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশের সদস্যরা টহল দিচ্ছেন। বিভিন্ন কারখানার সামনে দায়িত্বপালন করছেন সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা।

তবে, বেশির ভাগ কারখানা খুললেও নতুন ক্রয়াদেশ ও নির্ধারিত সময়ে পণ্য রপ্তানি নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। এমন অবস্থায় শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধে বেগ পেতে হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি অনেক কারখানায় কমেছে স্বাভাবিক কাজের চাপও।

সকালে বৃষ্টি উপেক্ষা করে গাজীপুরে নিরাপত্তা শঙ্কায় বন্ধ থাকা ৩৮টিসহ সব পোশাক কারখানায় কাজে যোগ দেন শ্রমিকরা। শিল্প এলাকার কোথাও শ্রমিক অসন্তোষের খবর না থাকলেও নিরাপত্তা নিশ্চিতে টহল দিচ্ছে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও শিল্প পুলিশের একাধিক টিম।

সাভার-আশুলিয়ার বন্ধ থাকা ২১৯টি কারখানার মধ্যে ১৭০টি পোশাক কারখানা উৎপাদনে ফিরেছে। তবে, এখনো বন্ধ রয়েছে ৪৯টি কারখানা। পরিস্থিতি বিবেচনায় শিগগিরই সব কারখানা উৎপাদনে ফিরবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

শ্রমিকরা বলেন, বিভিন্ন দাবিতে টানা কয়েক দিন শ্রমিকরা আন্দোলন করছে। কিন্তু মালিকপক্ষ শ্রমিকদের সঙ্গেও কোনো আলোচনা বা সিদ্ধান্তে বসেনি। যেসব কারখানায় শ্রমিক এবং মালিকপক্ষ বসে আলোচনা হয়েছে, সেই কারখানাগুলোতে কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু শনিবারও কিছু কারখানায় শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে এসে বন্ধ পাচ্ছেন। এছাড়াও সকালে শ্রমিকরা কাজে যোগ দিলেও পরে কারখানায় ছুটি ঘোষণা করে কারখানা কর্তৃপক্ষ।

শ্রমিক নেতারা বলছেন, কিছু কারখানায় শ্রমিকদের সঙ্গে দাবি নিয়ে আলোচনা করছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া বিভিন্ন কারখানার মূল ফটকে শ্রমিকদের দাবি মেনে নেওয়া সংক্রান্ত নোটিশ টাঙিয়ে দেওয়ায় কাজে ফিরেছেন শ্রমিকরা।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন বলেন, শনিবার সকালে বন্ধ থাকা অধিকাংশ পোশাক কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। অনেক কারখানার সামনে শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি মেনে নিয়ে সে অনুযায়ী মালিকপক্ষ নোটিশ টাঙিয়ে দিয়েছে। দুই-একটি কারখানার শ্রমিকরা তাদের দাবি নিয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করছেন। যেসব কারখানা বন্ধ আছে, সেগুলোর মালিকপক্ষ আন্তরিক হলেই সমস্যার সমাধান সম্ভব।

আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, শনিবার শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ার কোথাও কোনো কারখানায় অস্থিরতা দেখা যায়নি। এমনকি সড়ক অবরোধসহ কারখানায় হামলা বা ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেনি। পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক রয়েছে। কারখানাগুলোর নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব ও শিল্প পুলিশ সদস্য মোতায়েন রয়েছে।

তিনি বলেন, শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় মোট কারখানা রয়েছে ১ হাজার ৮৬৩টি। এর মধ্যে অধিকাংশই পোশাক কারখানা। গত কয়েক দিনের চেয়ে আজ (শনিবার) শিল্পাঞ্চলের পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক। তবে দাবি-দাওয়া নিয়ে সুরাহা না হওয়ায় এখনো পর্যন্ত ৩৯টি কারখানা বন্ধ আছে। এ ছাড়া ১৩টি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads