পেঁয়াজের লাভের ৫৬ ভাগ দালাল ফড়িয়াদের পকেটে

সংগৃহীত ছবি

পণ্যবাজার

পেঁয়াজের লাভের ৫৬ ভাগ দালাল ফড়িয়াদের পকেটে

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১২ নভেম্বর, ২০১৮

১১ লাখ ৫৯ হাজার টন থেকে বেড়ে পাঁচ বছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৩৫ হাজার টনে। পেঁয়াজের চাহিদার বড় অংশ আসছে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে। ২২ থেকে ৩২ শতাংশ পেঁয়াজ আমদানি হলেও এর দাম উঠানামা করে ভারতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। মোট সাত ধরনের মধ্যস্থতাকারীর কারণে উৎপাদক নায্য দাম না পেলেও ভোক্তাকে পরিশোধ করতে হয় বাড়তি অর্থ। খুচরা মূল্যের মাত্র ৪৪ শতাংশ অর্থ পেয়ে থাকেন পেঁয়াজের উৎপাদক। অবশিষ্ট ৫৬ ভাগ অর্থ চলে যায় দালাল, ফড়িয়া আর আড়তদারদের পকেটে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক নাজনীন আখতার ও মাইনুল হকের গবেষণায় এমন চিত্র উঠে এসেছে।

বিআইডিএস আয়োজিত দুই দিনের বার্ষিক গবেষণা সম্মেলনে গতকাল রোববার পেঁয়াজের বাজারে প্রতিযোগিতার মূল্যায়ন শীর্ষক এ গবেষণাটি উপস্থাপন করা হয়। রাজধানীর একটি হোটেলে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। বিআইডিএস মহাপরিচালক ড. কেএএস মুরশিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন সাবেক অর্থমন্ত্রী এ সাঈদুজ্জামান ও পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব জিয়াউল ইসলাম। প্রথম দিনে কৃষি ও কর্মসংস্থান বিষয়ে চারটি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে (এসএমই) অর্থায়ন ও নারী উদ্যোক্তা বিষয়ে তিনটি এবং প্রবৃদ্ধির গুণগত মান ও মানবসম্পদ উন্নয়ন নিয়ে তিনটিসহ মোট ১০টি প্রবন্ধ উপস্থাপন হয়। তিন সেশনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন আয়োজক প্রতিষ্ঠানের সাবেক মহাপরিচালক ড. কাজী সাহাব উদ্দিন, ইকোনমিক রিচার্স গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক ড. সাজ্জাদ জহির ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. এম ইসমাইল হোসাইন।

পেঁয়াজের বাজারে দৈন্যদশার বিপরীতে কৃষি খাতে বর্গাচাষিদের সাফল্য নিয়ে সুখবর দেওয়া হয়েছে সম্মেলন থেকে। বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়েক সেনের এক গবেষণার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্গচাষির সংখ্যা ও বর্গাচাষের আওতায় জমির পরিমাণ বাড়ছে। সেচ, প্রযুক্তি আর ক্ষুদ্র ঋণের সুবিধা নিয়ে বর্গাচাষিরা এখন অনেকটাই সুখী। বিকল্প কর্মসংস্থান হওয়ায় জমির মালিকরা এখন আর চাষাবাদে যুক্ত থাকতে চাইছে না। অন্যদিকে গরু পালনে বাংলাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি লাভ হয়ে থাকে বলে জানানো হয়েছে পৃথক গবেষণায়।

ড. নাজনীন হকের গবেষণায় বলা হয়েছে, পেঁয়াজের বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েক ধরনের দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগী গড়ে উঠেছে। উৎপাদন এলাকায় গড়ে উঠেছে পেঁয়াজের এক শ্রেণির দালাল। আবার উৎপাদন কম হলেও বেশি চাহিদা রয়েছে এমন এলাকায়ও রয়েছে দালাল শ্রেণি। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে গ্রাহকের ঘরে পেঁয়াজ পৌঁছাতে আমদানিকারক ছাড়াও আরো কয়েক দফায় হাত বদল হয় পণ্যটির। ফরিদপুর জেলার পেঁয়াজ ভোক্তাপর্যায়ে আসতে হাতবদলের একটি চিত্র দেখানো হয়েছে গবেষণায়। এতে বলা হয়েছে, উৎপাদক থেকে পেঁয়াজ চলে যায় ফড়িয়াদের হাতে। সেখান থেকে যায় বেপারিদের কাছে। বেপারিরা একই জেলায় বা অন্য জেলার বেপারি বা কমিশন এজেন্টদের কাছে পাঠিয়ে দেন পণ্যটি। আমদানিকারকদের পেঁয়াজও চলে যায় কমিশন এজেন্টের হাতে। কমিশন এজেন্টের পেঁয়াজ পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের হাত ঘুরে যায় ভোক্তাদের কাছে। ঢাকার শ্যামবাজার, কারওয়ানবাজার ও মৌলভীবাজারে বেপারি ও কমিশন এজেন্টদের মধ্যে পেঁয়াজ হাত বদল হয় কয়েক দফায়। উৎপাদক থেকে ভোক্তার হাতে পৌঁছাতে পেঁয়াজের লাভের বড় একটা অংশ মধ্যস্থতাকারীদের পকেটে চলে যায় বলে দাবি করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। এতে বলা হয়েছে, পেঁয়াজের মোট ৪৩ দশমিক ৯ শতাংশ পেয়ে থাকেন উৎপাদকরা। অবশিষ্ট ৫৬ দশমিক ১০ শতাংশই চলে যায় অন্যদের কাছে। পেঁয়াজের দামের সর্বনিম্ন ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ পেয়ে থাকেন খুচরা বিক্রেতারা। পাইকারি পর্যায়ে ৮ দশমিক ১৯ শতাংশ, আড়তদার ৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ, কমিশন এজেন্ট ৭ শতাংশ আর বেপারিরা পেয়ে থাকেন পেঁয়াজের মোট মূল্যের ৭ দশমিক ১ শতাংশ অর্থ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে আমদানির ৭৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ পেঁয়াজ আসে ভারত থেকে। এ কারণে ভারতে উৎপাদন কম হওয়া, শুল্কারোপ, বন্দরের জটিলতা ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশে দ্রুত দাম বেড়ে যায়। চীন থেকে আনা হয় মোট আমদানির ১৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং খুব সামান্য আসে অস্ট্রেলিয়া, মিয়ানমার, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর ও অন্যান্য দেশ থেকে। পাশাপাশি মোট দেশি পেঁয়াজের একটি বড় অংশই জোগান দিচ্ছে পাবনা, ফরিদপুর এবং রাজবাড়ী জেলা। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে বর্গাচাষি পরিবার ও বর্গাচাষের আওতায় জমির পরিমাণ বাড়ছে বলে দাবি করা হয়েছে ড. বিনায়েক সেনের গবেষণায়। চাষের বিপরীতে ফসলের ভাগ না দিয়ে জমির ব্যবহার মূল্য বা মর্টগেজ ব্যবস্থা চালু হওয়ায় চাষিদের সুবিধা হচ্ছে বলেও প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে।

কাজী আলী তৌফিক, কাজী ইকবাল এবং ওয়াহিদ ফেরদৌস ইবনের পৃথক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মহিষের তুলনায় গরু উৎপাদন লাভজনক। কেননা গরুর উৎপাদনের পর তা থেকে ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত লাভ পাওয়া যায়। আর মহিষ উৎপাদন করে তা থেকে মাত্র ১৫ শতাংশ লাভ আসে। মহিষের তুলনায় গরুতে আয় করা সহজ হয়। তবে উল্টো চিত্র ভারতে। সেখানে আবার গরুর তুলনায় মহিষে লাভ বেশি। এতে আরো বলা হয়, বংলাদেশে গরিব মানুষরা বেশি গরু পালন করেন। তারা এর মধ্য দিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা চালান। ফলে দারিদ্র্য নিরসনে বিশেষ ভূমিকা রাখছে গরু পালন। এক্ষেত্রে যারা গরু পালন করেন তাদের মধ্যে অর্থপ্রবাহ বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে গবাদি পশু পালন সংক্রান্ত সব সুবিধা সহজলভ্য করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads