রেজাউল করিম হীরা:
তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে অশান্ত হয়ে উঠেছে পাহাড়। খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে ৪ জন নিহত এবং অন্তত ৮০ জন আহত হন। এর জেরে তিন পার্বত্য জেলায় খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানে ‘সিএইচটি ব্লকেড’ নামে সড়ক ও নৌপথ অবরোধের ডাক দেয় ‘বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র-জনতা’। এ অবস্থায় তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে।
স্থানীয়রা বলছেন, হঠাৎ পাহাড় অশান্ত হওয়ার নেপথ্যে গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে। বিশেষ করে পাহাড়ের আঞ্চলিক দল, রাষ্ট্রের পরাজিত শক্তি ও ভূরাজনীতি এর সঙ্গে জড়িত। এছাড়া দেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে পাহাড় নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে বলেও মনে করেন তারা।
নাগরিক পরিষদের খাগড়াছড়ি জেলার সম্পাদক মো. মাসুম রানা বলেন, ‘পাহাড়ে অশান্তির নেপথ্যে আঞ্চলিক দল, রাষ্ট্রের পরাজিত শক্তি ও ভূরাজনীতি জড়িত। তুচ্ছ ঘটনায় শুরু হওয়া এই সংঘাত ঘিরে অনেকে মিথ্যা ও উসকানিমূলক পোস্ট দিয়ে তরুণ ও যুবকদের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে চেয়েছে।’
খাগড়াছড়ি সদরের বাসিন্দা রোমেল চাকমা জানান, গুজব ও আতঙ্ক ছড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে একটি মহল ফায়দা লুটতে চায়, তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।
রহিম হৃদয় নামে খাগড়াছড়ি সদরের আরেক বাসিন্দা জানান, দেশের সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে পাহাড় নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ জানান, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করতে পাহাড়ি আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনগুলো তৎপর হয়ে উঠেছে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে অশান্ত করতে ষড়যন্ত্র চলছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহলে হামলা করার চেষ্টা করছে। মূলত অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেই দেশি-বিদেশি চক্রগুলোর সহযোগিতায় পাহাড়ি সংগঠনগুলো তৎপর হয়ে উঠেছে। অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে স্বপ্ন দেখছে স্বায়ত্তশাসনের।
স্থানীয়দের সঙ্গে একমত সরকার সংশ্লিষ্টরাও। তারা মনে করছেন, পাহাড়ে বহুমুখী ষড়যন্ত্র থেমে নেই। পার্বত্য অঞ্চলের সম্প্রীতি নষ্ট করতে বাইরে থেকে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির চেষ্টা করলে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। এর পেছনে জড়িতদের শক্ত হাতে দমন করা হবে।
পাহাড়ের চলমান পরিস্থিতি পরিদর্শনে গতকাল রাঙ্গামাটি যান অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা। রাঙ্গামাটি সেনানিবাসে স্থানীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক ও জাতিগোষ্ঠীর নেতা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের তারা এসব তথ্য জানান।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘কোনো অবস্থাতেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে দেওয়া যাবে না। যারা আইনশৃঙ্খলা অবনতির চেষ্টা করবে তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। যারা চেষ্টা করবে তাদের হাত ভেঙে দেওয়া হবে।’
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। এ ঘটনায় জড়িতদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেন, রাঙামাটিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সম্প্রীতি নষ্ট করতে বাইরে থেকে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।
হাসান আরিফ বলেন, বৈঠকে সবাই বলেছেন আমরা সম্প্রীতি চাই। কিন্তু জানি না কোথায় ছন্দপতন হচ্ছে। ছন্দপতনের বিষয়ে সবাই একটি বাক্য উচ্চারণ করেছে; সেটি হলো ষড়যন্ত্র। বাইরে থেকে একটি ষড়যন্ত্র হচ্ছে আমাদের এই সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য। এর পেছনে কারা জড়িত সেটা বের করতে একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি করা হচ্ছে। তাদের শক্ত হাতে দমন করা হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
একই দিন ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার রাধানগরের দক্ষিণ আন্ধারমানিকে গতকাল বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে তথ্য উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, দেশকে অশান্ত করার বহুমুখী ষড়যন্ত্র থেমে নেই। ফলে পাহাড়েও বহুমুখী ষড়যন্ত্র থেমে নেই। রাষ্ট্র সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি দেখছে। দেশ একটি সংকটকালীন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
তবে পাহাড়ে অস্থিরতায় তৃতীয় কোনো পক্ষের ইন্ধন আছে কিনা তা জানেন না বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। গতকাল দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমরা এটিকে আমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হিসেবেই দেখছি এবং সেটা সমাধানের চেষ্টা করছি। তিনজন উপদেষ্টা সেখানে গেছেন। তারা চেষ্টা করছেন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটা পরিবেশ সৃষ্টি করার মাধ্যমে যেন শান্তি বজায় থাকে। যাতে আর সংঘাত না বাড়ে। এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছু বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। আমরা চেষ্টা করেছি সমস্যা সমাধান করতে। আশা করছি এটাতে সাফল্য অর্জন করব।
পাহাড়ে সংঘর্ষের সূত্রপাত গত বুধবার খাগড়াছড়ি সদরে মোটরসাইকেল চুরিকে কেন্দ্রে করে গণপিটুনিতে মো. মামুন (৩০) নামের এক বাঙালি যুবককে হত্যা করার জের ধরে। ওই দিন সেখানকার পাহাড়ি ও বাঙালির মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়।
পরদিন বৃহস্পতিবার বিকালে হত্যার প্রতিবাদে দীঘিনালায় বাঙালিরা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। বাঙালিদের অভিযোগ, মিছিলটি বোয়ালখালী বাজার অতিক্রম করার সময় পাহাড়িরা বাধা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে দীঘিনালার লারমা স্কয়ারে বিভিন্ন দোকান ও বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়। আগুনে দীঘিনালা বাসস্টেশন ও লারমা স্কয়ার এলাকায় ১০২টি দোকান আগুনে পুড়ে গেছে। এর মধ্যে পাহাড়িদের ৭৮টি ও বাঙালির সম্প্রদায়ের ২৪টি দোকান রয়েছে।
সংঘর্ষের জেরে খাগড়াছড়ি জেলা সদর, পানছড়ি ও আশপাশের এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বৃহস্পতিবার রাতে খাগড়াছড়ি জেলা সদরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনায় তিনজন নিহত হন। আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন জুনান চাকমা (২০), ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) ও রুবেল চাকমা (৩০)।
এ ঘটনার জের ছড়িয়ে পড়ে রাঙামাটিতেও। খাগড়াছড়িতে তিন পাহাড়ির মৃত্যু এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনার প্রতিবাদে শুক্রবার সকালে রাঙামাটি জেলা সদরে ‘সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে প্রতিবাদ মিছিল বের করেন পাহাড়িরা। মিছিলে ঢিল ছোড়াকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে।
চট্টগ্রাম নগরের চেরাগী পাহাড় মোড়ে শুক্রবার সকালে প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করেছেন পাহাড়িরা। ‘বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র-জনতার’ ব্যানারে অনুষ্ঠিত কর্মসূচি থেকে তিন পার্বত্য জেলায় গতকাল থেকে ‘সিএইচটি ব্লকেড’ নামে ৭২ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
গতকাল অবরোধে স্থবির হয়ে পড়ে এই তিন পার্বত্য জেলা। পরিবহন ধর্মঘট ও সড়ক অবরোধের কারণে রাঙামাটির সঙ্গে খাগড়াছড়ি-বান্দরবান ও চট্টগ্রামের দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বন্ধ রয়েছে শহরের একমাত্র অভ্যন্তরীণ যানবাহন সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচলও।