ইয়াসমীন রীমা
বেসরকারি সংস্থার তথ্যঘর থেকে বের হয়ে বুকভরে বাতাস টেনে নিল নাহিদা। দীর্ঘদিনের নির্যাতনের যন্ত্রণা থেকে যেন একটা মুক্তির পথ সে খুঁজে পেয়েছে। তথ্যঘরের রোকশানা আপার কথাগুলো তার কাছে এখন অভয় বাণীর মতো মনে হচ্ছে। নারীদের জন্য আইন-রীতি-নীতি এত সুস্পষ্ট জানা ছিল না তার। বিষয়গুলো জানার পর সে মনের জোর ফিরে পেল। স্থির করল এবার জেলা সদরে পারিবারিক আইন সালিশী কেন্দ্রে তার অভিযোগগুলো জানাবে।
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা অন্তর্ভুক্ত গ্রাম কুটুম্বপুরের রাজমিস্ত্রি কুদ্দুস সর্দারের প্রথম মেয়ে নাহিদার বিয়ে হয়েছিল সাত বছর আগে পাশের গ্রাম হোসেনপুরের ডায়নামা মিস্ত্রি রফিকউল্লার সঙ্গে পঁচাত্তর হাজার টাকা দেনমোহরে। বিয়েতে যৌতুক হিসেবে নাহিদার বাবাকে নগদ ত্রিশ হাজার টাকা দিতে হয়েছিল। স্বামীর সংসারে নাহিদার সুখের পাশাপাশি যে দুঃখটি বয়ে চলত, তা ছিল সময়-অসময়ে স্বামী রফিকউল্লাহ তুচ্ছ সব ঘটনার রেশ ধরে তাকে মারধর করত। প্রথম প্রথম নাহিদা লোকলজ্জার ভয়ে সব আড়াল করে যেত রফিকউল্লাহর যৌথ পরিবারের সদস্যদের কাছে। কিন্তু অবস্থা দিন দিন বেগতিক হয়ে পড়ে। একসময় বিনাকারণে যে কাজটি সে আড়ালে করত, এবার তা প্রকাশ্যে সবার সামনে শুরু করে দেয়। প্রথমদিকে শ্বশুর-শাশুড়ি ও ননদ-দেবররা বাধা দিলেও পরে তারাও তার সঙ্গে তাল মেলাতে শুরু করে। নিরুপায় হয়ে পড়ে নাহিদা। পড়ে পড়ে স্বামীর মার খেতে থাকে। একসময় ইচ্ছা জাগে সে আত্মহননের পথ বেছে নেবে। কিন্তু তিন বছরে কন্যাসন্তানের মুখ চেয়ে সব সহ্য করে যাচ্ছিল এবং এই নির্যাতন প্রতিরোধের পথ খুঁজছিল। তখনই পেয়ে যায় পাশের বাড়ির ঢাকা থেকে আসা কুসুম ভাবীর পরামর্শ। তার পরামর্শে তথ্যঘরে জানতে আসে। নাহিদা স্থির করে ফেলেছে একটা বিহিত সে করবেই। এভাবে পড়ে পড়ে বিনা অপরাধে লাথি, থাপ্পড়, লাকড়ির চেলির মার সে আর খাবে না।
আমাদের দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা হরহামেশা ঘটছে। কেবল সময় আর কালের চক্রে নতুন নতুন ধরন ও মাত্রা যোগ হচ্ছে মাত্র। বউ পেটানো আমাদের সমাজে নারী নির্যাতনের নতুন কোনো ঘটনা নয়। সমাজের উচ্চ স্তর থেকে সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত এই নির্যাতন ঘটছে অহরহ। পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা এখন এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠেছে, যাতে একজন মানুষকে জীবন্ত পুরিয়ে ফেলা বা কয়েক টুকরো করে মাটিচাপা দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে হরহামেশাই। এসব নির্যাতনের ৮৮ ভাগই ঘটে থাকে পরিবারের মধ্যে। ইউএনএফপি’র মতে, স্বামী বা পুরুষসঙ্গী কর্তৃক নারীদের নির্যাতিত হওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়। এদেশের নারীরা শতকরা ৮৯ ভাগ স্বামী, ৮৬ ভাগ শাশুড়ি ও ৬৩ ভাগ ননদের হাতে নির্যাতিত হয়। আইসিডিডিআর,বি এক জরিপে উল্লেখ করেছে, গর্ভাবস্থায় নির্যাতনের শিকার ৩৭ ভাগ অভিযোগ করেছে, এ সময় তাদের পেটে লাথি ও ঘুষি মারা হয়েছে। তাছাড়া ৬২ ভাগ অভিযোগ করেছে, গর্ভাবস্থায় তাদের নিয়মিত ও পরিমিত খাবার দেওয়া হয় না। বিয়ে একটি আইনগত, ধর্মীয় ও সামাজিক বিধান। পরিবার ও বিয়ে সম্পর্কে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ধারা ১৬-এর উপ-ধারায় পূর্ণবয়স্ক নারী ও পুরুষ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষ স্বাধীনভাবে স্বামী-স্ত্রীরূপে সঙ্গী বেছে নেওয়ার এবং তাদের স্বাধীন ও পূর্ণ সম্মতিতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া দেশে বিশেষ বিবাহ আইন ১৮৭২ নামে একটি আইন রয়েছে। রেজিস্ট্রেশনবিহীন বিয়ে হওয়ার কারণে অনেক নারী তালাকপ্রাপ্ত হওয়ার পর দেনমোহর বা খরপোশ দাবি করতে পারে না। পারে না দেনমোহরের জন্য আইনের আশ্রয় নিতে। নারীরা বিয়ের পর স্বামীর হাতেই সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। স্বামীর পাশাপাশি শাশুড়ি, দেবর, ননদ ও ভাশুরের দ্বারাও নির্যাতনের শিকার হয়। সাধারণত নিম্নবিত্ত পরিবারে নারীরা নির্যাতনের শিকার হয় বেশি। তবে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারেও নারী নির্যাতন ঘটে থাকে। অপরদিকে পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনার মামলাগুলোর সঠিক বিচার হয় খুব কম। আপস করা, সময়মতো পুলিশি তদন্ত রিপোর্ট না পাওয়া এবং বিয়ের কোনো প্রমাণপত্র না থাকা ইত্যাদি কারণে মামলার বিচার হয় কম।
বৈষম্যমূলক সমাজ কাঠামোর মধ্যে এ দেশের নারীরা নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না পারিবারিক সহিংসতার মাত্রা বেড়েই চলেছে। স্ত্রী নির্যাতন অপরাধ হিসেবে সামাজিকভাবে স্বীকৃত। একটি সন্তানকে তার পরিবার থেকেই সুশিক্ষা ও আচরণগত বিভেদগুলো বোঝাতে হবে। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম রহমান বলেন, ‘ভারসাম্যহীন পারিবারিক পরিবেশের কারণে স্ত্রীরা প্রহারের শিকার হচ্ছেন। এক্ষেত্রে সমাধান করতে পারস্পরিক সহযোগিতা ও আলোচনা করা প্রয়োজন। তাদের মানসিক সম্পর্কে দূরত্ব থাকায় ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। ফলে স্ত্রী-সন্তানকে অবহেলা করে কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা করে। স্ত্রীকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ না ভেবে অধীনস্থ কর্মচারীর মতো মনে করে।’
স্ত্রী নির্যাতন আদিকাল থেকে নারী নির্যাতনের একটি ধরন হিসেবে চলে আসছে ঠিকই, তবে বর্তমানে তা হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনায় পৌঁছে গেছে। বর্তমানে স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন নারী নির্যাতনের আওতায় পড়ে। সেজন্য শাস্তি ও জরিমানা আরো কঠিন করা হয়েছে। স্ত্রী পেটানোর অপরাধে শাস্তির বিধানটি হচ্ছে- যদি কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রীকে ইচ্ছাকৃতভাবে অথবা তুচ্ছ ঘটনায় আঘাত করে অথবা গায়ে হাত তোলে, তাহলে ৩২৩ ধারামতে এক বছরের জেল অথবা পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড হতে পারে। অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। তাছাড়া যদি কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে গুরুতর জখম করে, সেজন্য সাত বছর বা তার অধিক শাস্তি হতে পারে।
অনেকে শিশুকাল থেকে দেখে আসছেন পরিবারে বা সমাজে বউ পেটানো হচ্ছে, যা দেখে তিনিও মনে করেন বউ পেটানো একটা সামাজিক কর্তব্য। উন্নত দেশগুলোতে পুলিশ বিভাগে মানসিক উন্নতির জন্য সাইকোলজি বিভাগ আছে। আমাদের দেশে তা না থাকলেও অন্তত পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে কাউন্সেলিং করে তাদের চিহ্নিত করতে হবে এবং সংশোধনের জন্য মানসিক উন্নতির লক্ষ্যে প্রয়োজনে রীতিমতো প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ ব্যাপারে বেসরকারি সংস্থাগুলো এগিয়ে আসতে পারে। প্রশিক্ষণ সেমিনার ও কর্মশালার মাধ্যমে সবাইকে বোঝাতে হবে নারীরাই তার মা-বোন-কন্যা ও বউ।